বাংলা ব্রতে সমাজচিত্র: ড. নীলোৎপল জানা
বাংলা ব্রতে সমাজচিত্র
ড. নীলোৎপল জানা
"ব্রতের আলপনা" প্রবন্ধে নারীদের প্রতিবাদী
ভূমিকার কথা বলেছি।পুরুষতন্ত্রের ঘেরাটপ থেকে বেরোবার রাস্তা খুঁজতে যেন ব্রতের উদ্ভব
হয়েছে।এতে না আছে কোনো তন্ত্র-মন্ত্র না আছে কোনো শাস্ত্রীয় অনুশাসন বা পুরোহিতের
রক্ত চক্ষু। ব্রতগুলোর মধ্য দিয়ে নারী তাঁর নিজের কথা নিজের মতো করে বলার চেষ্টা করেছেন।
ব্রতের ছড়াগুলির দিকে তাকালে দেখা যায় এতে কোনো পারমার্থিক কামনা নয় নিছক তাৎক্ষণিক
কামনা চরিতার্থতায় নারীরা ব্যস্ত থাকেন। যেমন-ধন-সম্পদ, পুত্র, আরোগ্য কামনা ইত্যাদি
তাদের কন্ঠে ধ্বনিত হতে দেখা যায়।আর এই কামনাগুলির মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে তৎকালীন সমাজের
নানানচিত্র। এর কারণ হল সমাজের দর্পণই সাহিত্য।অবনীন্দ্রনাথ তাঁর "বাংলার ব্রত"গ্রন্থে
যে ছড়াগুলি তুলে ধরেছেন তাঁর মধ্য থেকে সমাজের নানান দিক তুলে ধরার চেষ্টা করব।
মনসামঙ্গল কাব্যে দেখা যায় চাঁদ সওদাগর বাণিজ্যে যেতেন অর্থাৎ নৌকা যাত্রার প্রসঙ্গ
আছে। "বাংলার ব্রত" গ্রন্থে 'ভাদুলি' ব্রতে নৌকা যাত্রার প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন,যেখানে নারীরা নিকট
আত্মীয়র মঙ্গল কামনা করেছেন যাতে তারা বাণিজ্য থেকে নিরাপদে ফিরে আসতে পারে।ব্রতটিতে
বলা আছে -
সাগর সাগর বন্দি
তোমার সঙ্গে সন্ধি
ভাই গেছেন বাণিজ্যে
বাপ গেছেন বাণিজ্যে
সোয়ামি গেছেন বাণিজ্যে
..................................
আস্তে আস্তে কুশল করবেন ভাদুলী মা।
.............................................
আসতে যেতে কুশল করবেন ভাদুলী মা।
বাংলার
ব্রত গ্রন্থের 'সেজুতি' ব্রতের ছড়া থেকে প্রাচীন কালের সতীন প্রথার প্রসঙ্গ জানা যায়।এক
সময় বাংলার মায়েরা বহু সতীর নিয়ে
কষ্টের সঙ্গে সংসার করতেন যা বর্তমানে আইনত দণ্ডনীয়। নারীরা বহু কষ্ট সহ্য করতে পারলেও
সতীনকে সহ্য করতে পারে না।স্বামীর ভাগ সে কাউকে দিতে চায় না। 'সেঁজুতি' ব্রতে দেখা
যায় সতীনের মৃত্যু কামনা প্রকাশ পেয়েছে এবং তাকে হত্যা করে পায়ে আলতা পরার প্রসঙ্গও
উঠে এসেছে –
পাখি পাখি পাখি
সতীন মাগি মরতে যাচ্ছে
ছাদে উঠে দেখি।
..................................
