Translate

চর্যাগীতির পরিচয় : ড. নীলোৎপল জানা

 


চর্যাগীতির পরিচয়

১. উদ্দেশ্য
২ চর্যাগীতির আবিষ্কার ও প্রকাশ:
৩ চর্যাগীতির ভাষা প্রসঙ্গ:
৪ চর্যাগীতির গুরুত্ব:
    ১ সামাজিক দলিল হিসেবে গুরুত্ব:
    ২ ধর্ম ও দর্শনতত্ত্বের পরিচয়বহ দিক:
    ৩ চর্যার ভাষাতাত্ত্বিক গুরুত্বের দিক:
    ৪ সাহিত্যিক তাৎপর্যের দিক:

------------------------------------------------

১. উদ্দেশ্য

  বাংলা সাহিত্যের আদিযুগের প্রামাণ্য নিদর্শন চর্যাপদ সম্পর্কে অবহিত করাই এই আলোচনার মূল উদ্দেশ্য।

  যে-কোনো যুগের সাহিত্যই রচিত হয়, সেই যুগের সমাজ ও তার চাহিদার ওপর ভিত্তি করে। স্বাভাবিকভাবেই এই যুগ, তাদের ওঠাপড়া, তাদের জীবনচর্যা ও তাদের সংস্কার-বিশ্বাস সমস্তটাই কোনো না কোনো ভাবে উঠে এসেছে এইযুগের প্রতিনিধিস্থানীয় এই সাহিত্যকীর্তির মধ্যে।

এরই সঙ্গে জুড়ে আছে সেকালের সাহিত্য ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বাংলা ভাষার প্রসঙ্গটিও। প্রারম্ভিক যুগ থেকে বাংলা ভাষার বিবর্তনের গতিপ্রকৃতিও লক্ষ করা যায় এই রচনার মাধ্যমে। এই রচনার মাধ্যমে বাংলা ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক ও রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে তুলে আনা হয়েছে।

  চর্যাপদের জন্ম বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের হাতে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের সাধনপদ্ধতির গূঢ় নিয়মাবলি ও পদ্ধতিসমূহ উঠে এসেছে চর্যাপদের পদগুলিতে। তেমনি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের ভাব জগতের ও আধ্যাত্মিক জগতের প্রতিচ্ছবি হিসেবেও এগুলি অবশ্যই মূল্যবান সম্পদ হিসেবেই বিবেচিত হবে।

 

২. চর্যাগীতির আবিষ্কার ও প্রকাশ:

   চর্যাগীতির আবিষ্কার বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বাংলা ভাষায় প্রথম কবিতা সংকলন হল চর্যাপদ। নবম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে সহজিয়া বৌদ্ধদের এই সাধনসঙ্গীত রচিত হয়েছিলো। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এই অমূল্য নিদর্শন আবিষ্কৃত হয় বাংলার বাইরে রক্ষিত নেপালে রাজার গ্রন্থাগার থেকে। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপালে গিয়ে কিছু পুঁথি আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কৃত পুঁথিগুলি হল 'চর্য্যাচর্যবিনিশ্চয়', সরহপাদের দোহা, ডাকার্ণবএবং কৃষ্ণাচার্যের দোহা । এই চারখানি পুঁথি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বাংলা ১৩২৩ সনে, ইংরেজি ১৯১৬ সালে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’ থেকে "হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা" প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থ প্রকাশের পর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহাসিক উপাদানগুলি সর্বসমক্ষে চলে আসে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ৪৬টি সম্পূর্ণ পদ এবং একটি পদের অংশ পেয়েছিলেন। মাঝখানের কয়েকটি পাতা ছেঁড়া ছিল। পরবর্তীতে প্রবোধচন্দ্র বাগচী চর্যাপদের তিব্বতী অনুবাদ আবিষ্কার করেন। সেখানে দেখা যায় মূলগীতি সংগ্রহের নাম ছিল 'চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'।

রচনাকাল:

