প্রাচীন বাঙালির খাদ্যাভ্যাস ,পোশাক-পরিচ্ছদ ও উৎসব, পার্বন : ড. নীলোৎপল জানা
প্রাচীন বাঙালির খাদ্যাভ্যাস ও পোশাক-পরিচ্ছদ
ড. নীলোৎপল জানা
প্রাচীন ও বর্তমান বাঙালির আহারের একটা বিশেষ উপাদান
হচ্ছে মাছ। অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় ভাষাভাষী লোকরা মাছ খেতেন। কিন্তু বৈদিক আর্যরা মাছ
খেতেন না। তাঁরা খেতেন মাংস। অস্ট্রিক ও দ্রাবিড়ভাষাভাষী লোকরা গরুকে শ্রদ্ধার চোখে
দেখতেন। পোশাক-আশাকের ব্যাপারেও বাঙালির সঙ্গে উত্তর ভারতের লোকদের পার্থক্য দেখা যায়।
তাছাড়া, তাঁরা রাঁধবার জন্য তেলের পরিবর্তে ঘি ব্যবহার করেন। রন্ধন-ক্রিয়ার বৈচিত্র্যেও
বাঙালির দক্ষতা সুবিদিত। বাঙালির আহারে ৬৪ রকমের ব্যঞ্জন ব্যবহৃত হত। ইতিহাসের ঊষালগ্ন
থেকে যে দেশের প্রথম ও প্রধান উৎপন্ন বস্তু ধান সে দেশে যে প্রধান খাদ্য ভাত হবে তাতে
আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ভাত খাওয়ার অভ্যাস ও সংস্কার আদি অস্ট্রেলিয় জনগোষ্ঠীর সভ্যতা
ও সংস্কৃতির দান।
'হাড়ীত ভাত নাঁহি নিতি আবেশী'-
বাঙালি জীবনের
সবচেয়ে বড় দুঃখ। ভাত রাঁধবারও তারতম্য ছিল যদিও তার সাক্ষ্য প্রমাণ নেই। উচ্চ কোটির
বিবাহভোজে যে অন্ন পরিবেশিত হত তার বিবরণ পাওয়া যায় নৈষধচরিতে দময়ন্তীর বিবাহভোজের
বর্ণনায়। গরম ধূমায়িত ভাত ঘৃত সহযোগে ভক্ষণ করাটাই বোধ হয় ছিল সাধারণ রীতি। 'প্রাকৃত
পৈঙ্গল' গ্রন্থে (১৪ শ শতকের শেষ) প্রাকৃত, বাঙালি আহার্য কলাপাতায় –
"ওগগরা ভত্তা গাইক ঘিত্তা',
গো-ঘৃত সহকারে
সফেন গরম ভাত। নৈষধচরিতের বর্ণনায়- 'পরিবেশিত অগ্ন হতে ধূম উঠিতেছে তাহার প্রত্যেকটি
কণা অভগ্ন, একটি হতে আর একটি বিচ্ছিন্ন (ঝরঝরে ভাত), সে অন্ন সুসিদ্ধ, সুস্বাদু ও শুভ্রবর্ণ,
সরু এবং সৌরভময়। দুগ্ধ ও অন্নপক্ক পায়েস ও উচ্চকোটির লোকেদের এবং সামাজিক ভোজে অন্যতম
ভক্ষ্য ছিল। ভাত খাওয়া হত শাক ও অন্যান্য ব্যঞ্জন সহযোগে। দরিদ্র এবং গ্রাম্য লোকদের
প্রধান উপাদানই ছিল শাক ও অন্যান্য সব্জী-তরকারী। ডাল খাওয়ার কোনও উল্লেখ কোথাও দেখা
যায় না। উৎপন্ন দ্রব্যাদির তালিকাতেও ডাল বা কলাইয়ের উল্লেখ নেই। নানা শাকের মধ্যে
নালিতা (পাট) শাকের উল্লেখ প্রাকৃত পৈঙ্গলে দেখা যায়। এই গ্রন্থের প্রাকৃত বাঙালির
খাদ্য তালিকাটি এরকম-
'ওগগরা ভত্তা রম্ভঅ পত্তা গাইক ঘিতা
দুগ্ধ সজুক্তা
মোইলি মচ্ছা, নালিত গচ্ছা দিজ্জই কান্তা
খা (ই) পুণবন্তা।'
অর্থাৎ 'কলাপাতার গরম ভাত, গাওয়া ঘি, মৌরলা মাছের ঝোল এবং নালিতা শাক যে স্ত্রী নিত্য পরিবেশন করতে পারেন তাঁহার স্বামী পুণ্যবান, এ সম্বন্ধে সন্দেহ নাই।' উচ্চকোটি বাঙালি সমাজে সে যুগেও ব্যঞ্জন তরকারী ইত্যাদির বাহুল্য যথেষ্টই ছিল। এত বেশি আয়োজন হত যে লোকে সব খেয়েও গুণে উঠতে পারত না। এই ধরণের বৃহৎ ভোজে সামাজিক অপচয় শ্রীহর্ষের কালেও যা দেখা যেত বর্তমান কালেও তা অব্যাহত। বিবাহভোজে পরিবেশিত হত- দই ও রাই সরিষার প্রস্তুত শ্বেতবর্ণ বেশ ঝালযুক্ত ব্যঞ্জন, হরিণ, ছাগ এবং পক্ষী মাংসের নানা ব্যঞ্জন। মাংসের নয় কিন্তু দৃশ্যত মাংসোপম বিবিধ উপাদান যুক্ত ব্যঞ্জন। মাছের নানা রকমারী ব্যঞ্জন এবং অন্যান্য আরোও নানা প্রকারের সুগন্ধি ও প্রচুর মশলাযুক্ত ব্যঞ্জনাদি, নানা প্রকারের সুমিষ্ট পিষ্টক ও দই ইত্যাদি। পানীয় পরিবেশিত হত কর্পূর মিশ্রিত সুগন্ধি জল। ভোজের পর মশলাযুক্ত পানের খিলি। দই, পায়েস, ক্ষীর প্রভৃতি দুগ্ধজাত নানা প্রকারের খাদ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলি বাঙালির প্রিয় খাদ্য।
