অতিথি গল্প : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর :ড. নীলোৎপল জানা
অতিথি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১ উদ্দেশ্য
২. প্রস্তাবনা
৩. গল্পের উৎস সন্ধানে
৪. গল্পের বিশ্লেষণাত্মক পাঠ
==========================================================
১ উদ্দেশ্য
এই লেখাটি
পাঠ করলে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যাবে। বিশেষত একটি অসামান্য
যুগাতিক্রমী রবীন্দ্র গল্পের সঙ্গে পরিচয় ঘটবে। মানবজীবনের একটি নিগূঢ় ভাবসত্যের সঙ্গে
পরিচিত হবে। তোমরা উপলব্ধি করতে পারবে গল্পকারের নিজস্ব জীবনবোধ। প্রকৃতি-মানবের পারস্পরিক
বন্ধনের মধ্য দিয়ে পরিপূরক সম্পর্কের ধারণা লাভ করতে সক্ষম হবে।
২ প্রস্তাবনা
একটি গল্পকে
বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গিতে পাঠ করতে গেলে কয়েকটি বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন:- কাহিনি অংশ,
চরিত্রনির্মাণ, শিল্পরীতি ও লেখকের নিজস্বতা। এই চারটি বিষয়কে অবলম্বন করে গল্পের অন্দরে
প্রবেশ করা হবে। প্রসঙ্গক্রমে চরিত্রের অন্তর্লোকে অবগাহনের মধ্য দিয়ে বয়ঃসন্ধিক্ষণের
বিশেষ মানসিকতা, পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের অভিজ্ঞতার জগৎ ও বোধের জগতের সঙ্গে বাস্তবতার
সংযোগ অনুসন্ধান করা যাবে।
৩ গল্পের উৎস সন্ধানে
অনন্তকাল
ধরে বহমান জলধারার অসীম রহস্য মানবের প্রবহমান রক্তস্রোতে সঞ্চারিত করে চলেছে দুর্নিবার
আকর্ষণ। জমিদারি পরিদর্শনের কাজে দীর্ঘকাল পদ্মার তীরে বসবাসের সূত্রে পদ্মার অকূল
স্রোতের টান রূপায়িত হয়েছে রবীন্দ্র সাহিত্যে। অতিথি গল্পে নদীর জলময় সত্তার লিরিক্যাপ
প্রবাহ। ১৩০২ বঙ্গাব্দে (1895) 'সাধনা' পত্রিকার ভাদ্র-আশ্বিন সংখ্যায় 'অতিথি' গল্পটি
প্রকাশিত হয়। এটি 'সাধনা' পত্রিকায় প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের শেষ গল্প। 'অতিথি' গল্পটি
সম্ভবত সাজাদপুরে লেখা বলে অনুমান করেছেন রবিজীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল।
এই বছরের আষাঢ়ে ইন্দিরা দেবীকে সাজাদপুর থেকে (২৮ জুন, ১৮৯৫) রবীন্দ্রনাথ লেখেন---
"বসে বসে
সাধনার জন্য একটা গল্প লিখছি, একটু আষাঢ়ে গোছের গল্প। লেখাটা প্রথম আরম্ভ করতে যতটা
প্রবল অনিচ্ছা ও বিরক্তি বোধ হচ্ছিল এখন আর সেটা নেই। এখন তারই কল্পনাস্রোতের মাঝখানে
গিয়ে পড়েছি- একটু একটু করে লিখছি এবং বাইরের প্রকৃতির সমস্ত ছায়া আলোক বর্ণ ধ্বনি আমার
লেখার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। আমি যে সকল দৃশ্য লোক ও ঘটনা কল্পনা করছি তার চারিদিকে এই
রৌদ্র-বৃষ্টি, নদীস্রোত এবং নদীতীরের শরবন, এই বর্ষার আকাশ, এ ছায়াবেষ্টিত গ্রাম, এই
জলধারা প্রফুল্ল শস্যের ক্ষেত ঘিরে দাঁড়িয়ে তাদের সত্যে ও সৌন্দর্যে সজীব করে তুলছে।