   ১৯১৬ সালে "হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা" প্রকাশের পর চর্যাগীতিগুলির সঠিক রচনাকাল নির্ণয়ের কিছু অসুবিধা দেখা দেয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এগুলিকে 'হাজার বছরের পুরাণ' বলে চিহ্নিত করেছেন। ড. মহম্মদ শহীদুল্লাহ রচনার প্রথম প্রান্তটিকে সপ্তম-অষ্টম শতক পর্যন্ত রাখতে চান। কিন্তু চর্যাগানের কয়েকজন কবির আবির্ভাবকালের অনুমান-সূত্র অবলম্বনে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও প্রবোধচন্দ্র বাগচীর মতে চর্যাগানের সম্ভাব্য রচনাকাল দশম-দ্বাদশ শতাব্দী। আচার্য সুকুমার সেনও এই সময়কালকে চিহ্নিত করেছেন। ভাষাবিচার ও কবিদের আবির্ভাবকাল ছাড়া ও আরও দুই-একটি পরোক্ষ প্রমাণের কথা বলেছেন ড. নির্মল দাশ। তিনি গানের বিষয়বস্তু ও ধর্মীয় ভিত্তি এবং গানের গঠনপদ্ধতি ও গায়নরীতি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন চর্যাগানের রচনাকালের ঊর্ধ্বতম সীমা অষ্টম শতাব্দী এবং নিম্নতম সীমা দ্বাদশ শতাব্দী।  

 


চর্যার কবি-

চর্যাপদের অধিকাংশ গানে কবিদের নামাঙ্কিত ভণিতা আছে। মূল গানে ও টীকায় পদকর্তাদের নাম যেভাবে উল্লিখিত হয়েছে তাতে মোট ২৪ জন কবির সন্ধান পাওয়া যায়(অনুমান করা হয় ৮৪ জন)। লুইপাদ (পদ সংখ্যা ২), কুকুরীপাদ (পদ সংখ্যা ৩), চাটিলপাদ (পদ সংখ্যা ১), ভুসুকুপাদ (পদ সংখ্যা ৮), কাহ্নপাদ (পদসংখ্যা ১৩), সরহপাদ (পদসংখ্যা ৪) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের দার্শনিক প্রত্যয়, কাম্যবস্তু, সাধনপদ্ধতির কথা জীবনের পরিচিত বস্তুর রূপকে ব্যক্ত করেছেন।

 

৩ চর্যাগীতির ভাষা-প্রসঙ্গ

চর্যাপদের ভাষা নিয়ে বিভিন্ন প্রদেশবাসীরা বিভিন্ন দাবি তুলেছেন। দাবিদার ভাষাগুলি হল- হিন্দি, ওড়িয়া, মৈথিলী, অসমীয়া এবং বাংলা। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর Origin and Development of Bengali Language গ্রন্থে কবিতাগুলির ভাষা যে বাংলা তা প্রমাণ করেছেন। অধ্যাপক নির্মল দাশ চর্যাগানগুলির ভাষাকে প্রত্ন-বঙ্গীয় (Proto Bengali) ভাষা রূপে চিহ্নিত করেছেন। চর্যাপদের ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল- ১) -এর, অর বিভক্তি দ্বারা সম্বন্ধ পদের সৃষ্টি। ২) -ত, -তে বিভক্তি দিয়ে অধিকরণের অর্থ প্রকাশ। ৩) মাঝ, অন্তর ইত্যাদি অনুসর্গের ব্যবহার। ৪) -ইল যোগে অতীতকালের ক্রিয়াপদ গঠন এবং-ইব যোগে ভবিষ্যৎকালের ক্রিয়াপদ গঠন। ৫) বাংলা ভাষার নিজস্ব ইডিয়ম প্রয়োগ। ভাষাগত সুস্পষ্ট প্রমাণ ছাড়া চর্যাগানে নদীমাতৃক বাংলাদেশের অপরূপ রূপ ধরা পড়েছে। চর্যাপদ যে বাঙালির সম্পদ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

 

