প্রাবন্ধিক হিসেবে রবীন্দ্রনাথের মৌলিকতা : ড. নীলোৎপল জানা
রবীন্দ্রনাথ
যুগপৎ কবি ও মনীষী বলেই তাঁর প্রবন্ধগুলিতে একদিকে যেমন প্রতিভার ভাবুকতা লক্ষ্য করা
যায়, তেমনি অন্যদিকে সুতীক্ষ্ণ মনন শক্তির পরিচয় ও প্রকাশিত হয়। সেজন্যাই বাংলা সাহিত্যে
প্রচলিত প্রবন্ধের ধারা থেকে রবীন্দ্র প্রবন্ধ স্বতন্ত্র ও স্বমহিমায় উজ্জ্বল। বলা
ভালো রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ তাঁর জীবন নিষ্ঠ মননের ভাষ্য। শিল্প-সাহিত্য-আর্থ রাজনৈতিক
চিন্তা ধারা সমাজ-সংস্কার সম্পর্কিত সমস্যা, ধর্মদর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, শিক্ষা ইত্যাদি
প্রায় সমস্ত বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। শুধু কি এই? স্মৃতিচিত্র,
ডায়েরি পত্র ইত্যাদি আত্মনিষ্ঠ রচনাগুলিও রবীন্দ্র প্রবন্ধকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে।
এছাড়াও ভাষাতত্ত্ব ও সাহিত্যতত্ত্বের মতো নিরস বিষয় ও রবীন্দ্র প্রবন্ধে স্থান পেয়েছে।
সমসাময়িক বহু পত্র পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত থেকে তিনি বাংলা প্রবন্ধের সম্ভারকে সমৃদ্ধ
করেছিলেন। এদের মধ্যে ভারতী, সাধনা ভাণ্ডার, বঙ্গদর্শন (নবপর্যায়) ইত্যাদি পত্রিকাগুলির
সম্পাদনার সূত্রেই তাঁর বেশিরভাগ প্রবন্ধগুলি রচিত হয়েছিল। আর এই সমস্ত কিছুর ফলে বাংলা
ভাষা ও বালং গদ্যরীতির যে উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে তার মূল্য অপরিসীম।
রবীন্দ্র প্রবন্ধ সাহিত্যকে নিম্নোক্ত কয়েকটি বিষয়ে বিন্যস্ত করা যায়-
(অ) শিক্ষা-সমাজ রাজনীতি: এই ধারার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগুলি হল- 'আত্মশক্তি' (১৯০৫), 'ভারতবর্ষ '(১৯০৬), 'শিক্ষা' (১৯০৮), 'রাজা প্রজা' (১৯০৮), 'স্বদেশ' (১৯০৮), 'সমাজ' (১৯০৮), 'পরিচয়' (১৯১৬), 'সমবায়নীতি' (১৯২৮), 'কালান্তর' (১৯৩৭), 'সভ্যতার সংকট' (১৯৪১), 'পল্লীপ্রকৃতি' (১৯১৬)।
(আ) ধর্ম
ও দর্শনমূলক প্রবন্ধ: এই ধারার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগুলি হল- 'ধর্ম' (১৯০৯), 'শান্তি
নিকেতন' (১৯০৯-১৯১৬), 'সঞ্চয়' (১৯১৬), 'মানুষের ধর্ম' (১৯৩৩), 'আশ্রমের রূপ' ও 'বিকাশ'
(১৯৪১), 'বিশ্ব ভারতী' (১৯৫১)।
(ই) সাহিত্য
সমালোচনা: এই ধারার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগুলি হল- 'প্রাচীন সাহিত্য' (১৯০৭), 'লোক সাহিত্য'
(১৯০৭), 'সাহিত্য' (১৯৩৬), 'সাহিত্যের স্বরূপ' (১৯৪৩)।
(ঈ) ব্যক্তিগত
