নলিনী বেরার 'সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা': লোকায়ত জীবনের দলিল
নলিনী বেরার 'সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা': লোকায়ত জীবনের দলিল
ড. নীলোৎপল জানা
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, মহিষাদল গার্লস কলেজ
"ষাটের শেষ ও সত্তর দশকের শুরুতে গ্রাম দিয়ে শহর
ঘিরে ফেলার শ্লোগান শোনা গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সে রাজনৈতিক ইচ্ছে পূরণ হয়নি কিন্তু
বাংলা কথাসাহিত্যের গতিমুখ বদলে যায়। এক ঝাঁক নতুন লেখক উঠে এসেছিলেন নানান জেলা
থেকে। তাঁরা একা-একা আসেননি- গাঁ-গঞ্জের মানুষজন, গরু-ছাগল, নদী-নালা, খরা-ঝরাকে
সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। লেখা ও লেখক দু'য়েরই গায়ে তখন ধানের গন্ধ, গো-খুরের ধুলো,
নোনা বাতাসের ছাপ। চব্বিশপরগনা, হাওড়া, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মালদহ, মুর্শিদাবাদ
ইত্যাদি জেলা যেন চরিত্র হিসেবে উঠে এসেছিল সে সব লেখায়।" (রামকুমার
মুখোপাধ্যায়,২৮ এপ্রিল ২০১৯, আনন্দবাজার পত্রিকা)
এই ধারার
অন্যতম কথাসাহিত্যিক হলেন ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়, ভগিরথ মিশ্র, স্বপ্নময়
চক্রবর্তী, আফসার আহমেদ, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিজিৎ সেন, অনিল ঘোড়াই প্রমুখ। আর
এই ধারাতেই বিশেষভাবে স্থান করে নিয়েছিলেন উড়িষ্যা ঘেষা পশ্চিম মেদিনীপুরের
প্রত্যন্ত গ্রামের লেখক নলিনী বেরা। কথাসাহিত্যে সাঁওতাল, মুন্ডা, হো, ভূমিজ,
লোধা, শবর, কামার, কুমহার এইসব আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবন-জীবিকা, খাদ্য,
বাসস্থান, পোষাক-পরিচ্ছদ, ধর্মীয় বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি সুন্দরভাবে ফুটে
উঠেছে নলিনী বেরার কথা সাহিত্যে। নিজস্ব রচনাশৈলীর গুণে স্বতন্ত্র্ স্থান করে
নিয়েছেন। সুবর্ণরেখা নদী-তীরবর্তী জনজীবনের নানা ঘটনা,
সমাজ-সংস্কৃতি ইতিহাস, ভূগোল হয়েছে তাঁর রচনার প্রধান বিষয়। নলিনী বেরার লেখায়
মানুষের কঠিন জীবনের কথা ফুটে উঠেছে। তাঁর উপন্যাসে চরিত্রগুলির সঙ্গে দুই এক
দিনের মেলামেশা নয়; দীর্ঘ মেলামেশা সূত্রে মানুষের জীবন জীবিকার নানান দিক প্রকাশিত।
তাঁর লেখার শিকড় মানব সমাজের অনেক গভীরে। তাই এই লেখার ধাতই আলাদা।
তাঁর ‘শবর
পুরাণ’, ‘শবর চরিত’, ‘অপৌরুষেয়’ ইত্যাদি উপন্যাসের মতো 'সুবর্ণরেণু
সুবর্ণরেখা'ও প্রায় একই ঘরাণার উপন্যাস। আঠাশটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত এ