সন্ধ্যাভাষা প্রসঙ্গ-

চর্যাগীতির মূল বিষয় বৌদ্ধতান্ত্রিক সহজিয়া সাধকদের আধ্যাত্মতত্ত্ব। এই গানগুলির মূল উপজীব্য ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব বিষয়ে বিভিন্ন নির্দেশন দান। সহজসাধনা গুহ্যসাধনা বলে এই তত্ত্ব-উপদেশ সর্বজনবোধ্য ভাষায় দেওয়া হয়নি। আসল বক্তব্যকে ভিন্ন অর্থবহ শব্দের সাহায্যে প্রহেলিকাময় করে তোলা হয়েছে। ফলে চর্যার ভাষায় প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে দুটি করে অর্থ বর্তমান। একটি অর্থবাহ্য, অপর অর্থ গূঢ় ও পারিভাষিক। 'সন্ধ্যা' শব্দের বানান, ব্যুৎপত্তি ও অর্থ নিয়ে অবশ্য মতভেদ আছে। মহাযান শাস্ত্রে ও ভাষ্যে এমনকি মুনি দত্তের টীকায় 'সন্ধ্যা' বানান ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু বিধুশেখর শাস্ত্রীর মতে শব্দটির বানান 'সন্ধা' (সমধা ধাতু থেকে এই শব্দের উৎপত্তি)। এর অর্থ যে ভাষায় বা শব্দে অর্থ সম্যক রূপে নিহিত আছে। অর্থাৎ সাংকেতিক ভাষা। প্রবোধচন্দ্র বাগচী এই ব্যাখ্যা সমর্থন করেছেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবার এর অর্থ করেছেন, “আলো-আঁধারির ভাষা, কতক আলো, কতক অন্ধকার। খানিক বুঝা যায়, খানিক বুঝা যায় না।”আবার অনেক সমালোচক 'সন্ধ্যা' বানানটি অক্ষুণ্ণ রেখেএর অর্থ করেছেন- 'যে ভাষা অভীষ্ট অর্থ সম্যক ধ্যান (সমধ্যৈ) যোগে বুঝতে হয়।' আসলে সন্ধ্যাভাষা নিঃসন্দেহে নিহিতার্থক ভাষা যার ভিতরে একটি প্রচ্ছন্ন অর্থ আছে।

 

চর্যাগীতির গুরুত্ব-

   মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত ও তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত 'চর্য্যাচর্যবিনিশ্চয়' গ্রন্থখানি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ, তাৎপর্যপূর্ণ, উল্লেখযোগ্য সম্পদ। এই গুরুত্ব ও তাৎপর্য ঐতিহাসিক। গ্রন্থটির ঐতিহাসিক গুরুত্বকে কয়েকটি মাত্রায় ধরা যেতে পারে। যেমন-

১) সামাজিক দলিল মূল্যের দিক।

২) বিশেষ ধর্ম ও দর্শনতত্ত্বের পরিচয়বহ দিক।

৩) সাহিত্য তথা কাব্যগত তাৎপর্যের দিক।

৪) ভাষাতাত্ত্বিক গুরুত্বের দিক।

 

