নাট্যকার রামনারায়ণ তর্করত্ন : ড. নীলোৎপল জানা
নাট্যকার রামনারায়ণ তর্করত্ন
মধুসূদনের পূর্বে বাংলা নাটকের প্রস্তুতিপর্বে
নাটক রচনায় যাঁর খ্যাতি তিনি হলেন 'নাটুকে রামনারায়ণ'। রামনারায়ণ তর্করত্ন বাস্তব ও
সরস নাটক রচনার জন্য 'নাটুকে রামনারায়ণ' নামে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। রামনারায়ণ মূলত
সামাজিক সমস্যামূলক নাটক রচনা করলেও পৌরাণিক ও প্রহসন রচনায় তাঁর খ্যাতি যথেষ্ট। তাঁর
নাটকের প্রধান সম্পদ হল হাস্যরসের উপস্থাপনা। তাঁর 'কুলীনকুলসর্বস্ব' (১৮৫৪) প্রথম
বাংলা সামাজিক নাটক হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছে। রামনারায়ণ সমাজসচেতন নাট্যকার ছিলেন। ঊনবিংশ
শতাব্দীতে পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাবে
আমাদের সমাজে যে সংস্কারবাদ বনাম প্রগতিবাদের সংকট দেখা দেয় সে বিষয়ে যাঁরা সক্রিয় ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রামনারায়ণ। তিনি প্রাচীনপন্থী ব্রাহ্মণ পণ্ডিত সমাজে জন্মগ্রহণ করলেও মানসিকতায় ছিলেন প্রগতিবাদী। কৌলীন্য প্রথা, বিধবা বিবাহ ও সতীদাহ প্রথা প্রভৃতি সম্পর্কে রামনারায়ণের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সমকালীন নবজাগ্রত জীবনচেতনার অনুসারী। নাট্যকারের রচিত নাটকগুলি হল-
(ক) মৌলিক নাটক -'কুলীনকুলসর্বস্ব' (১৮৫৪); 'নবনাটক' (১৮৫৬); 'স্বপ্নধন' (১৮৭৩); 'ধর্মবিজয়' (১৮৭৫); 'রুক্মিণী হরণ' (১৮৭১); 'কংসবধ' (১৮৭৫)।
(খ) প্রহসন- 'যেমন কর্ম তেমনি ফল' (১৮৬৫); 'উভয়সঙ্কট' (১৮৬৯); 'চক্ষুদান' (১৮৬৯)।
(গ) নাট্যানুবাদ- 'বেণীসংহার' (১৮৫৬); 'রত্নাবলী' (১৮৫৮); 'অভিজ্ঞান শকুন্তল' (১৮৬০); 'মালতীমাধব' (১৮৬৭)।
নাট্যকার হিসেবে তাঁর কৃতিত্ব নিম্নরূপ-
এক-সমকালীন সামাজিক নানা ব্যাধিকে কেন্দ্র করে রামনারায়ণ
নাটক রচনায় ব্রতী
হয়েছিলেন। এই সামাজিক দায়বদ্ধতা রামনারায়ণকে
দিয়েছে মর্যাদা।
দুই-শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, 'রামনারায়ণ
তর্করত্নের 'কুলীনকুলসর্বস্ব' (১৮৫৪) প্রথম সার্থক নাটকের গৌরব দাবি করতে পারে। ইহাতে
লেখক পুরাণ ও পুরাণুকরণ ছাড়িয়া সর্বপ্রথম বাস্তব সামাজিক জীবনে পদক্ষেপ করিয়াছেন।"
(বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা- ১৯৬৩, পৃঃ-৩৩)
তিন-পাইকপাড়ার দুই জমিদার ভাই ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ
ও প্রতাপচন্দ্র সিংহের উদ্যোগে তাঁদের বাগানবাড়িতে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে 'রত্নাববলী' নাটকের
যে অভিনয় হয়েছিল তা বাংলা নাটক রচনায় মধুসূদনের আগমনকে প্রসারিত করেছিল। এছাড়া জোড়াসাঁকোর
ঠাকুরবাড়ির রঙ্গমঞ্চে তাঁর 'নবনাটক' অভিনীত হয়েছিল। ফলে বাংলা রঙ্গমঞ্চের বিকাশে রামনারায়ণের
নাটকগুলির বিশেষ গুরুত্ব স্বীকৃত।
চার-অনুবাদমূলক নাটক ও প্রহসন রচনা করে বাংলার মানুষের
নাট্যপিপাসা চরিতার্থ করবার ক্ষেত্রে প্রাক্ মধুসূদন নাট্যপর্বে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়
হয়ে থাকবে।
কোন মন্তব্য নেই
ok