উপন্যাসের কথক একজন কিশোর বালক। শুরুতে সে শোনায় মানুষজন চায় তার মেজকাকার মতো সেও
একজন নামকরা কবরেজ হোক। মেজকাকা তাকে সাপের বিষঝাড়ার
দু'চারটে মন্ত্র মুখস্থ করায় এবং কিছু ওষধিও চেনায় কিন্তু সাপের ভয়ে কিশোরটি হাল
ছেড়ে দেয়। তল্লাটের সবচেয়ে নামকরা নাচুয়া অনন্ত দত্ত চেয়েছিলেন
তালিম দিয়ে ছেলেটিকে যাত্রাদলে চড়িয়া-চড়িয়ানি সাজাবেন, কিন্তু তাও হয় না মায়ের
আপত্তিতে। মায়ের ইচ্ছে ছেলের লেখাপড়া আরও কিছুটা এগোক। তার পরে এসব চিন্তা। সে কথা
শুনে ধুতির খুঁটে বাঁধা পোকায়ভরা বেগুনগুলো কাঁধে ফেলে অনন্ত হাঁটা দেন। তার পরে
পরেই আছে গাধার পিঠে বোঁচকা-খুঁচকি চাপিয়ে, শিকলে বাঁধা মেনি বাঁদরটাকে টানতে
টানতে বাজিকরদের গাঁয়ে আসার কথা। এ তিনটি ঘটনাতে কিশোর কথকের পরিবার এবং গ্রামটিকে
বেশ চেনা হয়ে যায় পাঠকের। কিশোরটির স্কুলযাত্রার ভেতর দিয়ে কাহিনি আরও বিস্তার
পায়। গ্রামের উত্তরে সুবর্ণরেখা নদী। তার পর বেশ কিছুটা পথ পেরোলে ডুলুং নদী। তারও
খানিক পরে কিশোরটির হাই স্কুল। স্কুল ছুঁয়ে কাহিনি এগিয়ে যায় সুবর্ণরেখার তীরে।
অজস্র
বিদেশি গাছ সুবর্ণরেখার
তীরে ।
কথিত আছে এই 'জাহাজকানার জঙ্গলে' দূর অতীতে একটা মালমশলা ভরা জাহাজ ডুবে গিয়েছিল।
তখন জাহাজ ডোবার মতো জল ছিল সুবর্ণরেখায়। এখন সে গভীরতা নেই কিন্তু জলের
উৎসব আছে।
হংসী নাউড়ীয়ার নৌকাটিকে ফুল-চন্দনে সাজিয়ে পাঁচ গাঁয়ের মানুষ নৌকাবিলাসে করে।
তাঁদের কপালে তিলক, গলায় কাঠমালা, গায়ে 'লাউফুলের মতো সাদা গেঞ্জি'। জলের উপর পড়া
সূর্যকিরণের খানিক লাল প্রতিফলন তাঁদের গায়েও। কিশোর ললিনকেও তাঁরা সঙ্গে নেন কারণ
নাউড়ীয়ায় সঙ্গে নৌকাবিহারে তার মহা উৎসাহ। স্কুলে পড়া বিদ্যা আর 'মাছের কাঁটার মতো
হাতের লেখা'-র গুণে সে মানুষজনের বড়ো কাছের। ঔপন্যাসিক বাস্তবের নদীর সঙ্গে মিথ,
পুরাণ, প্রকৃতি, উৎসব এবং কিজুটা নিজের কৈশোরকে মিশিয়ে নিয়ে প্রথম পরিচ্ছেদেই
উপন্যাসের মূলসুরটি বেঁধে দেন।
এই
উপন্যাসের ভৌগোলিক অবস্থান এমনই যেখানে দেখা যাচ্ছে এই নদীকে কেন্দ্র করে বাংলা,
বিহার উড়িষ্যার মানুষ ‘বালিজাত’ উৎসব
করে থাকে; যেহেতু এই নদীর তীরে আছে পান্ডুয়া গ্রাম। তাই তারা এই উৎসব করে থাকে;
কারণ মহাভারতের কথিত আছে পাণ্ডবরা অজ্ঞাতবাসের সময় কিছুদিন এই গ্রামে
কাটিয়েছিলেন এই বিশ্বাস থেকে এখানকার জনজাতি 'বালিজাত' উৎসব
পালন করে থাকে। এছাড়া অন্যান্য গ্রামনামের সঙ্গে লেখক মহাভারতের নানান প্রসঙ্গ
তুলে ধরেছেন যা পাঠককে একটি নস্টালজিক জগতে নিয়ে যায়। যেমন- বছরের শেষ দিনে এই
