Translate

উপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়: ড. নীলোৎপল জানা

 


শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮)

  বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা উপন্যাসে যিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে, তিনি হলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের জনপ্রিয়তা থাকলেও সেগুলি সর্বশ্রেণীর পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। কারণ সেখানে চরিত্রগুলি মূলত উচ্চশ্রেণীর এবং সেখানে নাগরিক জীবনের সমস্যাই প্রকাশিত। এই অবস্থায় শরৎচন্দ্র এলেন ঘরের কথা, সাধারণের কথা, নারীদের কথা, পারিবারিক জীবন ও সমস্যার কথা নিয়ে। আবেগময় ভাষাভঙ্গীতে তার প্রকাশ পাঠককে সহজেই আকৃষ্ট করেছিল। বিষয়বস্তু ও আবেগ বাংলাদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের আনন্দ-বেদনার সার্থক রূপকার শরৎচন্দ্র। তাঁর প্রথম উপন্যাস 'বড়দিদি' (১৯১৩) এবং শেষ উপন্যাস 'বিপ্রদাস' (১৯৩৫) ও মৃত্যুর পর প্রকাশিত 'শুভদা' ও 'শেষের পরিচয়' পর্যন্ত প্রায় ত্রিশটি ছোটবড়ো উপন্যাসে তার পরিচয় ছড়িয়ে আছে।

উপন্যাসসমূহ: তাঁর প্রধান উপন্যাসগুলির প্রকাশকালের বিচারে কালানুক্রমিক তালিকা- 'বড়দিদি' (১৯১৩), 'বিরাজবৌ' (১৯১৪), 'পরিণীতা' (১৯১৪), 'পণ্ডিতমশাই' (১৯১৪), 'মেজদিদি' (১৯১৫), 'চন্দ্রনাথ' (১৯১৬), 'বৈকুণ্ঠের উইল' (১৯১৬), 'অরক্ষণীয়া' (১৯১৬), 'শ্রীকান্ত' (চার পর্ব- ১৯১৭, ১৯১৮, ১৯২৭, ১৯৩৩), 'দেবদাস' (১৯১৭), 'চরিত্রহীন' (১৯১৭), 'স্বামী' (১৯১৮), 'দত্তা' (১৯১৮), 'ছবি' (১৯২০), 'গৃহদাহ' (১৯২০), 'বামুনের মেয়ে' (১৯২০), 'দেনাপাওনা' (১৯২৩), 'নববিধান' (১৯২৪), 'পথেরদাবী' (১৯২৬), 'শেষপ্রশ্ন' (১৯৩১), 'বিপ্রদাস' (১৯৩৫)। মৃত্যুর পর প্রকাশিত 'শুভদা' (১৯৩৮), তাঁর অসমাপ্ত উপন্যাস 'শেষের পরিচয়' সমাপ্ত করেন রাধারানী দেবী।

এই উপন্যাসগুলির বিভিন্নজনে বিভিন্ন ভাবে শ্রেণীবিভাগ করেছেন- কেউ বিষয়ভিত্তিক, কেউ রচনারীতিভিত্তিক ইত্যাদি ভাগে ভাগ করেছেন। এই শ্রেণীবিভাগের আগে অন্য একটি প্রসঙ্গে আসা যাক। শরৎচন্দ্রের রচনায় দুই প্রভাবশালী সাহিত্যিক পূর্ববর্তী বঙ্কিমচন্দ্র ও সমকালীন রবীন্দ্রনাথের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। তবে বঙ্কিম অপেক্ষা রবীন্দ্রনাথের প্রভাব বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। তাঁর বঙ্কিম-প্রভাবিত রচনাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- 'দেবদাস', 'পরিণীতা', 'বিরাজ-বৌ', 'পল্লীসমাজ', 'দত্তা', 'দেনাপাওনা', 'পথের দাবী' প্রভৃতি। উপন্যাসগুলির আখ্যানে সমস্যা ও সমাধানে বঙ্কিমচন্দ্রের অনুসরণ লক্ষণীয়। দেবদাস ও পল্লীসমাজে বাল্যপ্রণয়জনিত সমস্যা 'রজনী' ও 'চন্দ্রশেখর'-এর কথা স্মরণ করায়। চন্দ্রনাথে বঙ্কিমের 'ইন্দিরা'র ছায়া স্পষ্ট- পাচিকাবেশে স্বামী মিলন বিষয়টি লক্ষণীয়। আবার 'আনন্দমঠে'র ছায়া 'পথের দাবী'র উপর পড়েছে।