১. সামাজিক দলিল হিসেবে গুরুত্ব

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সম্পাদিত গ্রন্থটির ঐতিহাসিক গুরুত্বের প্রধানতম দিকটি হল তার সামাজিক দলিল মূল্যের দিক। এক বিশেষ সময়ের বঙ্গদেশের সমাজ-ইতিহাসটি এই গ্রন্থের নানাপদে ভিন্ন ভিন্ন রূপকে-সংকেতের মাধ্যমে বিধৃত আছে। সেই সময়ের শবর, চণ্ডাল, ডোম- ইত্যাদি অজস্র মানুষের জীবন চর্যা, সেইসঙ্গে তৎকালের ধনীশ্রেণির জীবন-যাপনের আভাস নানা পদে প্রকাশিত। মানুষের খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের চিত্রে দেখি ভাত ছিল সেই সময়ের প্রধান খাদ্য। লাউ (১৭), মাছ-মাংস (৬), তেঁতুল, দুধ (৩৩), মধু ও তাদের খাদ্য ছিল। বাসস্থানের চিত্রে দেখি ধনী-দরিদ্র ভেদে কুঁড়েঘর কিংবা দু-মহলা তিনমহলা ঘরে মানুষ বাস করত। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে 'টালত মোর ঘর নাহি পরবেষী।/হাড়ীত ভাত নাঁহি নিতি আবেশী'- আর্থিকভাবে অসচ্ছল মানুষের জীবনযাপনের উল্লেখ যেমন আছে তেমনি ধনী-ব্যবসায়ীরা ও সেকালে আসর জমাত (৮, ৪৯) সে কথাও বর্ণিত হয়েছে। এই গ্রন্থ থেকে তৎকালের বিবাহ (১৯), শিকার (৬২৩), দাবাখেলা (৯), নাটকাভিনয় (১৭) ইত্যাদি উৎসবানুষ্ঠানের পরিচয় আমরা জানতে পারি। শুধু তাই নয়, তৎকালের আচার-প্রথা, প্রেম-দাম্পত্য (২০) ইত্যাদি যাপন পদ্ধতিটিও মূর্ত আছে এখানে। এই গ্রন্থ পাঠে জানা যায় তৎকালের নদীমাতৃক বঙ্গদেশের (৫), পর্বত ও অরণ্যাশ্রিত (২৮,৬) বঙ্গদেশের পরিচয়টি। অর্থাৎ এক বিশেষ সময়কালের বঙ্গদেশের ব্যক্তি, পারিবারিক ও সামাজিক ব্যবস্থার ইতিহাসটিকে বক্ষে ধারণ করে 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়' বিশেষ গুরুত্ববাহী হয়ে আছে।

২. ধর্ম ও দর্শনতত্ত্বের পরিচয়বহ দিক

একদা বঙ্গদেশে বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনের ব্যাপক প্রচলন ও প্রভাব যে ছিল তার ইঙ্গিত ও পরিচয়টিকে মূর্ত করে হরপ্রসাদ সম্পাদিত বইটি ঐতিহাসিক তাৎপর্যে মণ্ডিত। আবার চর্যাসাধকদের সাধনপদ্ধতি ও সাধনতত্ত্বের উত্তরাধিকার বহন করছে পরবর্তীকালের নাথপন্থী সাধকেরা, আউল-বাউল সাধকেরা এবং শাক্তসাধকেরা। চর্যাসাধনার মূলকথা হল দেহমুক্তির সাধনা। সেখানে বলা হয়েছে মানবদেহের চারটি চক্র বর্তমান - সম্ভোগচক্র, ধর্মচক্র, কাঠচক্র, মহাসুখচক্র। সাধকেরা চক্রের পর চক্রের আবর্তনকে জয় করে মস্তিষ্কে অবস্থিত মহাসুখচক্রে পৌঁছাতে পারলে সিদ্ধিলাভ করত। নাথপন্থী সাধনাও প্রায় একইরকম সাধনপদ্ধতিতে অনুসৃত হতো। এইমতে নাভিতে বর্তমান থাকে অমৃতবিন্দু। সেই অমৃতবিন্দুকে ঊর্ধ্বমুখে প্রবাহিত করে মস্তিস্কে

 

অবস্থিত পূর্ণশক্তিতে তুলতে পারলেই সাধক সিদ্ধি লাভ করত। বাংলাদেশের আউল বাউল সাধনায় বলা হয়েছে দেহে আছে ষড়চক্র। এখানেও একটার পর একটা চক্র অতিক্রম করে মাথাতে অবস্থিত পরমাশক্তিকে জাগিয়ে সিদ্ধি লাভের কথা বলা হয়েছে। শাক্তপদাবলিতে দেখি মেরুদণ্ডের নীচে অবস্থিত কুলুকুণ্ডলিনী শক্তি উপরে প্রবাহিত করে মস্তিষ্কের অবস্থানের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ধর্মসাধনার ক্ষেত্রে চর্যাপদে কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত করে দেহকে সহজানন্দে নির্বাণের যে কথা বলা হয়েছে তাই পরবর্তীকালের বিভিন্ন সাধকসম্প্রদায়ের মধ্যে একটু ভিন্নমাত্রায় বিবর্তিত হয়েছে। ফলে এইসমস্ত সাধনপদ্ধতিকে অবলম্বন করে যে সাহিত্যধারা পরবর্তীকালে গড়ে উঠেছে তার উপর অবশ্যম্ভাবী রূপে চর্যাপদের প্রভাব পড়েছে।