অজ্ঞাতবাসে এসে নদী জলে নেমে পিতৃ উদ্দেশ্যে তর্পণ করেছিলেন যুধিষ্ঠির, তাকে ঘিরে
আজও নদীর বালিয়াড়িতে বসে 'বালিজাত' উৎসব। গাজনের পরের দিন বাংলা বিহার উড়িষ্যার
কত মানুষ যে আসেন নদীর দুই তীরে নদী জলে তর্পণ করতে তার হিসেব কে রাখে। নদী এখানে
উত্তর বাহিনী।
এখনো আছে 'পান্ডুয়া' গ্রাম যেখানে কিছুদিন কেটেছিল
পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাস। এখনো আছে 'অসুর ছড়া' যেখানে ভীম অসুর মেরে জমা করেছিল
অসুরদের হাড়। এখনো আছে 'ভাত হান্ডিয়া' যেখানে রান্না শেষে ভাতের হাড়ি রাখতেন সতী
দ্রৌপদী। এখনো আছে 'পাণ্ডবেশ্বর' যেখানে শিব আরাধনা করতেন পাণ্ডবেরা।এই গ্রামগুলির
সঙ্গে মহাভারতের জোক কতখানি বা এর সত্যতা কতখানি তার বিচার বিশ্লেষণ না করেই বলা
যায় উপন্যাসের নায়ক ললিন হংশী নাওুড়িয়ার নৌকায় চড়ে সুবর্ণরেখা নদী ভ্রমণের
সময় যেভাবে কল্পনার জগতে প্রবেশ করে সুবর্ণরেখা তীরবর্তী গ্রাম্য নামের সাদৃশ্যে
মহাভারতের প্রসঙ্গকে একত্রিত করেছেন তা এক কথায় অভিনব ও অনবদ্য।
কিন্তু
জীবন তো মানচিত্রকে ছাপিয়ে যায়। তাই কথকের জামাইবাবু আসেন ওড়িশা থেকে, বিহার মুলুক
থেকে ছেলের নাচনি বউ মেলে আর ললিনের কৈশোরের কাম ও কামনা জড়িত রসনাবালা ভিন রাজ্যে
চলে যায়। সেই সঙ্গে নানান মিশ্রণে ভাষাও নতুন রূপ নেয়। হাটুয়া ভাষা তৈরি হয়। উঠোনে
বসে ছোটরা পড়ে- 'দেয়ার ইজ এ ফ্রগো, সেঠিরে গুট্যে ব্যাঙো'।
এই
উপন্যাসে ছড়িয়ে আছে দীর্ঘ জনপথ তাই জনবিন্যাসও বেশ আকর্ষণীয়। চার বর্ণের মানুষ
রয়েছে এই জনপদে। সেই সঙ্গে মিশে রয়েছে আদিবাসী মানুষ জন। এই অঞ্চল দিয়ে হেঁটে
গেছেন শ্রীচৈতন্য নীলাচলে। তারপরেই বৈষ্ণব ধর্মের ব্যাপক প্রভাব পড়ে এই অঞ্চলে।
এই সময় বাইরে থেকে কিছু গোস্বামী ব্রাহ্মণ রাতারাতি উপস্থিত হয়ে ভূসম্পত্তির
অধিকারী হয়ে যায়, চন্ডালরা ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ হয়ে যায়। রাখি পূর্ণিমার দিন
হোস্টেলের রাধুনী টুডু; হেমব্রম, হাঁসদা, মাহাতো, শিং দের বেশ চড়া দামে পৈতে
বিক্রি করে। আদিবাসীরা ও বদলে যেতে থাকেন অর্থনৈতিক নানা কারণে। বৃদ্ধ সাঁওতাল
এককালে মাথার উপর হাত তুলে মেঘ-ছুঁইতো কিন্তু এখন সে আকাশ ধরা ছোঁয়ার বাইরে ।
সাঁওতালদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনতে চাঁদ আর মাটিতে নেমে আসে না।
ললিনের নাইন পাস করা কাকা বিজয়চন্দ্র, হাসদার কাছে যায় পুলিশ মিলিটারিতে ঢোকা
যায় কি করে তার পরামর্শ নিতে। এসবই উপন্যাসিক নলিনী বেরা নিজের চোখে দেখা কাহিনিকে
জুড়ে দেন এই উপন্যাসে। একটা পরিবর্তন লেখক লক্ষ্য করেছেন সমাজ দেহে।