শরৎচন্দ্রের যে-সব রচনায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাব আছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- 'মন্দির', 'বড়দিদি', 'চরিত্রহীন', 'গৃহদাহ', 'বিপ্রদাস', 'অরক্ষণীয়া' প্রভৃতি। গৃহদাহে 'চোখের বালি'র ছাপ আছে। 'গোরা', 'নৌকাডুবি'রও ছাপ স্পষ্ট বিশেষত হিন্দু-ব্রাহ্মের বিরোধের চিত্রাঙ্কনে।

বিষয়গত বিচারে শরৎচন্দ্রের রচনাকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। এপ্রসঙ্গে একটি কথা বলতে হয় শরৎচন্দ্রের প্রায় সমস্ত রচনাই পরিবারকে কেন্দ্র করে সামাজিক সমস্যামূলক। বিষয়গত দিক থেকে চারটি ভাগ: 

১. পারিবারিক স্বার্থবোধজনিত সমস্যার কাহিনী: বিন্দুর ছেলে, পরিণীতা, বিরাজ-বৌ, পণ্ডিতমশাই, মেজদিদি, রামের সুমতি, নিষ্কৃতি, বৈকুণ্ঠের উইল প্রভৃতি। আমাদের অতি পরিচিত পরিবারের সুখ-দুঃখ- ভালবাসার দৈনন্দিন জীবনের ছবি মরমী কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসেই উঠে এসেছে, তাই পাঠক ঘরের কথাকে পেয়ে উদ্বেল হয়েছে। তাঁর ক্ষুদ্রাকার দুই উপন্যাস বৈকুণ্ঠের উইল, পণ্ডিতমশাই-এর নাম প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে। পণ্ডিতমশাই-এ বৃন্দাবন ও কুসুমের সম্পর্কে মধ্যে প্রধান বাধা পারিবারিক ও সামাজিক সংস্কার। কুসুমের পক্ষে বাধা তার বৈধব্যের সংস্কার, অন্যদিকে বৃন্দাবনের ক্ষেত্রে মায়ের অপমান। বৈকুণ্ঠের উইলে দেখি ভ্রাতৃস্নেহের চূড়ান্ত রূপ।

২. নরনারীর সমাজ-নিষিদ্ধ প্রণয়ের কথা বড়দিদি, দেবদাস, পল্লীসমাজ, চন্দ্রনাথ, চরিত্রহীন, গৃহদাহ, দেনাপাওনা প্রভৃতি। দেবদাস শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয় উপন্যাসগুলির অন্যতম। এখানে বঙ্কিমের অনুসরণ লক্ষণীয়। এখানে পার্বতী-দেবদাসের বাল্যপ্রণয় চন্দ্রশেখরের প্রতাপ-শৈবলিনীর বাল্যপ্রণয় স্মরণ করায়। আর শরৎচন্দ্রের বিশিষ্ট উপন্যাস 'চরিত্রহীন'। সেই সময়ে লেখকের খ্যাতি-অখ্যাতির অনেকটাই নির্ভর করছিল উপন্যাসটির উপর। এই উপন্যাসে 'চোখের বালি'র প্রভাব চোখে পড়ে। চোখের বালির আদর্শে কিরণময়ীর পরিকল্পনা বলে মনে হয়। চরিত্রহীন-এর প্লট খুব একটা গোছানো নয়। দুটি পাশাপাশি চলা কাহিনীর সাবিত্রী ও কিরণময়ীর ততখানি মিল হয়নি। গৃহদাহের প্লট অনেকটা স্পষ্ট- এখানেও চোখের বালির ছাপ দেখা যায়। দেনা-পাওনা শরৎচন্দ্রের এক জটিল উপন্যাস। নায়ক জীবানন্দ এক ব্যতিক্রমী চরিত্র- একজন মানুষ সম্পর্কে পাপাচারী, দুর্বৃত্ত প্রভৃতি যত খারাপ কথাই বলা যায় তা যেন এরপক্ষে যথেষ্ট নয়। তার বিবাহিত পরিত্যক্ত স্ত্রী এখন ভৈরবী। এই ভৈরবীর প্রতি আকর্ষণ ও পুনরায় সংসারে প্রবেশের বাসনা কীভাবে জাগল তাই এখানে দেখানো হয়েছে।