প্রবন্ধ: এই ধারার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগুলি হল 'পঞ্চভূত' (১৯৯৭), 'বিচিত্র প্রবন্ধ'
(১৯০৭), 'লিপিকা (১৯২২), 'ভারত পথিক রামমোহন রায়' (১৯৩৩)।
(উ) জীবনী
ভ্রমণ কথা ও পত্রসাহিত্য: এই ধারার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগুলি হল- 'যুরোপ প্রবাসীর পত্র'
(১৮৮৩), 'চিঠিপত্র' (১৮৮৭), 'য়ুরোপ যাত্রীর ডায়েরী' (১৮৯১-৯৩), 'চরিত্র পূজা' (১৯০৭),
'জীবন সমৃতি' (১৯১২), 'ছিন্নপত্র' (১৯১২), 'জাপান যাত্রী' (১৯১৯), 'ভানুসিংহের পত্রাবলী'
(১৯৩০), 'রাশিয়ার চিঠি' (১৯৩১), 'পথের সঞ্চয়' (১৯৩৯), 'ছেলেবেলা' (১৯৪০) ইত্যাদি।
রবীন্দ্র
প্রবন্ধের যে বিশালতা ও ব্যপ্তি তা স্বল্প সময়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে ধরা ছোঁয়ার বাইরেই
থেকে যায়। তবুও আমরা রবীন্দ্র প্রবন্ধের এক একটি ভাগে রবীন্দ্র মানসিকতার যে পরিচয়
ফুটে উঠেছে তাকে অল্পবিস্তর ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব।
বাংলা সাহিত্যে
রবীন্দ্র প্রতিভার সোনার কাঠির স্পর্শে পাষাণপুরীর স্বর্ণপুরীতে রূপান্তর এক স্বাভাবিক
ঘটনা। শিক্ষা-রাজনীতি, সমাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ধর্ম-দর্শন ইত্যাদি তথ্যনির্ভর
প্রবন্ধগুলিতে রবীন্দ্রনাথ যুক্তি নির্ভর, তীক্ষ্ণ বাক্য প্রয়োগে তৎপর এবং শ্লেষ ও
ব্যঙ্গ প্রয়োগে সিদ্ধহস্ত। ব্যক্তিগত প্রবন্ধের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ অন্তরের অতল গভীরে
ডুব দিয়েছেন। আর সেখান থেকে কুড়িয়ে এনেছেন সপ্তরঙ্গে মণি-মাণিক্য। যা সাহিত্যের এক
বিশেষ সম্পদ। তাঁর ধর্ম বিষয়ক প্রবন্ধগুলি ঐশী স্পর্শ লোভাতুর কবির আবেগময় আকুতির কাব্যময়
প্রকাশ। শান্তিনিকেতনের ব্যাখ্যামূলক লেখাগুলি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ধর্মমত ও উপনিষদের
প্রভবাপুষ্ট। তবে তত্ত্ব এখানে অমূর্তবাণী নয়, তা দৃশ্যে-বর্ণে-গন্ধে গানে মূর্ত। তাঁর
শিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধগুলিতেও লেখকের উদার মানস মুক্তি এবং শিক্ষা পদ্ধতির যান্ত্রিকতা
ও অপূর্ণতা উদ্ঘাটিত।
রবীন্দ্রনাথের
রাজনৈতিক প্রবন্ধগুলিতে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রনীতির ভোগ-স্পৃহা ও পোষণ বৃত্তি নিন্দিত হয়েছে।
পাশাপশি ধিকৃত হয়েছে ইংরেজ শাসনের কলঙ্কিত অধ্যায়। যার জ্বলন্ত লাভাস্রোত 'সভ্যতার
সঙ্কট'। এই প্রবন্ধে আপাত সমৃদ্ধ অথচ ভিতরে মৃত্যুজীর্ণ দস্যু সভ্যতার প্রতি কবি ঋষিসুলভ