আসাম, বাঙলা, ওড়িশা, গুজরাট ও দক্ষিণ ভারতের
লোকরা উপর-গায়ের জন্য চাদর ও পায়ে গোড়ালির দিকে খোলা জুতা পরেন। কিন্তু উত্তর ভারতের
লোকরা উপর-গায়ের জন্য সেলাই-করা জামা ও পায়ে গোড়ালি-ঢাকা জুতা ব্যবহার করতেন। বাঙালিরা
শাড়ি ব্যবহার করত।
বাঙালির ধর্মীয় জীবন: উৎসব, পার্বন
যদিও মৌর্যযুগ থেকেই বাঙলায় ব্রাহ্মণদের অনুপ্রবেশ
ঘটেছিল, তা হলেও ব্যাপকভাবে ব্রাহ্মণরা বাঙলায় আসতে শুরু করে গুপ্তযুগে। ব্রাহ্মণ্যধর্মের
অনুপ্রবেশের পূর্বে বাঙলাদেশে বাঙলায় আদিম অধিবাসীদের ধর্মই অনুসৃত হত। মৃত্যুর পরে
আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস, মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা, বিবিধ ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়া
ও মন্ত্রাদি, প্রকৃতির সৃজনশক্তিকে মাতৃরূপে পূজা, লিঙ্গ পূজা, কুমারী পূজা,' 'টোটেম'-এর
প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা এবং গ্রাম, নদী, বৃক্ষ, অরণ্য, পর্বত ও ভূমির মধ্যে নিহিত শক্তির
পূজা, মানুষের ব্যাধি ও দুর্ঘটনাসমূহ দুষ্ট শক্তি বা ভূত- প্রেত দ্বারা সংঘটিত হয় বলে
বিশ্বাস ও বিবিধ নিষেধাজ্ঞাজ্ঞাপক অনুশাসন ইত্যাদি নিয়েই বাঙ্গার আদিম অধিবাসীদের ধর্ম
গঠিত ছিল।
কালের বিবর্তনে এই সকল বিশ্বাস ও আরাধনা-পদ্ধতি
ক্রমশ বৈদিক আর্যগণ কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল এবং সেগুলি হিন্দুধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়ে জন্ম,
মৃত্যু, বিবাহ, শ্রাদ্ধ ইত্যাদি আনুষ্ঠানিক ধর্মকর্মে পরিণত হয়েছিল। বস্তুতঃ ব্রাহ্মণ্যধর্মের
অনেক কিছু পূজা-পার্বনের অনুষ্ঠান, যেমন দুর্গাপূজার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নবপত্রিকার পূজা
ও শবরোৎসব, নবান্ন, পৌষপার্বন, হোলি, ঘেঁটুপূজা, চড়ক, গাজন প্রভৃতি এবং আনুষ্ঠানিক
কর্মে চাউল, কলা, কলাগাছ, নারিকেল, সুপারি, পান, সিঁদুর, ঘট, আলপনা, শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি,
গোময় এবং পঞ্চগব্যের ব্যবহার ইত্যাদি সবই আদিম অধিবাসীদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছিল। তাঁদের
কাছ থেকে আরও নেওয়া হয়েছিল আটকৌড়ে, শুবচনী পূজা, শিশুর জন্মের পর ষষ্ঠী পূজা, বিবাহে
গাত্রহরিদ্রা, পানখিলি, গুটিখেলা, স্ত্রী-আচার, লাজ বা খই ছড়ানো, দধিমঙ্গল, লক্ষ্মীপূজার
সময় লক্ষ্মীর ঝাঁপি স্থাপন, অলক্ষ্মীর পূজা ইত্যাদি আচার-অনুষ্ঠান যা বর্তমান কালেও
বাঙালি হিন্দু পালন করে থাকে। এসবই প্রাক্-আর্য সংস্কৃতির অবদান। এ ছাড়া, নানারূপ গ্রাম্য
দেবদেবীর পূজা, ধ্বজা পূজা, বৃক্ষের পূজা, বৃষকাষ্ঠ, যাত্রাজাতীয় পর্বাদি যেমন স্নানযাত্রা,
রথযাত্রা, ঝুলনযাত্রা, রাসযাত্রা, দোলযাত্রা প্রভৃতি এবং ধর্মঠাকুর, চণ্ডী, মনসা, শীতলা,
জাঙ্গুলী, পর্ণশবরী প্রভৃতির পূজা ও অম্বুবাচী, অরন্ধন ইত্যাদি সমস্তই আমাদের প্রাক্-আর্য
জাতিসমূহের কাছ থেকে নেওয়া।
---------------------------------------------------------
Dr.Nilotpal Jana
যারা পেজটি দেখছেন কেমন লাগলো কমেন্ট করতে ভুলবেন না
এই ধরনের লেখা আরো চাই
উত্তরমুছুনএইধরনের আরও লেখা চাই
উত্তরমুছুনলেখাটি পড়ে ভালো লাগলো আরো পড়তে চাই
উত্তরমুছুন