বোধ : কবির জীবনদর্শন
বোধ: জীবনানন্দ দাশ
কবির জীবনদর্শন
তখন সেই
মনের স্বরূপ সন্ধান করতে হয়। মনের রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে দার্শনিকেরা পৌঁছেছেন চৈতন্যলোকে।
সেই চেতনা, যা জড়-জীবকে সমান ভাবে দেখার দৃষ্টি দেয়। কিন্তু কবির কাছে এই দার্শনিক
চেতনা রূপান্তরিত হয় 'বোধে' । অন্তত জীবনানন্দ দাশ বোধ-এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে নেতিবাদের
পথ ধরেছেন। বলেছেন- 
"স্বপ্ন নয়-শান্তি নয়-ভালোবাসা
নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়।”
যে বোধ বা
চেতনার জাগরণে মনে হয় সব কাজ তুচ্ছ, অসার। প্রবল শূন্যতা মন ঘিরে ধরে।
"বোধ”
কবিতা পড়তে গেলে প্রথমেই আমরা এই শূন্যতার, বিচ্ছিন্নতার শিকার হই। দশটি স্তবক জুড়ে
কবি তাঁর বোধের উপলব্ধি জানিয়েছেন। সাধারণ লোকের মতো খাওয়া-ঘুম-সন্তান উৎপাদনে কবির
উৎসাহ নেই। আবার এই অস্বাভাবিক জীবনযাপনে বিড়ম্বিত হয়ে ভাবেন, 'আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা
হতেছি আলাদা?'
কিন্তু আর
পাঁচজনের স্থূল জীবনযাপনে তাঁর আগ্রহ জাগে না, এও সত্য। জন্মমৃত্যুবলয়িত জীবনে কত কিছু
করার আছে, অথচ কিছুই হচ্ছে না। ফলে বিষাদ, অপরাধবোধ কবিকে কষ্ট দেয়। কখনো চাষী, জেলেদের
শ্রমক্লিষ্ট জীবনের অংশীদার হতে চান। কখনো বা মাটির সন্তান হয়ে অগাধ, অবাধ প্রাকৃতিক
জীবন উপভোগ করতে চান। তৃপ্তি বা শান্তি মেলে না। ভাবেন, নারীর কাছে হয়ত তাঁর উদ্ধার
আছে। ভালোবাসতে গিয়ে দেখেন সেখানেও ঘৃণা, উপেক্ষা, ব্যঙ্গ, অনাদর। ভালোবাসার সাধনা
তাই পরিণত হয় 'ধুলো আর কাদা' রূপে। তবু প্রাণের কাছে কবি আশ্রয় চান। হৃদয়ের কাছে জানতে
চান কেন সে তাকে প্রাত্যহিকতার সুখে টেনে নিতে চায়। প্রিয় নারীর মুখ, শিশুর মুখ দেখে
যে আনন্দ তা কি কম কিছু? অথচ এই পার্থিব সুখকরতার পাশে মহাপৃথিবী ও মহাকাশের হাতছানি
কম আকর্ষণীয় নয়। এই পৃথিবী তো 'পচা চালকুমড়ার ছাঁচে' গড়া। তার চেয়ে কবি যেতে চান 'আকাশের
নক্ষত্রের পথ।' যেখানে পার্থিব স্থূলতা, ক্লান্তি, সংশয় নেই।
যুগজুরাক্রান্ত
একটি মানুষের তীব্রদাহ ও প্রশ্নে "বোধ” কবিতা উচ্চকিত। একদিকে মাটি-পৃথিবীর প্রতি
টান, অন্যদিকে অমর্ত্যলোকে গভীরতর আনন্দের সন্ধান এখানে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে। জন্ম,
মৃত্যুর স্বাভাবিকতা মেনেও কবি আরো কিছু চান। তাঁর অন্তর্গত রক্তের ভিতরে 'বিপন্ন বিস্ময়'
খেলা করে। এক মহাজীবনের স্বপ্ন দেখেন; পান না। তাই আলো-অন্ধকারে, জানা-অজানায় যাওয়া-আসা।
তথাকথিত স্বপ্ন, প্রেম, শান্তির বলয় ছেড়ে অনিশ্চিতের দিকে যাওয়া। যে যাত্রাপথের সঙ্গী
শুধু 'বোধ'-এক আলোকদীপ্ত চেতনা।
দশটি স্তবকে
সম্পূর্ণ "বোধ” কবিতায় কবির আত্মরতি যে বিষাদ ও একাকীত্বের সুর সৃষ্টি করেছে,
তা পাঠককে স্পর্শ করে। কবি বলেন-
‘আলো-অন্ধকারে যাই-মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়-কোন এক বোধ কাজ করে;
স্বপ্ন নয়-শান্তি নয়-ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!’
