শব্দভাণ্ডার: ড. নীলোৎপল জানা
শব্দভাণ্ডার
ভাষার সম্মান নির্ভর করে তার
প্রকাশক্ষমতার উপরে। যে ভাষার যত বিচিত্র ভাব এবং যত গভীর
অনুভূতি প্রকাশ করতে সক্ষম সে ভাষা তত উন্নত। ভাষার এই প্রকাশক্ষমতার মূল আধার হল
ভাষার শব্দসম্পদ। এটি তিনভাবে সমৃদ্ধ হয় ১)উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত প্রাচীন শব্দের সাহায্যে, ২)অন্য ভাষা থেকে গৃহীত কৃতঋণ শব্দের
সাহায্যে ৩)নতুন সৃষ্ট শব্দের সাহায্যে। বাংলা ভাষারও শব্দভাণ্ডার এই তিনটি উপায়ে বাংলা
ভাষার শব্দভাণ্ডারকে উৎসগত বিচারে আমরা তিনটি ভাগে ভাগ করতে পারি –
১) মৌলিক বা নিজস্ব,
২) আগন্তুক বা কৃতঋণ শব্দ, এবং
৩) নবগঠিত শব্দ
মৃদ্ধ হয়েছে।
১) মৌলিক বা নিজস্ব
শব্দ
যেসব শব্দ প্রাচীন ভারতীয়
আর্যভাষা [ বৈদিক ও সংস্কৃত ] থেকে উত্তরাধিকার-সূত্রে বাংলায় এসেছে সেগুলোকে
মৌলিক শব্দ বলা হয়। যেমন-সূর্য, মিত্র, জীবন, মৃত্যু,
বৃক্ষ,
মৌলিক শব্দগুলিকে চার ভাগে ভাগ করে
আলোচনা করা যায়। যথা –
ক) তৎসম শব্দ, খ) অর্ধতৎসম শব্দ গ) তদ্ভব শব্দ
ক)তৎসম শব্দ
যেসব শব্দ সংস্কৃত থেকে অপরিবর্তিতভাবে বাংলায় এসেছে
সেগুলোকে তৎসম শব্দ বলা হয়।
তৎ= সংস্কৃত, সম=সমান অর্থাৎ তৎসম কথাটির অর্থ সংস্কৃতের সমান।
যেমন – জল, বায়ু, কৃষ্ণ,
সূর্য, মিত্র, জীবন,
মৃত্যু, বৃক্ষ, লতা,
নারী, পুরুষ ইত্যাদি।
তৎসম শব্দগুলোকে
আবার দুটো ভাগে ভাগ করা যায় – সিদ্ধ তৎসম ও অসিদ্ধ তৎসম।
সিদ্ধ
তৎসম
যে সব শব্দ বৈদিক ও সংস্কৃত সাহিত্যে পাওয়া যায় এবং যে-গুলো
ব্যাকরণ-সিদ্ধ সেগুলো হলো সিদ্ধ তৎসম।
যেমন – সূর্য, মিত্র, নর, লতা ইত্যাদি।
অসিদ্ধ
তৎসম
যেসব শব্দ বৈদিক বা
সংস্কৃত সাহিত্যে পাওয়া যায় না ও সংস্কৃত ব্যাকরণসিদ্ধ নয় অথচ প্রাচীনকালে
মৌখিক সংস্কৃতে প্রচলিত ছিল, সেগুলোকে ডঃ
সুকুমার সেন অসিদ্ধ তৎসম শব্দ বলেছেন।
যেমন – কৃষাণ, চাল, ডাল [ বৃক্ষশাখা
] ইত্যাদি।
খ)অর্ধতৎসম
যেসব সংস্কৃত শব্দ বাংলায় এসে
বাঙালির উচ্চারণে কিছুটা পরিবর্তন ও বিকৃতি লাভ করেছে,সেগুলোকে অর্ধতৎসম বা ভগ্নতৎসম শব্দ বলা হয়।
যেমন –
অগ্রহায়ণ > অঘ্রান, অস্ত্র> অস্তর, ইচ্ছা> ইচ্ছে,
আধিক্যতা>আদিখ্যেতা, কীর্তন> কেত্তন, কৃষ্ণ > কেষ্ট ,
কবিরাজ >কোবরেজ
গ)তদ্ভব শব্দ
যেসব শব্দ সংস্কৃত থেকে সোজাসুজি