নদী, বন,
জঙ্গল, কৃষিভূমি মিলে যে বিশাল ক্ষেত্র সেখানে বর্গী ও মোগলদের হাঙ্গামা হয়েছিল,
নীল চাষের পর্বে সাহেবরা চালিয়েছিল অত্যাচার, নতুন চর জাগলে নদীতে তার দখল নিয়ে
থানা পুলিশ কোড-কাচারি হয়। তা থেকে তৈরি হয়, প্রবাদ, লোকগান ইত্যাদি ।
এমন সব রাজনৈতিক সামাজিক
টানাপোড়নের ভেতর মনরোগী পিসির সন্ধানে দুই ভাইপো দূর পথে পাড়ি দেয়। ছাগল চরানি
সরলা সেজেগুজে বিয়ের পিঁড়িতে বসে। মনুষ্যকন্ঠে কোকিল ডেকে উঠে- ‘এ শুধু গানের
দিন এ লগন গান শোনাবার/ এ তিথি শুধু গো যেন দখিন হওয়ার।’ এই বলেই উপন্যাসটির
পরিসমাপ্তি ঘটে।
ভাষা
প্রসঙ্গের আলোচনা করেই আমার ক্ষুদ্র আলোচনা শেষ করব। সুবর্ণরেখা
অঞ্চলটির ভৌগোলিক অবস্থান প্রসঙ্গক্রমে আগে আলোচনা করলেও এখানকার ভাষা মেদিনীপুরের
দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলবর্তী অঞ্চলের লোকভাষা। এই ভাষার সঙ্গে উড়িষ্যার ভাষার
যেমন যোগ আছে তেমনি আবার কিছু হিন্দি বলয়ের ভাষা ও যুক্ত হয়ে গেছে। যে কারণে
এখানকার ভাষার গঠণ একটু ভিন্ন ধরনের যেহেতু লেখক এই অঞ্চলে থেকেছেন দীর্ঘদিন এবং
মানুষের সঙ্গে মিশেছেন সেহেতু পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর এই উপন্যাসে
কোনো কিছুই তাঁকে বানিয়ে বলতে হয়নি; বরং মানুষের কথাবার্তাকেই তিনি হাতিয়ার
করেছেন। উপন্যাসের ঘটনাস্থল তথা লেখকের জন্মস্থানের ভাষা প্রসঙ্গে গ্রন্থের
অভিভাষণে অকপটে বলেছেন--
"….সেই কবে শুরু করেছিলাম। সুবর্ণরেখা নদী তীরবর্তী ওড়িশা সংলগ্ন
লোধা-ভুঁইঞা-ভূমিজ-কামহার-কুমহার-সাঁওতাল অধ্যুষিত একটা গ্রাম থেকে। বেশিরভাগ
সময়টাই সে তল্লাট উৎকলের অধীন ছিল। ভাষাটাও বাংলা নয়। হাফ ওড়িয়া, হাফ বাংলা। মাটির
দাওয়ায় ডিবরির আলোয় এই সেদিনও দুলে-দুলে পড়তে শুনেছি- 'There
is a frog, দেয়ার ইজ এ ফ্রগো- সেঠিরে গুট্যে ব্যাঙো'।
মূলত
রাজু তেলি সদগোপ করণ কৈবর্ত খণ্ডায়েৎ সব হাটুয়া লোকেদের ভাষা। 'হাটুয়া' বা 'কেরা
বাংলা'। মান্য বাংলাটাই এখানে 'দিকু' বা বিদেশিদের ভাষা!"
এই অঞ্চল
অর্থাৎ নয়াগ্রাম-কুলটিকরি সংলগ্ন এলাকার ভৌগোলিক অবস্থানই ভাষাচর্চার একটি
গুরুত্বপূর্ণ কারণ। পশ্চিমবঙ্গের এই সীমান্তবর্তী এলাকার একদিকে উড়িষ্যা অন্যদিকে
ঝাড়খণ্ড। ভাষাতাত্ত্বিক ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় এই এলাকার ভাষাকে রাঢ়ী
উপভাষার অন্যতম রূপ 'দক্ষিণ-পশ্চিমা বাংলা' বলে অভিহিত করেছেন। ড. বিজনবিহারী
ভট্টাচার্য মহাশয় এই
অঞ্চলের ভাষাকে 'উড়িয়া প্রভাবিত বাংলা' ভাষা বলেছেন। এই
উপন্যাসের গ্রাম্য চরিত্রদের কথাবার্তায় লোকভাষার বৈশিষ্ট্যগুলি সুন্দরভাবে ধরা