নাথপন্থী ও গোরক্ষপন্থী সাধকেরা চর্যাসাধনার ঐতিহ্য অনুসারী। চর্যাগীতির চন্দ্র-সূর্য, গঙ্গা-যমুনা, দেহ-নগরী প্রভৃতি রূপক নাথপন্থীর উপর চর্যাগীতির গুরুত্বকে তুলে ধরে। সদগুরু অথবা পরমগুরু বোঝাতে 'নাথ' কথাটি চর্যাগানে এবং দোহাকোষে আছে।

চর্যাপদের প্রভাব বৈষ্ণব মরমীয়া সহজসাধকদের মধ্যেও রয়েছে। চর্যাগীতির একটি প্রায় অখণ্ড অংশ অষ্টাদশ শতাব্দীতে কবিদের ভাবনায় পাওয়া গেছে। কায়-বৃক্ষ, গুরু-কাণ্ডারী ইত্যাদি রূপক বৈষ্ণবপদাবলীতে পুনরায় বর্ণিত হয়েছে। আবার ধর্মঠাকুরের গাজনের ছড়াতেও চর্যাগানের প্রভাব আছে। চর্যার প্রভাব বাউলগানেও পড়েছে। বিশেষ রমণীকে সামনে রেখে যে বাউল সাধনা তা চর্যাপদে আভাসিত ছিল। বাউল সাধনার পাশাপাশি আউল সাধনায় তথা ফকিরী সাধনায় চর্যাপদের কায়সাধনার ইঙ্গিতটিও বিকশিত। বৈষ্ণবপদের কীর্তনগানের পদ্ধতিটি চর্যা থেকে নেওয়া। কীর্তন শুরু করেন চৈতন্যদেব নবদ্বীপে শ্রীরামের বাড়িতে দ্বার রুদ্ধ করে। এভাবে যোগপন্থী চর্যাসাধকরা চর্যা ও বজ্রগীতি গেয়ে মণ্ডল উপাসনা করতেন। অতএব এই আত্মিকগত বিচারেও বাংলা সাহিত্যে চর্যার গুরুত্ব অপরিসীম।

৩. চর্যার ভাষাতাত্ত্বিক গুরুত্বের দিক

বাংলা ভাষার জন্ম ইতিহাসের নিরিখে 'চর্য্যাচর্যবিনিশ্চয়'-এর ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। বৈদিক ভাষা, প্রাকৃত ভাষা, অপভ্রংশ ভাষার স্তর পেরিয়ে নব্যভারতীয় আর্যভাষা রূপে বাংলা ভাষার যে বিবর্তন-সূত্র তা চর্যাপদের মাধ্যমে ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে। আমরা বলতে পারি, বাংলা ভাষার ইতিহাসের প্রত্নতাত্ত্বিক মহিমায় উদ্ভাসিত 'চর্য্যাচর্যবিনিশ্চয়' বাংলা ভাষার কৌলিন্যকে বহন করে তা তাৎপর্যমণ্ডিত। সেই যুগের ভাষা বৈশিষ্ট্য ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে ভাষার ইতিহাস রচনায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

চর্যাপদের ভাষা বৈশিষ্ট্য:

ক) প্রাকৃত স্তরে সমীভূত যুক্ত ব্যঞ্জনের সরলীকরণ এবং পূর্ববর্তী হ্রস্বস্বরের ক্ষতিপূরণমূলক দীর্ঘতা, যা বাংলা ভাষার সাধারণ প্রবণতা তার নিদর্শন চর্যার ভাষায় মেলে।