চরম অভিশাপ বাণী উচ্চারিত। আর সেইসঙ্গে ধ্বনিত হয়েছে এই চিরন্তন বাণী।
মানুষের
প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।"
শুধু শিক্ষা-সমাজ-ধর্মদর্শন
নয়, সমালোচনা সাহিত্যেও রবীন্দ্রনাথ অদ্বিতীয়। 'প্রাচীন সাহিত্য', 'লোকসাহিত্য', 'আধুনিক
সাহিত্য', 'সাহিত্য', 'সাহিত্যের পথে' ইত্যাদি গ্রন্থ কবির মৌলিক গূঢ় সঞ্চারী অনুভূতির
আলোকে সমুজ্জ্বল। 'প্রাচীন সাহিত্যে'র 'মেঘদূত' রবীন্দ্রসৃষ্ট নবমেঘদূত, যে মেঘদূতকে
নিয়ে কবি চলে গেছেন আপন কল্পরাজ্যে। সেখানে 'মানস সরোবরের আগমন তীরে' তাঁর পরম দয়িত
প্রতীক্ষারত। অতলস্পর্শ বিরহ কবির চিত্তে ঘনীভূত। আর সেই গভীর বিরহের মধ্যেই কবির আশ্বাসবাণী।
"এক
অপূর্ব সৌন্দর্য লোকে শরৎ পূর্ণীমারাত্রে তাঁহার সহিত চিরমিলন হইবে।"
রবীন্দ্রনাথ
'সৌন্দর্যবোধ' প্রবন্ধে বলেছিলেন,
"সৌন্দর্যমূর্তিই
মঙ্গলের পূর্ণমূর্তি এবং
মঙ্গলমূর্তিই
সৌন্দর্যের পূর্ণস্বরূপ।"
আবার তাঁর
কাব্যেও দেখা গেছে 'মঙ্গল' ও 'সৌন্দর্য' প্রকাশের ইঙ্গিত। যেমন, বিশ্বসৃষ্টির অধিষ্ঠাত্রী
দেবীর কাছে কবির বিনম্র আবেদন- 'আমি তব মালঞ্চের হব মালাকার' দেবী প্রশ্ন করেছিলেন,
'কি কাজে লাগিবি'?
কবি উত্তর
দিয়েছিলেন-
"অকাজের
কাজ যত আলস্যের সহস্র সঞ্চয় শত শত আনন্দের আয়োজন।"
আসলে কবির
মতে, আর্ট সৃষ্টি এই 'অকাজের কাজ', 'আলস্যের সহস্র সঞ্চয়' এবং 'আনন্দের আয়োজন'। নিছক
উদরপূর্তিতে মানুষ সন্তুষ্ট নয়। তাই তাকে মনে মনে আমন্ত্রিত হতে হয় সৌন্দর্যলোকের আনন্দ
যজ্ঞে। এই আনন্দেই আছে আমাদের মুক্তি।
রবীন্দ্রনাথে
'লোকসাহিত্য' ও একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ গ্রন্থ। রবীন্দ্রনাথ নগর কলকাতার মানুষ হলেও
গ্রামবাংলার সঙ্গে তাঁর ছিল অন্তরের যোগ। জমিদারী দেখাশোনার সুবাদে গ্রামের মানুষ তথা
গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, গ্রাম বাংলার
হারিয়ে যাওয়া লুপ্ত প্রায় লোকসংস্কৃতির অমূল্য সম্পদকে উদ্ধার করে আমাদের উপহার দিয়েছিলেন।
তাঁর এই অসাধারণ কৃতিত্বে মুগ্ধ হয়ে বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট সমালোচক ড. শ্রীকুমার
বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন-
"রবীন্দ্রনাথের
'লোকসাহিত্য' পড়িলে বিস্ময় জাগে যে, যে কবি পরিণত ও অভ্রান্ত শিল্পবোধের শ্রেষ্ঠ আদর্শ
তিনি কেমন করিয়া সম্পূর্ণরূপে শিল্পরূপহীন নিরর্থক ছন্দ কাকলি মুখর ও বিচ্ছিন্ন চিত্র
পরম্পরা সমন্বিত 'ছেলে ভুলানো ছড়া'র অন্তর্লোকে প্রবেশ করিয়া উহার প্রেরণামূল ও আবেগ