বাংলায় আসেনি, মধ্যবর্তী পর্বে প্রাকৃতের মাধ্যমে
পরিবর্তন লাভ করে বাংলায় এসেছে তাদের তদ্ভব শব্দ বলা হয়।
তৎ = সংস্কৃত, ভব=উৎপন্ন অর্থাৎ তদ্ভব কথাটির অর্থ সংস্কৃত থেকে উৎপন্ন।
কৃষ্ণ > কন্হ > কানু, ধর্ম > ধম্ম > ধাম
মৎস্য > মচ্ছ > মাছ
তদ্ভব শব্দকে দুটো ভাগে ভাগ করা
যায় – নিজস্ব ও কৃতঋণ তদ্ভব।
নিজস্ব তদ্ভব শব্দ
যেসব তদ্ভব শব্দ যথার্থই বৈদিক বা
সংস্কৃতের নিজস্ব শব্দের পরিবর্তনের ফলে এসেছে সেগুলোকে নিজস্ব তদ্ভব শব্দ বলা
হয়।
যেমন –ইন্দ্রাগার > ইন্দাআর > ইন্দারা, উপাধ্যায় > উবজঝাঅ >
ওঝা ইত্যাদি।
তদ্ভব শব্দকে দুটো ভাগে ভাগ করা
যায় – নিজস্ব ও কৃতঋণ তদ্ভব।
নিজস্ব তদ্ভব
যেসব তদ্ভব শব্দ যথার্থই বৈদিক বা
সংস্কৃতের নিজস্ব শব্দের পরিবর্তনের ফলে এসেছে সেগুলোকে নিজস্ব তদ্ভব শব্দ বলা
হয়।
যেমন –ইন্দ্রাগার > ইন্দাআর > ইন্দারা, উপাধ্যায় > উবজঝাঅ >
ওঝা ইত্যাদি।
যেসব শব্দ প্রথমে সংস্কৃত ভাষায়
ইন্দো-ইউরোপীয় বংশের অন্য ভাষা থেকে কৃতঋণ শব্দ হিসাবে এসেছিল এবং পরে প্রাকৃতের
মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে বাংলায় এসেছে সেসব শব্দকে কৃতঋণ তদ্ভব বা বিদেশী তদ্ভব
শব্দ বলা হয়।
যেমন – গ্রীক. দ্রাখমে > সং. দ্রম্য > প্রা. দম্ম > বাং. দাম।
২)
আগন্তুক বা কৃতঋণ শব্দ
যে সমস্ত শব্দ সংস্কৃতের নিজস্ব উৎস থেকে বা অন্য ভাষা থেকে সংস্কৃত হয়ে আসেনি, অন্য ভাষা থেকে সরাসরি বাংলায় এসেছে সেই শব্দগুলোকে আগন্তুক বা কৃতঋণ শব্দ বলা হয়। কৃতঋণ শব্দের অর্থ যা ধার নেওয়া হয়েছে।
তিন জাতীয় শব্দ এই শ্রেণিভুক্ত
১)দেশি
২)বিদেশী
৩)প্রাদেশিক
বঙ্গদেশের প্রাচীনতম অধিবাসী কোল, ভিল প্রভৃতি অনার্যজাতির ভাষা থেকে যেসব শব্দ বাংলা ভাষায়
এসেছে সেগুলোকে দেশি শব্দ বলে।
যেমন- অঢেল, কচি, কলা, কাতলা,কুলা, কুকুর, খড়, খেয়া, খোকা, খুকি, খাঁজ, গাদা, ঘাড়, ঘোড়া, চাল, চিংড়ি, ছানা, ঝাঁটা, ঝিঙে, ঝড়, ঝাড়, ঝিলিক, ডাক, ডোবা, ডাগর, ডাব, ডিঙি, ঢেঁকি, ঢেউ, ঢিল, ঢোল, তেঁতুল, মুড়ি , থোড়, পাল, পালটা, পাঁঠা, বাদুড়, ভিড়, ফিঙে, দোয়েল
বিদেশী শব্দ-
যেমন – ইংরেজি থেকে – স্কুল, কলেজ, কেয়ার, টেবিল, ফাইল, টিকিট, কোর্ট, লাট, < lord, সিনেমা, থিয়েটার, হোটেল, কমিটি ইত্যাদি।
জার্মান থেকে – জার, নাৎসী ইত্যাদি।
পোর্তুগীজ – আনারস, আলপিন, আলকাতরা, আলমারি,