পড়ে । এখানে ওই এলাকার লোকায়ত শব্দভাণ্ডার এবং লোকো ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক
রূপতাত্ত্বিক দিক তুলে ধরার চেষ্টা করব—
লোকায়ত শব্দভাণ্ডার(সংক্ষিপ্ত)
মু- আমি।
নিমু- নেব।
নাচুয়া- নর্তকী।
পদ্মল ঘা- শত পাপড়ির মতো বিকশিত ঘা। তার মানে
ক্যানসার।
হলহলিয়া- হেলে সাপ।
হাটুয়া- যাঁরা বাংলা-ওড়িয়া মেলামেশি ভাষায় কথা বলেন।
ঢ্যাপচু- ফিঙে পাখি।
খইচালা- খই ভাজার চালা।
হুরি- গন্ডগোল।
আখের পুআ- আখের চারা
রহিণ- হলকর্ষণ উৎসব।
কুদি মেরে- মুখে আওয়াজ করতে করতে উন্মত্তের মতো দৌড়ে
আসা।
চাঁড়রা- টেকো।
ট্যাসা-নীলকণ্ঠ পাখি।
হুড়ি- ছোটখাটো পাহাড়ের মতো উঁচু জায়গা।
টাঁড়- প্রান্তর।
বাবু-ঘর- জমিদার বাড়ি।
মেঘপাতাল- আকাশ।।
কুল্লি- গ্রামের ভিতর বালিরাস্তা।
ঝুরকা- ছোট জানলা।
সেরেঞ- সাঁওতালি ভাষায় গান।
নাকের পঁটা- সিকনি।
দক- জলাভূমি।
'বহু'- বউ।
'পাত'- থালা।
ভাস- গণৎকার।
ফুঁকনলি- উনুনে ফুঁ দেওয়ার বাঁশের নলি।
মাগনে- যাচঞায় বা আদায়ে।
চাঙ- অনেকটা ছোটাকৃতি সাইড্রাম, বিড্রামের মতো।
গুড়াখু- তামাক।
ঘড়া- কল।
"উঠিলা সোয়ারি বসিলা নাহি, ফিরি চাঁহিবাকু
দিশিলা নাহি, মাগো"- উঠল পালকি বসল না। ঘুরে
তাকালে আর তোমাকে দেখা
যাচ্ছে না মা।
'ঠারে'- সাঁওতালি কথ্য ভাষায়।
কাঁকরভেজা- শিশিরে ভেজা।
চ্যাচ্চেড়ি- একপ্রকার বাদ্যযন্ত্র।
বাহাঘর- বিয়েবাড়ি।
কষিকুসুম- ফুলের কুঁড়ি।
হিডু- জমির আলের গোড়া।
কাতা- নদীর পাড়।
ডেগ্- কড়াই।
বৈতাল-কু মড়ো।
কাঁখুয়ার- চালকুমড়ো।
কাঁকুড়- শশা।
চুরকা- আলুজাতীয়, মূল।
দেড়ইয়া- সঙ্গম করতে দেওয়া।
গজাল- লম্বা বাঁশ।
নাউড়ীয়া- নৌকার মাঝি।
সোউ- সেই।
দেখুটু- দেখছ।
ভাসাই থিলা- ভাসিয়েছিল।
কুঁহরাচ্ছে- ডাকছে।
বিলেই- বিড়াল।
বউড়ি- বউ।
বকট- বকে যাচ্ছ , ইত্যাদি।
ধ্বনিতত্ত্ব--
· 'ও'কারের
'উ'কারে পরিণতি
আছো > আয়ু, খাইবো > খাইবু,
যাবো > যাবু
· শব্দের
আদিতে 'ও'কারের লোপ।
যেমন- বোকা > বকা , কোমর >
কমর, অল্পপ্রাণ ধ্বনি মহাপ্রাণ ধ্বনিতে পরিণত।
বোন > ভন
· 'ন'
ধ্বনি 'ল' তে পরিণত হয়।
· নদী>
লদী
নলীন >ললীন, নাড়া >লাড়া,
নৌকা > লৌকা, মধ্য স্বরাগম লক্ষ্য করা যায়।
কন্যা > কইন্যা, যেতে
>যাইতে, চুল > চুইল, নীল > নাইল, চাল চাউল, এল > আইলা,
রূপতত্ব--
·
'ট'কার যোগে শব্দ গঠন।
লিখাপড়া
করেটে, খোলাচুল,হাওয়ায় উড়েটে, তুমি কইট, আমন্ন্নে কইটি, বকর বকর বকট ললিন,
·
'ই' কার যুক্ত অসমাপিকা ক্রিয়া ব্যবহার হয়।
বুসি পড়লা, দৌড়ি গেলা, সারারাতি ফুল কুড়ালি
·
অপাদান কারকে 'নু' বিভক্তি ব্যবহার
