Translate

মিছিলের মুখ: সুভাষ মুখোপাধ‍্যায়


 

মিছিলের মুখ: সুভাষ মুখোপাধ‍্যায়

নতুন দেশ-নায়কের সন্ধানে।


বাংলা কাব‍্য জগতে চল্লিশের দশকের কবি হলেন সুভাষ মুখোপাধ‍্যায়। কবিতায় যাঁরা কম্যুনিষ্ট আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাদের মধ্যে অন্যতম। রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার বীজ বুনে কবিতাকে পার্টির ইস্তাহার নয়, শিল্পের বিচারে উত্তীর্ণ করার সকল প্রয়াস, অন্তত এই কবিতায় লক্ষ্য করা যায়।

 

কবি সুভাষ সাম্যের মন্ত্রে সমাজের পরিকাঠামোর পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যে পরিবর্তনের মূলে আছে নবযুগের স্বপ্ন-

 

‘কমরেড, আজ নবযুগ আনবে না?

কুয়াশা কঠিন বাসর হে সম্মুখে।

লাল উল্কিতে পরস্পরকে চেনা-

দলে টানো হতবুদ্ধি ত্রিশঙ্কুকে,

কমরেড আজ নবযুগ আনবে না?’

 

নতুন যুগ ও নূতন সভ্যতার পত্তন করতে গেলে প্রয়োজন পুরানো সমাজকে ভেঙে ফেলা। যারা নূতন সমাজ গড়ে তুলবে তারা শ্রমজীবী জনগণ। সেই জনগনের উল্লাসে কবির প্রতিশ্রুতি--

 

‘শপথ আমার; মৃত্যুর সাথে একটি কড়ার

আত্মদানের স্বপ্ন একটি পৃথিবী গড়ার।‘

 

এইসব স্বপ্ন আর প্রতিশ্রুতির কারণেই জনগণ সমবেত হয়। ক্ষোভ-বিক্ষোভ, প্রতিষ্ঠান বিরোধী মিছিলের পদবিক্ষেপে পা-মেলায় জনতা। কিন্তু জনতার চালক জনতা নয়। তারা চালিত হয় একজন নায়কের দ্বারা। যিনি হাজার জনতার ভিড়েও নিজেকে সপ্রতিভ রাখবেন। যিনি মিছিলের অন্তর্গত কিন্তু মহামিছিলের মধ্যেও তাঁর অস্তিত্ব প্রমাণিত। যিনি জনগণের সঙ্গে একাত্ম কিন্তু তাঁদের থেকে পৃথক। যেন আগুনের ভেতর অন্যতর আগুন। মানবতাবাদী, সাম্যবাদী কবি সেই মুখ খুঁজে বেড়ান সর্বদা।

 

বিস্রস্ত কয়েকটি কেশাগ্র

আগুনের শিখার মত হাওয়ায় কম্পমান।

ময়দানে মিশে গেলেও

ঝঞ্জাক্ষুব্ধ জনসমুদ্রের ফেনিল চূড়ায়

আধুনিক বাংলা কবিতা: কালান্তরে

                                 ফসফরাসের মত জ্বলজ্বল করতে থাকল

মিছিলের সেই মুখ।’

 

প্রত্যাশিত নায়কের যে বিশ্বস্ত ছবি, কবি আঁকলেন, তাঁকে জনগণ নেতারূপে বরণ করে নেবে নতশিরে। যে আগুন জ্বালানো হয়েছে এক ব্যক্তি সভার ভেতরে, বাস্তবে কল্পনার মিশে, সেই আগুন যথার্থ নেতাকে আলোকিত করে। "মুষ্ঠিবদ্ধ একটি শাণিত হাত"-এর উচ্চারণ বলে দেয় দুনিয়ার মজদূর ও শ্রমজীবীর প্রকৃত অগ্নিশিখা সেই মুখ।

কিন্তু দুভাগ্যের বিষয় হল-একবার মহামিছিলের অগনন ভিড়ে ও যাঁকে চিহ্নিত করতে পেরে আশ্বস্ত হয়েছিলেন, জনারণ্যের কর্ষিত জমিতে স্বপের বীজ বুনেছিলেন, তাকে আর কোথাও দেখা গেল না। সভা ভেঙে গেলে পায়ে পায়ে মানুষ ছড়িয়ে পড়ল বিস্তৃত ভূমিতে। এবং-

 

‘পায়ে পায়ে হারিয়ে গেল

                                         মিছিলের সেই মুখ’।

 

সেই ছড়িয়ে পড়া বেদনার এবং স্বপ্নভঙ্গের। সমস্ত হাত একসময় ঝুঁকে পড়ল মাটির দিকে। কোথায় মুহূর্তে হারিয়ে গেল সেই মুখ। কবি হন্যে হয়ে সেই মুখ খোঁজেন। ভিড় দেখলেই আশায় বুক বাঁধেন সেই মুখের অন্বেষণে-যদি কোথাও খুঁজে পাই মিছিলের সেই মুখ'।