আমার নিজের মনের কল্পনা আমার নিজের কাছে বেশ রমণীয় হয়ে উঠছে। কিন্তু পাঠকেরা এর অর্ধেক
জিনিসও পাবে না। তারা কেবল কাটা শস্য পায়, কিন্তু শস্যক্ষেত্রের আকাশ এবং বাতাস, শিশির
এবং শ্যামলতা, সবুজ এবং সোনালী এবং নীল- সমস্তই বাদ দিয়ে পায়। আমার গল্পের সঙ্গে যদি
এই মেঘমুক্ত বর্ষাকালের স্নিগ্ধ রৌদ্ররঞ্জিত ছোট নদীটি এবং নদীরতীরটি, এই গাছের ছায়া
এবং গ্রামের শান্তিটি এমনি অখণ্ডভাবে তুলে দিতে পারতুম, তাহলে গল্পটি কেমন সুমিষ্ট
সজীব হয়ে দেখা দিত। তা হলে সবাই তার মর্মের সত্যটুকু কেমন অতি সহজেই বুঝতে পারত।”
পত্রের এই
নদীস্রোত, 'নদীতীর', 'জলধারা প্রফুল্ল' প্রকৃতির 'বর্ণ', 'ছায়া', 'আলো' মিশে আছে 'অতিথি'
গল্পে। তবে 'অতিথি' গল্পটি 'আষাঢ়ে গোছের' কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু পূর্ববঙ্গের
পল্লীগ্রামের সজীব সান্নিধ্য তাঁর গল্পে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছে। এ সময় রবীন্দ্রনাথ
কিছুদিন পদ্মাবক্ষে বোটে বাস করছিলেন। নদীবক্ষ থেকে তীরবর্তী গ্রাম, গ্রামের মানুষ,
তাদের জীবনের স্পর্শ পাওয়া অভিজ্ঞতা সঞ্চারিত হয়েছে গল্পে। 'অতিথি' গল্পটি পাঠে তা
অনুভূত হয়।
৪ গল্পের বিশ্লেষণাত্মক পাঠ
'অতিথি'
গল্পটি লেখার কিছু বছর পূর্বেই রবীন্দ্রজীবনে শুরু হয়েছে পদ্মাবিধৌত জনপদভূমিতে যাপন
পর্ব। শিলাইদহ, সাজাদপুর, পতিসরে তখন নিয়মিত যাতায়াত। কলকাতার নগর জীবনের স্বাদে অভিজ্ঞ
কবি পল্লী প্রকৃতির নিবিড় আলিঙ্গনে অনুভব করছেন বিচিত্র রং-রূপ-রস সম্বলিত দিন-রাত্রির
অপ্রতিম আলেখ্য। চন্দননগরে মোরান সাহেবের বাগানবাড়িতে ইতিপূর্বে রবীন্দ্রনাথ কিছুকাল
কাটিয়ে গ্রাম জীবনের দৃশ্যপট প্রত্যক্ষ করলেও পদ্মার তীরে তাঁর প্রবেশ অন্দরের মহলে।
পদ্মা তীরের গ্রাম বাংলার স্নিগ্ধ স্পর্শে কবি রবীন্দ্রনাথের সার্থক আত্মপ্রকাশ ছোটগল্পকার
রূপে। অবশ্য তার আগে 'ঘাটের কথা', 'রাজপথের কথা' তিনি লিখেছেন। সেসব গল্প সার্থক ছোটগল্প
রূপে সমালোচক মহলে তেমন স্বীকৃতি পায়নি। পূর্ববঙ্গের পল্লীগ্রামের সজীব সান্নিধ্যে
তাঁর গল্পে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছে। গ্রাম, গ্রামের মানুষ, তাদের জীবনের স্পর্শ পাওয়া
অভিজ্ঞতা সঞ্চারিত হয়েছে এ সময়ে লেখা গল্পগুলিতে।
'অতিথি' তারাপদর গল্প। রবীন্দ্রনাথের বাল্যস্মৃতি ও কল্পনা মিলেমিশে এ গল্পের তারাপদ চরিত্রকে নির্মাণ করেছে। "রবীন্দ্রনাথের কল্পনায় এক 'নিত্যকালের বালকবীর' আছে যে চিরযাত্রিক, প্রকৃতির প্রাণসত্তার প্রতীক"। তারাপদর ব্যক্তিত্বের মধ্যে অনন্তের আহ্বান। পরিচিত মানব আশ্রয়, প্রেম-ভালোবাসা- স্নেহের বন্ধন ছাড়াও খাওয়া-পরা ও অন্যান্য যেসব জৈব তাগিদগুলি মানুষকে নির্দিষ্ট শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখে, তা স্থিতি পায় না তারাপদর মধ্যে। 