প্রবাহের গোপন যোগসূত্রটি এমন সুষ্ঠুভাবে আবিষ্কার ও প্রকাশ করিয়াছেন।"
শ্রীকুমারবাবুর এই মন্তব্য থেকেই আমরা রবীন্দ্রনাথের 'লোকসাহিত্য' প্রবন্ধের তাঁর স্বচ্ছন্দ
পদচারণাটিকে উপলব্ধি করতে পারি।
আধুনিক সাহিত্য
সমালোচনামূলক প্রবন্ধগুলিতেও রবীন্দ্রনাথের চিন্তার সূক্ষ্মদর্শিতার পরিচয় পাওয়াযায়।
এই প্রবন্ধগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- বঙ্কিমচন্দ্র, বিহালীলাল, সঞ্জীবচন্দ্র, বিদ্যাপতির
রাধিকা, কৃষ্ণচরিত্র, রাজসিংহ ইত্যাদি। বলাবাহুল্য যে, এই প্রবন্ধগুলি অপেক্ষাকৃত বিশ্লেষণাত্মক
হলেও রসপভোগের ক্ষেত্রে কোন অসুবিধা হয় না।
রবীন্দ্রনাথের
বিস্ময়কর সৃষ্টির মধ্যে অন্যতম হল' বিচিত্র প্রবন্ধ' যুক্তি তর্ক নির্ভর কবির এই পর্যায়ের
উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগুলি হল 'পাগল', 'কেকার ধ্বনি', 'নববর্ষা', 'পরনিন্দা', 'রুদ্ধগৃহ',
'পথেপ্রান্তে' 'বাজে কথা', বেকনের ভাষায় 'Dispersed Medition'-এলোমেলো চিন্তা। বলাবাহুল্য
সাহিত্যের জগতে সেগুলি দুর্লভ নিটোল মুক্ত। কারুকার্যকরা ভাষার নৌকা বেয়ে লেখক বিষয়
থেকে বিষয়ান্তরে স্বেচ্ছা ভবনে রত।
রবীন্দ্র
প্রবন্ধের ধারায় পঞ্চভূতের লেখাগুলিও এক নতুন ধরনের রচনা নিদর্শন। বঙ্কিমের কমলাকান্তের
দপ্তরের সঙ্গে এর আঙ্গিকগত মিল থাকলেও ভাব-ভাষা এবং বস্তু তথ্যে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী।
রবীন্দ্রনাথের মতে আমাদের এই জগৎ পঞ্চ উপাদানে কায়া নির্মিত। তাঁর মতে কম বেশি এক একটি
উপাদানের এক একটি বিশেষ গুণ মানুষকে পৃথক বৈশিষ্ট্য দান করেছে। ক্ষিতি বস্তুনিষ্ঠ,
কবির ভাষায় স্রোতস্বিনীর উচ্ছ্বল প্রেমধারার প্রতীক। তেজ কবির ভাষায় দীপ্তি, প্রাণের
প্রেরণাদাত্রী, মরুৎ কবি অনুভূতিতে একটু কল্পনাশ্রয়ী লঘুগতি সম্পন্ন। ব্যোম্ শূন্যমার্গের
জল্পনার ফাঁদ তৈরি করায় ব্যাপৃত। আর এই পঞ্চ চরিত্রের সঙ্গে কবিদ্রষ্টা নিজে হয়েছেন
ষষ্ঠসঙ্গী। সরস টিপ্পনী, গভীর তত্ত্বে, দ্রষ্টার নিস্পৃহ দর্শনে এবং প্রেম দীপ্তি ও
কল্পনার গুণে রচনাটি অনন্য।
রবীন্দ্র
প্রবন্ধের আলোচনার শেষে একথা বলা যায় যে, তাঁর প্রবন্ধের আলোচনার বিশালতা ও ব্যাপকতাকে
স্বল্প পরিসরে ধরা সাধ্যাতীত। যা আলোচনা করা হল তা তাঁর প্রবন্ধের বিচিত্র মননশীল বিষয়গুলিকে
শুধু ছুঁয়ে যাওয়া মাত্র। রীন্দ্র প্রবন্ধের প্রত্যেকটি কথাতেই অনুভব করা যায় অন্তনির্হিত
রস সত্তার ধ্বনিময় প্রস্ফুটন।
কোন মন্তব্য নেই
ok