অথচ চারিদিকে অজস্র, অসংখ্য মুখ। সেই মুখশ্রীতে কোন না কোনো বিশ্বাস জাগানো প্রতিশ্রুতি আছে। তবে সেই মুখ কখনো পূর্ণাঙ্গ স্বপ্ন গড়তে সক্ষম নয়। যে মুখ স্বপ্ন দেখায়, উজ্জীবিত করে তা এ নয়-

 

‘কারো বাঁশির মত নাক ভালো লাগে,

   কারো হরিণের মত চাহনি নেশা ধরায়-

   কিন্তু হাত তাদের নামানো মাটির দিকে,

         ঝঞ্জাক্ষুব্ধ সমুদ্রে জ্বলে ওঠে না তাদের দৃপ্ত মুখ

                                   ফসফরাসের মত’।

 

কবি কি তাহলে যাদের মিছিল দেখেন তাদের কেউ স্বপ্ন জাগায় না। 

‘আমাকে উজ্জীবিত করে সমুদ্রের একটি স্বপ্ন

                                      মিছিলের একটি মুখ’।

 

তবু প্রত্যাশায় মৃত্যু হয় না। স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখে সেই মুখ। অন্যসব মুখেরা প্রসাধনের প্রতিযোগিতায় নামে বীভৎসকে চাপা দেবার চেষ্টা করে। পচা শবের দুর্গন্ধ ঢাকতে গায়ে সুগন্ধি ঢালে। মিছিলের সেই মুখ কবিকে নিষ্কোষিত তরবারির মতো জাগিয়ে তোলে।

‘পচা শবের দুর্গন্ধ ঢাকার জন্যে

                                            গায়ে সুগন্ধি ঢালে,

                                             তখন অপ্রতিদ্বন্ধী সেই মুখ

                                            নিষ্কোষিত, তরবারির মত

জেগে উঠে আমাকে জাগায়’।

 

বিস্মরণের মুহূর্তে, অন্ধকার পৃথিবীর বিকৃতির দিশাহীন পথে যাকে সবচেয়ে বড় বেশী প্রয়োজন সেই মুখ জেগে ওঠে। কবি আত্মার উজ্জীবনের উৎস হয়ে দাঁড়ায়। যে কবি নতুন পৃথিবীর স্বপ্নে বিভোর।

 

এই অন্ধকারেই কবি রচনা করেন এক গোপন ইস্তাহার, জরাজীর্ণ সমাজের ধ্বংস কামনার ডাক দেন। উদ্বেলিত মিছিলে একটি মুখের জন্য একটি শরীর সাজিয়ে তোলেন, যে পুনরায় জেগে উঠবে পৃথিবীকে শৃঙ্খল মুক্ত করবে। অন্তত ডাক দেবে মহামিছিলের সড়ক নির্মাণের।

 

‘আর সমস্ত পৃথিবীর শৃঙ্খলামুক্ত ভালবাসা

দুটি হৃদয়ের সেতুপথে

পারপার করতে পারে’।

 

কবির পৃথিবী কল্পনার পৃথিবী, কিন্তু বামপন্থী-সাম্যবাদী কবির পৃথিবী আকাঙ্ক্ষার। সে আকাঙ্ক্ষায় আছে বিরোধ, বিদ্রোহ। রাষ্ট্রদ্রোহিতাও অন্তত যে রাষ্ট্র, বুর্জোয়াশ্রেণির নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান মাত্র। তাই এই স্বপ্ন নিষিদ্ধ। কবি প্রস্তাবিত ইস্তাহারও নিষিদ্ধ। অথচ কবিকে লালন করতে হয় সেই ইস্তাহারই। ইস্তাহার রচনার মূলে উজ্জীবিত সেই মুখ। সমাজ পরিবর্তনের ভাবনায় বিপ্লবী আত্মা এই ভাবেই ব্যক্তির স্বপ্নকে জনবন্যার ভেতর ছড়িয়ে দেন।

 

প্রশ্নোত্তর আলোচনা –

১) ‘মিছিলের মুখ’ কবিতাটি কোন কাব‍্যগ্রন্থের অন্তর্গত ?

 অগ্নিকোণ

২) ‘মিছিলের মুখ’ কবিতাটি ‘অগ্নিকোণ’ কাব‍্যগ্রন্থের কোন কবিতা ?

 ৪ নং কবিতা

৩) ‘অগ্নিকোণ’ কাব‍্যগ্রন্থটি কাকে উৎসর্গ করা হয় ?

 সিঙ্গাপুরের তিন শহীদ যুবক যাদের ফাঁসি দেওয়া হয়।

৪) ‘মিছিলের মুখ’ কবিতাটির চরণ সংখ‍্যা কত ?

 ৩৮

৫) ‘মিছিলের মুখ’ কবিতায় স্তবক কটি?

 ৫

৬) ‘মিছিলের মুখ’ কবিতায় তৃতীয় স্তবকে কটি চরণ আছে ?

 ৫টি

৭) ‘মিছিলের মুখ’ কবিতায় কোন স্থানের নামের উল্লেখ আছে ?

 ময়দান

৮) ‘মিছিলের মুখ’ কবিতায় ‘মিছিল’ কথাটি কতবার আছে ?

 ৬ বার

৯) উল্লেখিত শব্দসংখ‍্যা –

মিছিলের সেই মুখ – ৩

মিছিলের একটি মুখ – ১

মিছিলে একটি মুখ – ১

১০) ‘মিছিলের মুখ’ কবিতায় মিছিলের সেই মুখ কীসের মতো জ্বলজ্বল করে ?

 ফসফরাসের মতো

১১) ‘মিছিলের মুখ’ কবিতায় কবিকে কে উজ্জীবিত করে ?

 সমুদ্রের একটি স্বপ্ন

১২) ‘মিছিলের মুখ’ কবিতায় কেমন নাক ভালো লাগে ?

 বাঁশির মতো

১৩) ‘মিছিলের মুখ’ কবিতায় উল্লেখিত কেমন চাহনি ভালো লাগে?

 হরিণের মতো

১৪) ‘মিছিলের মুখ’ কবিতায় কীসের দুর্গন্ধ ঢাকার জন‍্য গায়ে সুগন্ধি ঢালা হয় ?

 পচা শবের

১৫) ‘মিছিলের মুখ’ কবিতায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী সেই মুখ কীসের মতো কবিকে জাগায় ?

 নিষ্কোষিত তরবারির মতো

১৬) “_ ইমারতের ভিড় ধ্বসিয়ে দিতে ডাক দিই” – ‘মিছিলের মুখ’ কবিতা অনুযায়ী পূরণ করো।

 জরাজীর্ণ

১৭) ‘মিছিলের মুখ’ কবিতায় প্রথম স্তবকে কয়টি চরণ আছে ?

 ৯ টি

১৮) ” _ কয়েকটি কেশাগ্র” – ‘মিছিলের মুখ’ কবিতা অনুযায়ী পূরণ করো

 বিস্রস্ত

১৯) ‘মিছিলের মুখ’ কবিতায় বিস্রস্ত কেশাগ্র কীসের মতো কম্পমান ?

 আগুনের শিখার মতো

২০) ‘ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সমুদ্র’ এর উল্লেখ ‘মিছিলের মুখ’ কবিতায় কোন স্তবকে আছে ?

 তৃতীয় স্তবকে

২১) ‘মিছিলের মুখ’ কবিতার কোন স্তবকে ‘ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ জনসমুদ্রের উল্লেখ আছে ?

 প্রথম স্তবকে

২২) ‘মিছিলের মুখ’ কবিতায় মুখ কথাটি কতবার আছে ?

 ৯ বার

২৫) ‘অগ্নিকোণ’ কাব‍্যগ্রন্থ কোন সালে প্রকাশিত হয় ?

 ১৯৪৮ সালে

২৬) ‘অগ্নিকোণ’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ কী ?

 দক্ষিণ-পূর্ব দিক

২৭) ‘অগ্নিকোণ’ কাব‍্যগ্রন্থের প্রথম প্রকাশে কটি কবিতা প্রকাশিত হয় ?

 পাঁচটি

২৮) কোন কোন কবিতা নিয়ে ‘অগ্নিকোণ’ কাব‍্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ?

 অগ্নিকোণ, ঝড় আসছে, একটি কবিতার জন‍্য, মিছিলের মুখ ও রামরাম

২৯) ‘অগ্নিকোণ’ কাব‍্যগ্রন্থ লেখার উদ্দেশ‍্য কী ছিল ?

 ১৯৪৮ এর কমিউনিষ্ট পার্টির জন‍্য দৈনিক টাকা তোলা

৩০) ‘মিছিলের মুখ’ কবিতাটি কোন প্রেক্ষাপটে লেখা হয় ?

  কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ। হলে

৩১) ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টি কবে নিষিদ্ধ করা হয় ?

 ১৯৪৮ খ্রি: ২৭শে মার্চ

৩২) ‘মিছিলের মুখ’ কবিতাটি পরে কোন কাব‍্যগ্রন্থে প্রকাশিত হয়?

 চিরকুট

৩৩) ‘মিছিলের মুখ’ কবিতাটি ‘চিরকুট’ কাব‍্যগ্রন্থের কততম কবিতা ?

 ২৭ নং কবিতা

৩৪) ‘চিরকুট’ কাব‍্যটি প্রথম কবে প্রকাশিত হয় ?

 বৈশাখ, ১৩৫৭ বঙ্গাব্দ


কোন মন্তব্য নেই

ok

4x6 থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.