 

৩. আত্মকথামূলক: শ্রীকান্ত (চারটি পর্ব)। লেখকের আত্মকথামূলক উপন্যাস চারটি পর্বে প্রকাশিত। প্রথম পর্বে বাল্যজীবনের কথা, দ্বিতীয় পর্বে বর্মা প্রবাসের কাহিনী, আর তৃতীয়-চতুর্থ পর্বে বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে কল্পনার মিশ্রণ দেখা যায়। এই উপন্যাসের প্লটে শিথিলতা, উপন্যাসের সংহত রূপ এই প্লটে নেই। অবশ্য উপন্যাসের পন্থাকার প্লটে সেটা ততখানি পাওয়া যায় না। অবশ্য দীর্ঘকাল ধরে খণ্ডে খণ্ডে রচনাও প্রকাশ করার জন্য প্লটের সংহতি নষ্ট হয়েছে।

৪. রাজনৈতিক চেতনামূলক পথের দাবী। ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের ঢেউ ভারত ভূখণ্ডের বাইরে ছড়িয়ে পড়েছিল, ব্রহ্মদেশে। এখানে তার ছবি পাই। তবে উপন্যাসটিতে রাজনৈতিক কার্যকলাপ থাকলেও রাজনৈতিক উপন্যাস হয়ে ওঠেনি, রাজনীতিকে ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে অপূর্ব-ভারতীয় প্রেম। এখানে "সব্যসাচীর কোমলগম্ভীর রোম্যান্টিক ভূমিকাই পথের দাবীর জনপ্রিয়তার হেতু। আসলে কিন্তু বিপ্লব-পন্থার ইতিহাস-চিত্র হিসাবে পথের দাবী খুব সার্থক নয়।” 'শেষ প্রশ্নে'ও রাজনীতি আছে তবে তা তত্ত্বমূলক। বিতর্কিত ও ব্যতিক্রমী উপন্যাস হিসাবেও তাৎপর্যপূর্ণ এই উপন্যাসটি।

উপসংহার: বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের সর্বাধিক জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথের খ্যাতির পরিমণ্ডলে কুণ্ডলীন পুরস্কারের জন্য মনোনীত 'মন্দির' গল্প দিয়ে যার সূচনা, অসমাপ্ত উপন্যাস 'শেষের পরিচয়ে' তার সমাপ্তি। সহজ সরল আবেগময় ভাষায় আমাদের ঘরের কথাকে, মনের কথাকে প্রকাশ সরৎচন্দ্রের বিশেষত্ব। প্রায় ত্রিশখানি উপন্যাসের সবগুলিই যে সার্থক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ তা নয়। তবে বেশ কয়েকটি উপন্যাসে তিনি জনপ্রিয়তার শিখরে বসে আছেন।

================

যারা পেজটি দেখছেন বা ফলো করছেন অবশ্যই নাম লিখে কমেন্ট দিন

কোন মন্তব্য নেই

ok

4x6 থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.