গল্পকার সমরেশ বসু : ড. নীলোৎপল জানা
গল্পকার সমরেশ বসু
সমরেশ
বসু (১৯২৪-১৯৮৮) বাংলা কথাসাহিত্যে এক অতিপরিচিত নাম। ঔপন্যাসিক রূপেই তিনি ছিলেন সমধিক
পরিচিত, তথাপি তিনি ছোটোগল্পকার রূপে ছিলেন এক অনন্য জীবনশিল্পী। পঞ্চাশের দশকে 'আদাব'এর
মতো ছোটোগল্পের রচনা দিয়েই তাঁর সাহিত্য-জীবনের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৪৬-১৯৮৮ এই বিয়াল্লিশ
বছর তিনি সাহিত্যসৃষ্টির নিরলস সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন। চারপাশের বাস্তব ও অতিবাস্তব জগতকে
তিনি মেধা ও হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিলেন। ভাষা-শব্দের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিন্যাসে, বাস্তব-কল্পনার
আলোছায়ায় তাঁর কথা বিশ্ব মননদীপ্ত প্রতিবেদন রচনা করে। সমরেশ-কালকূট-ভ্রমণ তিনটি পৃথক
সত্তা পরস্পরের সম্পৃক্ত হয়ে তাঁর লেখক সত্তার পূর্ণ বৃত্ত নির্মাণ করে দেয়।
'অমৃত কুম্ভের সন্ধানে' (১৯৫৪) লিখে কালকূট রূপে তাঁর অনন্য আবির্ভাব ঘোষণা করেছিলেন। জীবনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংগ্রামে বিপর্যস্ত সমরেশ কালকূটেই পেয়েছিলেন পরম সিদ্ধি। এক সমরেশের মধ্যে বহু সমরেশের উপস্থিতি, স্ববিরোধিতা, আত্মদ্বন্দ্ব নিয়েই গড়ে ওঠে তাঁর কথনবিশ্ব। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, কারাবাস, পরবর্তীতে মতবিরোধ, একাকীত্ব দুঃখ ও যন্ত্রণার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ তাঁকে অবিরত খনন করে গেছে। এছাড়া এইসঙ্গে যুক্ত হয় দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ, যুদ্ধোত্তর সংকট, দেশবিভাগের মতো বিষয়গুলি। অনর্গল আত্মমন্থন ও 'মানুষকে জানার' অদম্য কৌতূহলে তিনি নিজস্ব নন্দনবোধ গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর গল্পে একমুখী বক্তব্যের তাগিদ লক্ষ্য করা যায়। তিনি বক্তব্য-বিষয়কে কোলাজের মতো ছোটো ছোটো ফ্রেমে তুলে ধরেছিলেন। তাঁর গল্পস্বভাবের প্রধান গুণ, গল্পের ভিতরকার অতৃপ্তির অস্থিরতা এক কাহিনি থেকে আর এক কাহিনির সদরে টেনে নিয়ে যায় পাঠককে। আর এই সূত্রেই স্তরে স্তরে উন্মোচিত হয় মানুষের ভিতর ও বাইরের নানান রূপ।
সমরেশ
ও কালকূটের যুগলবন্দীতে, উপস্থাপিত বিষয়ের অন্তদীপ্তিতে গল্পবিশ্ব উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
তিনি মাটি ও মানুষের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে বিচিত্র স্তরের মানুষকে
পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। মধ্যবিত্ত জীবনের নানা সমস্যায়, আশা-আশাভঙ্গের যন্ত্রণায়, সম্পর্কের
রিক্ততায় পুঞ্জীভূত অন্ধকারের যে মেঘ জমেছিল সমকালের আকাশে সেখানে তিনি আলোর দীপ্তি
লক্ষ্য করেন। তাঁর 'বিনিময়', 'বিকেলে শোনা', 'উত্তাপ', 'পাহাড়ি ঢল', 'যৌবন' ইত্যাদি
গল্পে মধ্যবিত্তের অস্তিত্বসংকট, প্রেম-প্রেমহীনতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের চিত্র অঙ্কিত।
আবার 'আবর্ত', 'রঙ', 'আসামী', 'প্রত্যাবর্তন', 'উজান', 'সহযাত্রী', 'লড়াই', 'পয়স্বিনী'র
মতো গল্পে শ্রমজীবী মানুষের নিরন্তর লড়াইয়ের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে। এই গল্পের কথাবস্তুকে
ঘিরে রয়েছে যেমন জীবনযন্ত্রণার ছবি তেমনি মানবিক চেতনার নান্দনিক পরিধিও। 'ফকির',
'আটাত্তর দিন পরে', 'শুভ বিবাহ', 'দুলে বাড়ির ভাত', 'উৎপাত', 'প্রাণ- পিপাসা', 'মানুষ
রতন', 'আলোর বৃত্তে' প্রভৃতি গল্পে অর্থনীতিলাঞ্ছিত বৈষম্য, পেটের জ্বালায় বিপথগামী
হওয়া, মনুষ্যত্ব বোধকে বিক্রি করে দেওয়ার মতো ঘটনাকে একরৈখিক চিত্রে উপস্থাপিত করেছেন।
শৈশব-কৈশোরের পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা-স্মৃতি তাঁকে
চালিত করেছে জীবনের গল্প রচনায়। তাই তাঁর প্রতিটি বয়ানে পরস্পরের সঙ্গে সূক্ষ্মভাবে
সংযুক্ত হয়েছে জীবনানুভব, সহজ-সরল ভাষার গাঢ় উপলব্ধি, মানবিকচৈতন্যের ক্রমিক বিস্তার
ও দীর্ঘ সংগ্রামের সুনিশ্চিত প্রমাণ। তাই 'আদাব'এর ভাবনাকে অনুসরণ করে আমরা বুঝে নিই,
আমরা এখনো সাম্প্রদায়িকতার ধ্বংসস্তূপে নিমজ্জিত হয়ে আছি। ভ্রাতৃহত্যার সন্ত্রাস আজও
প্রতিদিন আচ্ছন্ন করছে আমাদের। তাই একথা স্বীকার করে নিয়ে বলতে হয়, সমরেশ বসুর কথনবিশ্বের
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষের পৃথিবীকে, তার যুদ্ধক্ষেত্রকে, প্রত্যাঘাতের আয়ুধকে, জীবনের
সত্যদর্শনকে নতুন করে পুনরাবিষ্কার করা সম্ভব।
১২ মার্চ ১৯৮৮ সমরেশ বসু মারা যান।কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় সমরেশ বসুর ভক্ত ছিলেন। সমরেশ বসুর প্রয়াণের পর তিনি একটি কবিতা লেখেন -
"দেখি নাই ফিরে"। তাতে শক্তি লিখেছেন -
''রাজকীয়
মর্জি ছিল চরিত্রে তোমার। যাবার সময়ও তুমি গেছ সেই ভাবে।''
কোন মন্তব্য নেই
ok