অসৎ কেটে বসত করি
সতীন কেটে আলতা পরি।
নারী মাত্রই সন্তান কামনায়
ব্রতী থাকেন।সন্তানের জন্ম দিতে না পারলে নারীকে লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা সহ্য করে সমাজে বেঁচে
থাকতে হত। বহু সন্তানের জননীকে সেকালে সৌভাগ্যবতী বলেও সম্মান করা হত।‘হরিচরণ’ ব্রতে
এমনই চিত্র ফুটে উঠতে দেখা যায়-
হয়ে পুত্র মরবে না
চক্ষের জল পড়বে না
স্বামীর কোলে পুত্র দোলে
মরন যেন হয় এক গলা জলে।
'পূর্ণিপুকুর' ব্রতেও তেমনি কামনা উচ্চারিত-
হয়ে পুত্র মরবে না
পৃথিবীতে ধরবে না।
নারী-পুরুষ অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর
একে অপরের উপর যেমন অধিকার থাকে তেমনি স্বামীর সম্পদের প্রতি স্ত্রীর অধিকার সর্বাগ্রে।
কিন্তু পুত্রের বা ভাইয়ের সম্পদের প্রতি কোনো অধিকার তেমন থাকে না। এমন ছবি লক্ষ্য
করা যায় তুঁষতুঁষলি ব্রতে -
তুঁষতুঁষলি কাঁধে ছাতি
বাপ-ভাইয়ের ধন লাতি পাতি
ভাইয়ের ধন লাসপাস
স্বামীর ধন টগর বগর
পুত্রের ধন অতি ঝগড়।
শুধু কী এইসব চিত্র? তা নয়,পণপ্রথার
চিত্র বাদ যায়নি ব্রতের ছড়া থেকে।পণপ্রথা বা বিবাহে যৌতুক নেওয়া সমাজের একটি ব্যাধিতে
পরিণত হয়েছে।সমাজের বহু পরিবর্তনেও এর বিলোভ হয়নি বরং পণপ্রথা জাকিয়ে বসেছে। "বাংলার ব্রত" গ্রন্থে 'মাঘ মন্ডল' ব্রতে
চন্দ্রকলার সঙ্গে সূর্যের বিবাহ লক্ষ্য করা যায় -
বিয়া করলেন সূর্যঠাকুর, দানে পাইলেন কি?
হাতিও পাইলেন, ঘোড়াও পাইলেন, আর মাধবের ঝি।
খাট পাইলেন, জাজিম পাইলেন, আর মাধবের ঝি।
লেপ পাইলেন, তোশক পাইলেন,
ঘটি পাইলেন, বাটি পাইলেন,
থালা পাইলেন, খোরা পাইলেন, আর মাধবের ঝি।
………………………………………………
লাউলের ঘরে ছেইলারে কী কী গয়না দিমু? হা
তজোখা বলয়া দিমু, গলাজোখা হার দিমু,
বুকজোখা পাটা দিমু, কোমরজোখা টোড়া দিমু,
পাত্তজোঁখা গুজরি দিমু, দুই চরণে নেপুর দিমু,
লাউলের ছেইলা নাচবে, রাজার রাজ্য হাসবে।
ব্রতের ছোড়ায় জাতিভেদ প্রথার
চিত্র উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে পরজনমে যেন উত্তম বা উচ্চ কুলে জন্ম হয়। 'তুঁষতুঁষলি' ব্রতে অবনীন্দ্রনাথ তুলে ধরেছেন-
ঘর করবো নগরে
মরবো গিয়ে সাগরে
জন্মাবো উত্তম কুলে।
আবার 'সেঁজুতি' ব্রতে রাজরানী হওয়ার চিত্রও লক্ষ্য করা যায় –
কোঁড়ার মাথায় ঢালি ঘি
আমি যেন হই রাজার ঝি
কোড়ার মাথায় ঢালি মৌ
আমি যেন হই রাজার বউ, ইত্যাদি।
এভাবে সেযুগের সামাজিক ইতিহাসের
বহু উপাদান ব্রতগুলোতে যেমন ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায় তেমনি ব্রতের আলপনার মধ্য দিয়ে
প্রাগৈতিহাসিক নানানচিত্র ফুটে উঠেছে, যার শিল্প মূল্য অমূল্য। (আলোচ্য গ্রন্থে আলপনার
দীর্ঘ আলোচনা পূর্বেই করেছি।)
কোন মন্তব্য নেই
ok