মুই
স্পষ্ট দেখনু,মুই ধরনু দৌড়ি আইনু, এখাননু বড়জের এশ-বত্রিশ গজ হিবে,
·
'ঠি' যোগে শব্দ গঠন
সউঠি, ওউঠি, কুনঠি,
·
মু. মুই, মোর ইত্যাদি সর্বনাম এই অঞ্চলের ভাষায়
প্রচলিত।
মুই
কাঁদি পারুনি, মু গড়িপিটি মানুষ করি নিমু, মোর নাটুয়া দলে,
·
উত্তম পুরুষে অতীতকালে ক্রিয়ার সঙ্গে 'থিলি' ক্রিয়া
বিভক্তি যুক্ত হয়।
কি
কইথিলি? কাই যাইথিলি জানু।
·
বহুবচনে 'গা' যুক্ত হয়।
টকাগা, লতাগা
·
অনুজ্ঞায় 'উ' যুক্ত হয়।
সেকথা থাউ
·
বিপ্রকর্ষ (মধ্যস্বরাগম) প্রবণতা আছে।
সে আইসেটে (সে আসছে) ঘুটঘুটিয়া অন্ধকার
(ঘুটঘুটে অন্ধকার)ইত্যাদি।
কবিতা দিয়ে সাহিত্য জীবন শুরু করলেও গ্রাম ও শহরের ভেতর মেলবন্ধন ঘটানোই
তাঁর প্রিয় ইচ্ছা ছিল; সেই কারণে কথাসাহিত্যেই তাঁর সম্যক পরিচিতি ঘটে। জলা
জঙ্গলময় সাঁওতাল, লোধা অধ্যুষিত জন্মভিটায় বারবার ছুটে গেছেন উপন্যাসের তথ্য
সংগ্রহে। যদিও এসব জীবন তাঁর জানা। তিনি জানেন এই অঞ্চলের ইতিহাস ও পুরাণ। তিনি
কোনোরকম পরিবর্তন না করেই এলাকার মানুষের প্রতিদিনের ব্যবহৃত ভাষাকে অবলীলাক্রমে
গ্রন্থস্থ করেছেন; যা পড়তে পড়তে আমরা সেই সুবর্ণরেখা অঞ্চলের চৌহদ্দির মধ্যে
ঢুকে পরি । দেখতে পাই সেই নবীন যুবক ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, এলাকার মেয়ের বিয়ে
হচ্ছে, কেউ বা পুলিশে, মিলিটারিতে নিজের জায়গা করে নিচ্ছে। উপন্যাসের প্রতিটি
চরিত্র যেন পাঠকের সামনে নড়াচড়া করছে। উপন্যাসের বিষয়, ঘটনা, রচনা রীতি, ভাষা,
কাহিনিবিন্যাস প্রভৃতি ক্ষেত্রে নলিনী বেরা বিশেষ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। সব
মিলিয়ে বলা যায় ‘সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা’ যেন সুবর্ণ-ভান্ডার। ঔপন্যাসিক নলিনীর কাব্যময় গদ্যের মিলমিশে ‘সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা’
উপন্যাসটি সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে। উপন্যাসটি লোকায়ত জীবনের অপূর্ব দলিল। এই লোকায়ত
বিশ্বের কোনো সীমা নেই, চৌহদ্দি নেই, দেশ নেই, কালও নেই। নদী জঙ্গল ঘেরা লেখকের
গ্রামকে কেন্দ্র করে তাই অনায়াসেই পৌঁছে যাওয়া যায় সমগ্র গ্রামীণ ভারতবর্ষের
প্রতিটি গ্রামে।
গ্রন্থঋণ
নলিনী বেরা, সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা, দে'জ পাবলিশিং,
২০১৯
কোরক পত্রিকা শারদ সংখ্যা, ১৪১৫
সৃজন পত্রিকার নলিনী বেরা সংখ্যা, ২০২২
বিপ্লব মন্ডল, দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলার ভাষা ও
সংস্কৃতি, ওড়িয়া প্রভাব ; পুস্তক বিপণি, ২০১৯

কোন মন্তব্য নেই
ok