'বন্ধন মুক্তির' 'প্রসন্ন আলোয়' তার মন আশ্রয় পায়। সেকারণেই তার জীবনের মসৃণগতি নদীকে ছাড়া সম্ভব ছিল না। নিরবিচ্ছিন্ন নদী প্রবাহে যে নিরাসক্ত চলমান পথিক সত্তা নিবিষ্ট হয়েছে, তারাপদ তারই প্রতিরূপ। নদী ও তার প্রবহমানতা তারাপদর বৈরাগ্যপ্রবণ চরিত্রের প্রধান উপাদান হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও 'ঘর পালানো', পথে বেড়ানো চঞ্চল অথচ উদাসীন পথিক-প্রাণ মন ছিল চির জাগ্রত। তাঁর কবিতায়, গানে সেই চিরপথিক সুরটি অনুভব করা যায়। 'ঘর ছাড়ানো আকুল সুরে / উদাস হয়ে বেড়ায় ঘুরে'। চিরকিশোর রবীন্দ্রনাথের পথিক প্রাণ রূপটি আরও স্পষ্ট করে উন্মোচিত হয়েছে তার চরিত্রে। তাই স্থলজীবন থেকে জলজীবনে তারাপদর প্রবেশের মধ্যে দিয়ে কাহিনির সূচনা। অতঃপর ব্ল্যাকফ্লাশে তারাপদর অতীত জীবন তথা বাল্যের কথায় ক্রমশ স্পষ্ট রূপ পায় তার চির পথিক সত্তা।পথের হাতছানি অবহেলা করতে পারে না তারাপদ। সকলের স্নেহ, ভালোবাসা, আদর তাকে অজানা স্রোতে ভেসে যাওয়া থেকে আটকাতে পারে না। পরিচিত চেনা জীবনের ছকে বাঁধা যাপন তাকে স্বস্তি দেয় না। তাই তো বারবার ঘর ছাড়ে সে। তারাপদর এই স্বভাবের বীজটি কি তার শৈশবেই লুকিয়ে আছে? সে পিতা-মাতার চতুর্থ সন্তান। তাকে নিয়ে মোট ভাইবোনের সংখ্যা ৮। শৈশবেই সে পিতৃহীন। 'বহু সন্তানের ঘরেও' স্নেহ-আদরের অভাব তার ছিল না। গ্রামবাসীর কাছেও সে ছিল আদরণীয়। 'গুরুমহাশয়ও তাহাকে মারিত না- মারিলেও বালকের আত্মীয়পর সকলেই তাহাতে বেদনা বোধ করিত। সে 'উপেক্ষিত নয়'। তাহলে কি সব পাওয়ার বেদনাই তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত? 'তাসের দেশ'-এর রাজপুত্রের কথাতেও একই সুর শোনা যায়। 'সকল পাওয়ার মাঝে আমার প্রাণে বেদন বাজে।' নাকি জীবনানন্দের "আট বছর আগের একদিন" কবিতার সেই স্ত্রী-পুত্র পরিবৃত্ত অপার সুখের কাঁটায় স্থির হতে না পারা ছেলেটি, যে জীবনকে হারিয়ে দেয় অহেতুক, অকারণে, স্বেচ্ছায়- তারাপদ ঠিক কার মতো? তারাপদর প্রতিবিম্ব বোধহয় সে স্বয়ং। কিশোর বয়স তার। 'বয়স পনের-ষোলোর অধিক হইবে না।' স্নেহ আদর-প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসার মোহ বন্ধনে আবদ্ধ জীবনে বহু বিচিত্র, বহুস্তরীয় স্বাদের সবটুকু আস্বাদের বয়স তার হয়নি। অথচ সুযোগ ছিল। অনাস্বাদিত জীবনের স্বাদ গ্রহণে। 'ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ' করো বৈরাগ্য সাধনা, উদাসীনতার অধ্যয়ন তারাপদ করেনি। সে স্বভাবজ 'বন্ধনভীরু'। আবার 'সংগীতমুগ্ধ'। 'বিশ্বপ্রকৃতির মর্মে মর্মে রন্ধ্রে রন্ধ্রে এক অনবিচ্ছিন্ন সংগীত অরণ্য দেবতা প্যানের বাঁশির সুরের মতো তাকে ভুলিয়া নিয়ে যায়। সঙ্গীতমুগ্ধতাই তার প্রথম গৃহত্যাগের কারণ- যাত্রার গান তাকে প্রথম ঘর হইতে বিবাগী করিয়া দেয়। আর তার 'বন্ধনভীরু' স্বভাব তাকে স্থায়ী নোঙর ফেলতে দেয় না কোথাও। 'জন্মনক্ষত্র' তাকে গৃহহীন করেছে। জোয়ার-ভাঁটার টানের মতো সে বহতা জীবনের টানে ভেসে বেড়ায় নানা দলের সঙ্গে। কিন্তু কোনো দলের বিশেষত্বই তাকে বেঁধে রাখতে পারে না। 'পাখি কিছু কিছু গান শিখিল এবং একদিন প্রত্যুষে উড়িয়া চলিয়া গেলা।'