পেয়ারা, পাউরুটি, জানালা,
বালতি, বোতাম ইত্যাদি।
স্পেনীয় – কমরেড ,ডেঙ্গু
ইতালীয় – কোম্পানী, গেজেট ইত্যাদি।
ওলন্দাজ – ইসকাবন, হরতন, রুইতন তুরুপ ইত্যাদি।
চিনা – চা, চিনি, লুচি, লিচু।
বর্মী – ঘুগনি, লুঙ্গি, ফুঙ্গি।
ফারসী – সরকার, দরবার, বিমা, আমীর, উজীর, ওমরাহ, বাদশা, খেতাব।
আরবী – আক্কেল, কেতাব, ফসল, মুহুরী, হজম, তামাসা, জিলা।
প্রাদেশিক শব্দ- যেসব শব্দ এদেশেরই অন্য ভাষা থেকে সরাসরি বাংলায় এসেছে সেই শব্দগুলোকে ভারতীয় বা প্রাদেশিক শব্দ বলে।
হিন্দি থেকে –
পয়লা, দোসরা, তেসরা, জোয়ার, ঝাণ্ডা, কুয়াশা, গুজব, ফের, থানা, লাগাতার, বাতাবরণ,
সেলাম, দোস্ত, ওস্তাদ্ ,মস্তান, ঘেরাও, জাঠা, খানা, কাহিনি প্রভৃতি।
গুজরাতি থেকে-
হরতাল, খাদি
পাঞ্জাবি থেকে - চাহিদা, শিখ
নবগঠিত শব্দ
নতুন করে গড়ে-ওঠা শব্দকে নবগঠিত শব্দ বলে।এই শ্রেণির শব্দগুলি নীচে আলোচনা
করা হল-
মিশ্র বা সংকর শব্দ :
একশ্রেণির শব্দের সঙ্গে অন্য শ্রেণির উপসর্গ
প্রত্যয় ইত্যাদির যোগে অথবা বিভিন্ন শ্রেণির শব্দের পারস্পরিক সংযোগে যেসব নতুন
শব্দ সৃষ্টি হয় তাকে মিশ্র শব্দ বলে।
যেমন – হেড [ ইং ] + পণ্ডিত [ বাং ] =
হেডপণ্ডিত।
মাস্টারমশাই, রেলগাড়ি, অফিসপাড়া
ফি [ ফারসী ] + বছর [ বাংলা ]= ফি-বছর।
অনূদিত শব্দ
অনুবাদের মাধ্যমে যেসব শব্দ বাংলা ভাষায়
এসেছে সেগুলিকে অনূদিত শব্দ বলে ।
যেমনঃ-
দূরদর্শন (Television ),
শ্বেতপত্র (White paper ),
কালোবাজার (Black market)
খণ্ডিত শব্দ
কোনো শব্দের বিশেষ অংশ বাদ দিয়ে উচ্চারণ
করলেও যদি অর্থের পরিবর্তন না হয় তবে তাকে খণ্ডিত শব্দ বলে। যেমনঃ-
এরোপ্লেন> প্লেন
মাইক্রোফোন> মাইক
রেফ্রিজারেটর> ফ্রিজ
জোড়কলম শব্দ
জোড়কলম শব্দ হচ্ছে একাধিক শব্দের বিভিন্ন
রূপমূল জুড়ে তৈরি এক নতুন রূপমূলের শব্দ। যেমন :
ধোঁয়া + কুয়াশা = ধোঁয়াশা
হাঁস+ সজারু = হাঁসজারু
বিরাট +অনুষ্কা = বিরুষ্কা
মুণ্ডমাল শব্দ
কোনো শব্দগুচ্ছের প্রত্যেক শব্দ থেকে প্রথম
ধ্বনিগুলি নিয়ে একটি শব্দ তৈরি হলে, তাকে বলে মুণ্ডমাল শব্দ
যেমন :-
পিপুফিশু (পিঠ পুড়ছে, ফিরে শুই)।
নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সমিতি = নি ব শি স
হেড মাস্টার = এইচ এম
ভেরি ইম্পর্টাণ্ট পার্সন = ভি আই পি
কোন মন্তব্য নেই
ok