যথা: জন্ম > জন্ম > জাম।

কর্ম > কম্ম > কাম।

উদা- 'জামে কাম কি কামে জাম।' (২২)

খ) অর্ধতৎসম শব্দে যুক্ত ও যুগ্ম ব্যঞ্জন কোথাও রয়ে গেছে। যেমন- মিথ্যা > মিচ্ছা

গ) শব্দরূপে ও ধাতুরূপে বাংলা ভাষার বিশিষ্ট বিভক্তি মিলেছে:

১) তৃতীয়াতে -তেঁ/-তে। উদা-'সুখ দুখেতে নিশ্চিত মরি অই'।

২) সপ্তমীতে-ত/-তে। উদা- 'হাড়ীত ভাত নাহি'।

উত্তমপুরুষ ও মধ্যমপুরুষে আমাহে, অক্ষে এবং তুহ্মে ব্যবহৃত হতো।

ঘ) চর্যায় মধ্যবাংলা সুলভ দু'একটি উদাহরণ মেলে, যথা অপিহিনিহিতির উদাহরণ মেলে না, তবে স্বরসঙ্গতির সুসুরা (টীকা য়সসুরা শ্বশুর), ঘিনি / ঘিনেলি ইত্যাদি।

৬) প্রাকৃত/অপভ্রংশের তুলনায় চর্যাপদে তৎসম শব্দের বহুল প্রয়োগ দেখা যায়। বস্তুত আধুনিক বাংলায় সংস্কৃত শব্দের যে প্রাচুর্য দেখি চর্যাপদেই তার প্রথম সূত্রপাত।

চ) চর্যাপদে এমন কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য প্রয়োগের কথা বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন যা বাংলা ছাড়া অন্যান্য ভারতীয় আর্যভাষায় পাওয়া যায় না। যেমন গুনিয়ালেই (গুণে নিই), দুহিল দুধু (দোয়া দুধ) ইত্যাদি।

বস্তুত দশম-দ্বাদশ শতাব্দীর বাংলা ভাষার এই শৈশবাবস্থা চর্যাপদ থেকেই জানা যায়। তাই এর গুরুত্ব ভাষাতত্ত্বে অসীম।

৪. সাহিত্যিক তাৎপর্যের দিক:

চর্যাপদে ধর্মতত্ত্ব ও সাধন প্রণালীর বর্ণনা প্রধান হলেও তার মধ্য দিয়ে সাহিত্যধর্ম তথা কাব্যগত তাৎপর্যের দিকটি নানা দৃষ্টিকোণ থেকে ধরা পড়ে। আমরা জানি, কাব্যবিচারের মূলত দুটি দিক: ১) কাব্যের ভাবরসের দিক এবং ২) প্রকাশভঙ্গির চারুত্বের দিক। বাংলা ভাষার আদি রচনাকীর্তি চর্যাগীতি পদাবলির অধিকাংশ পদই এই শর্তদুটি পূরণ করে কাব্য মহিমায় রসোত্তীর্ণ হয়েছে। চর্যাপদের কাব্যমূল্য নিম্নলিখিত দিক থেকে ধরা যায়।

    ১) কাব্যনির্মাণের প্রথম ও প্রধান কথা হল রসাবেদনের ক্ষেত্রে তার ব্যঞ্জনাধর্মিতা। চর্যাপদের অনেকগুলি পদই এই ব্যঞ্জনার গুণে বড় হয়ে উঠেছে। উদাহরণ হিসাবে ভুসুকুপাদ রচিত ৪১ এবং ৪৩ সংখ্যক পদ, শবরপাদের ২৮ এবং ৫০ নম্বর পদের কথা স্মরণ করা যায়। ভুসুকুপাদের ৬ নং পদটিতে ব্যাধের দ্বারা আক্রান্ত হরিণ ও তার সঙ্গিনীর বিরহকাতর অবস্থার চিত্র যথেষ্ট ব্যঞ্জনাময় ও ধ্বনিমাধুর্যে ভরপুর-