মতিলালবাবুর বাড়িতে বছর দুয়েক তারাপদর জীবন প্রকৃতপক্ষে 'দুর্ভেদ্য প্রহেলিকা' সমাধানের অপেক্ষা মাত্র। তার প্রতি ঈর্ষা-বিদ্বেষ, অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশে দিবারাত্র মুখর করে রাখা চারুশশীর নিগূঢ় মনের আসল পরিচয় পেতে সময় লেগেছে তারাপদর। মতিলালবাবু ও অন্নপূর্ণার অত্যধিক আদর ও প্রশ্রয় চারুশশীকে জেদী, খামখেয়ালী করে তুলেছিল। পিতা-মাতার স্নেহ-আদরের ভাগ সে কাউকেই দিতে চায় না। অন্যদিকে তারাপদ সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত ও মুক্তমনা। অপার কৌতূহল আর বিস্ময়ও তার বিশেষত্ব। তাই চারুশশীর অকারণ ঈর্ষা, বিদ্বেষ তাকে কৌতূহলী করেছে। "দীপ্ত নয়না বালিকার' সুতীব্র অসন্তোষ, বিমুখতার রহস্যজাল তাকে আকৃষ্ট করে। চারুশশীর 'স্বাভাবিক সুতীব্রতা তারাপদর নিকটে অত্যন্ত কৌতুকজনক বোধ হইত।' এই কৌতূহলের কারণেই নন্দীগ্রামে তারাপদর নামা হয়ে ওঠে না।
তারাপদ প্রকৃতির সন্তান। নদীপ্রকৃতির মানবরূপ। চিত্রের মধ্য দিয়ে চরিত্রের স্ফুটনের মিতবাক শিল্পরীতি রবীন্দ্র-ছোটগল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। চেহারার সংহত বর্ণনার সাহায্যে লেখক ফুটিয়ে তোলেন চরিত্রের মৌল বৈশিষ্ট্য। সেইসঙ্গে পোষাক-পরিচ্ছদের সীমিত বর্ণনা মিশে অর্থবহ হয়ে ওঠে। তার 'গৌরবর্ণ', দীর্ঘ আয়ত নয়ন, হাস্যময় ওষ্ঠাধারে' দেবদূতের সুললিত, নিষ্পাপ সারল্য। স্বভাবগুণে সে অতি সহজেই সকলের আপনার হয়ে ওঠে। ছুঁয়ে যায় হৃদয়। অন্তর সৌন্দর্যের প্রকাশ তার বাহ্যরূপেও। গল্পকার দুবার প্রত্যক্ষভাবে তারাপদর দৈহিক রূপের প্রত্যক্ষ বর্ণনা করেছেন। প্রথমবার, প্রথম পরিচ্ছেদে। "গৌরবর্ণ ছেলেটিকে বড় সুন্দর দেখিতে। বড়ো বড়ো চক্ষু এবং হাসাময় ওষ্ঠাধারে একটি সুললিত সৌকুমার্য প্রকাশ পাইতেছে। পরিধানে একখানি মলিন ধুতি। অনাবৃত দেহখানি সর্বপ্রকার বাহুল্যবর্জিত, কোনো শিল্পী যেন বহু যত্নে নিখুঁত নিটোল করিয়া গড়িয়া দিয়াছেন। যেন সে পূর্বজন্মে তাপস বালক ছিল এবং নির্মল তপস্যার প্রভাবে তাহার শরীর হইতে শরীরাংশ বহুল পরিমাণে ক্ষয় হইয়া একটি সম্মার্জিত ব্রাহ্মণ্যশ্রী পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে।" তার অপাপবিদ্ধ স্নিগ্ধ মধুর রূপটি দৈহিক সুষমায় প্রতিফলিত। চিত্রের মাধ্যমে ঘটেছে চরিত্রটির স্ফুটন। সেকারণেই সকলেই এই সুন্দর বালকটির প্রতি আকৃষ্ট হয়। প্রেম-ভালোবাসা-স্নেহ অনুভব করে। তারাপদর স্বভাবজ "অসংকোচ" তাকে সকল অবস্থায়, সকলের মধ্যে মিলিয়ে দেয়। অথচ নিজস্বতায় তাকে নজরে পড়ে আলাদা করে। "ছেলেটি সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছা অনুসারে কাজ করে অথচ এমন সহজে করে যে, তাহাতে কোনো প্রকার জেদ বা গোঁ প্রকাশ পায় না'। আবার তার নিঃসঙ্কোচ ব্যবহারে লজ্জার লেশমাত্র দেখা যায় না। তার মুখের 'শুভ্র স্বাভাবিক' অম্লান তারুণ্য মতিলালবাবুর মতো প্রবীণ বিষয়ী মানুষের হৃদয়ও দ্রবীভূত করে।
তারাপদর 'স্নেহহীন স্বাধীনতার' জন্য 'যাযাবর অনিকেত' হৃদয় পুনরায় জেগে ওঠে উদ্দাম বর্ষার রাত্রে। চারুশশীর ঈর্ষাতুর প্রেমের মধ্যে বয়ঃসন্ধিলগ্নের রহস্য দানা বেঁধে ছিল। সেই দুর্বোধ্য রহস্য তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। চারুর 'নিয়ত দৌরাত্ম্য চঞ্চল সৌন্দর্য অলক্ষিতভাবে বন্ধন জাল বিস্তার করেছিল। গল্পকার অনেকগুলি সম্ভাবনার কথাই 'হয়তো' সহযোগে উল্লেখ করেছেন। ঈর্ষাতুরা বালিকাকে বশ করতে না পারা, তার চাঞ্চল্য, দৌরাত্ম্য তারাপদর কাছে কৌতূহল সৃষ্টি করেছিল। রহস্যসমাধানে তার কৌতূহলের নিবৃত্তি। প্রসঙ্গত, 'সোনার তরী' কাব্যের 'দুই পাখি' কবিতার বনের পাখিটির কথা মনে আসে। তারাপদ যেন তারই প্রতিরূপ। চারুশশীর উপস্থিতি তার নির্লিপ্ত মুক্ত মনে 'ক্ষণকালের জন্য বিদ্যুৎস্পন্দনের' মতো 'অপূর্ব চাঞ্চল্য সঞ্চার' করতে লাগল। নির্লিপ্ত হৃদয়ে কী লাগল প্রেমের ঢেউ? বন্ধনের মধ্যেও আছে মুক্তির স্বাদ, অপার আনন্দ। তারাপদ নিজের অন্তরের গূঢ় পরিবর্তন অনুভব করতে পারে। 'আবদ্ধ', 'আসক্তভাব', 'বন্ধনভীরু' মনের কাছে তা 'নূতন স্বপ্নের মতো।' কাঁঠালিয়ার জমিদারবাবুর 'স্নেহপিঞ্জরে' চিরকালের জন্য তারাপদকে আবদ্ধ রাখার আয়োজন শুরু হল। বিবাহের প্রস্তুতি। চারুর সঙ্গে। দিন স্থির। শ্রাবণ মাসে গোপনতা-প্রিয় মতিলালবাবু তা জানতে দিলেন না তারাপদকে। কিন্তু তারাপদর সদ্য জাগ্রত প্রেমচেতনা জমিদার বাড়ির বিবাহ আয়োজনের বিপুল আড়ম্বরের মাঝে 'প্রতিরোধহীন নীরবতায় ভেঙে স্রোতে ভেসে গেল'। তারাপদও রক্ত-মাংসের মানুষ। কামনার রাঙা রাগে 'অধিকতর রঙিন', স্বতন্ত্র 'কল্পনালোক' সৃজিত হলেও তা স্থায়ী হওয়ার পূর্বেই নববর্ষার মেঘ-মেদুর জ্যোৎস্না-সন্ধ্যায় জলজীবনের হাতছানি তার হৃদয়ের মৌন নির্জন দেশকে আন্দোলিত করে তুলল। 'স্নেহ-প্রেম-বন্ধুত্বের ষড়যন্ত্রবন্ধন' তাকে 'সম্পূর্ণরূপে ঘিরিবার পূর্বেই সমস্ত গ্রামের হৃদয়খানি চুরি করিয়া একদা বর্ষার মেঘান্ধকার রাত্রে এই ব্রাহ্মণ বালক আসক্তিবিহীন উদাসীন জননী বিশ্বপৃথিবীর নিকটে চলিয়া গিয়াছে'। "গ্রামের হৃদয়খানির মধ্যে তো চারুর হৃদয়ও ছিল। খাঁচার পাখির সঙ্গে বিবাদ না থাকলেও, মুক্তির আনন্দ আর বদ্ধতার ভয় তারাপদকে পুনরায় ফিরিয়ে নিয়ে গেল তার পথের জগতে। অনির্দেশ্যের উদ্দেশ্যে।
কোন মন্তব্য নেই
ok