'তিণ ন স্তূপই হরিণা পিবই ন পাণী।

হরিণা হরিণির নিলঅ ণ জাণী।।'

কেন না শুধু হরিণ-হরিণী নয়, মানুষের কথাও বেরিয়ে পড়ে ব্যঞ্জনা গুণে।

    ২) কাব্য-কবিতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রোমান্টিকতা ও মায়া-মোহ-মমতা। চর্যাপদের ৫০ নম্বর কবিতা সেই বৈশিষ্ট্যে ভরপুর। উচ্চ পর্বতশৃঙ্গে শবর-দম্পতির মিলনকুঞ্জের একটি জ্যোৎস্না রাতের চিত্র এখানে অঙ্কিত। এইপদে রোমান্টিক পরিবেশনের-নারীর জীবনে মিলনকামনার চিত্র অঙ্কনের মধ্য দিয়ে রোমান্টিকতা ও মায়া-স্নেহ-মমতা ফুটে উঠেছে।





    ৩) যে-কোনো শ্রেষ্ঠ কবিতার মধ্যে থাকে কবিদের রূপমুগ্ধতার স্পর্শ। সেইসঙ্গে সেখানে থাকে গীতিময়তার মেজাজ এবং ভাবানুভূতির উদ্দামতা। ২৮ নং পদের একটি পদে ব্যঞ্জনাধর্মিতার এই বৈশিষ্ট্য অনবদ্যভাবে ও রূপে প্রকাশিত।

"উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী।

মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গিবত গুঞ্জরী মালী।।

উমত সবরো পাগল শবরো মা কর গুলী গুহাড়া তোহৌরী।

নিঅ ঘরিণী নামে সহজ সুন্দারী"।।

পঙক্তিগুলির মধ্য দিয়ে কবির সুগভীর রূপানুরাগ ও বর্ণবিলাস লক্ষণীয়।

৪) কোনো বিষয়ের কাব্য হয়ে ওঠার বড় শর্ত তার মণ্ডনকলার নির্মাণ মাধুর্য। সেদিক দিয়ে চর্যাগীতিগুলির কাব্যমূল্য অনস্বীকার্য। ভাষার মেলবন্ধনে, অলঙ্কারের মাধুর্যে এবং চিত্রকল্পের নিপুণ গাঁথুনিতে চর্যাপদ কবিতার মর্মকেন্দ্রে পৌঁছে যায়।

(১) স্তবক : ক) ভবণই গহণ গম্ভীর বেগে বাহী।

            খ) কাআ তরুবর পঞ্চবি ডাল।

(২) চিত্রকলা: "টালত মোর ঘর নাহি পড়িবেষী।

              হাড়ীত ভাত নাঁহি নিতি আবেশী।।"

চর্যাপদগুলি বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্মাদর্শ, নিগূঢ় দর্শনতত্ত্ব ও ধর্মসাধনার পরিচয়বাহী হলেও অন্তরঙ্গ ভাবমেজাজে এগুলি অসাধারণ কাব্যরূপ লাভ করেছে। এর পিছনে রয়েছে চর্যাসাধকদের চেতনাবোধ এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রূপকধর্ম ও প্রতীকধর্মের বৈশিষ্ট্য যা উচ্চাঙ্গের কাব্যধর্মে সমুজ্জ্বল। সেই সঙ্গে নিতান্ত সাধারণ মানুষের জীবনলীলা চিত্রণে, তাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, স্বপ্ন-কল্পনার রূপায়ণে কবিরা যে নিত্য সত্যের পরিচয়কে চর্যাপদে তুলে ধরেছেন তা যে-কোনো মহৎ কাব্যেরই বিশিষ্ট উপাদান।

=================================================================

Dr.Nilotpal Jana

Mahishadal Girls’ College

Dept.of Bengali

কোন মন্তব্য নেই

ok

4x6 থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.