                                                (খ)
এই আলো ও
আঁধারের দ্বন্দ্ব কবির মধ্যে এনেছে দ্বিধা। যার রূপকার্থ ভাঙলে বলা যায় স্পষ্টতা-অস্পষ্টতা,
সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ, সৎ-অসৎ-এর দ্বন্দ্ব কবিকে অস্থির করেছে। কোনটা 'নির্বাচন'
করবেন বুঝতে পারছেন না। জীবনানন্দ সরাসরি কোনো দায়বদ্ধতার কথা বলেন নি। 'সোস্যাল চয়েস'-এর
কথা হয়ত ভেবেছেন। তাই ব্যক্তি আমির দ্বন্দ্ব ও দ্বিধা একমাত্রিক না হয়ে প্রতিনিধিত্বমূলক
হয়েছে। অর্ধসত্য থেকে মুক্তি চেয়ে কবি নির্দিষ্ট পথ খুঁজেছেন। দেখেছেন, সকলেই যাত্রা
করে 'আলোয় আঁধারে'। দ্বিতীয় স্তবকে তাঁর খেদ 'সহজলোকের মতো' ভাষাকথা বলতে পারছেন না।
'কোনো নিশ্চয়তা' তাঁর সামনে নেই। অন্তত নির্বাচন বা চয়ন করেন নি। করতেও চান নি। কী
সেই নিশ্চয়তা? শরীরের স্বাদ', 'প্রাণের আহলাদ' নিয়ে বীজখেতে 'ফসলের আকাঙক্ষায়' থাকা।
পঞ্চম স্তবকে নিজেই এই স্কুল জীবন-যাপনের চিত্র এঁকেছেন--
‘জন্মিয়াছে যারা এই পৃথিবীতে
সন্তানের মতো হয়ে--
সন্তানের জন্ম দিতে দিতে
যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময়’
তাদের হৃদয়
আর মাথার সঙ্গে কবির যোগ নেই। তাই তিনি 'একাকী'। আর এই একাকীত্ব থেকে মুক্তির জন্য
'বোধ'-এর কাছে যাওয়া।
কিন্তু
'বোধ' কেমন? নেতিবাদী ভঙ্গিতে কবি বলেন, তা স্বপ্ন বা শান্তি বা ভালোবাসা নয়। লক্ষণীয়,
এই 'বোধ' প্রথমে 'মাথার ভেতরে' সক্রিয়। পরে 'হৃদয়ের মাঝে' বোধ জন্ম নেয়। ফলে 'সব কাজ
তুচ্ছ হয়-পণ্ড মনে হয়'। হৃদয় যদি মননের, হৃদয় তবে আবেগের উৎস। যে-বোধ হৃদয়ে জন্ম নেয়,
তা কাজ করে মাথার ভিতরে। অর্থাৎ হৃদয়-সর্বস্বতা থেকে কবি মুক্তি চান; হৃদয় থেকে নয়।
যুক্তি-বুদ্ধি সজাগ রাখতে চান বলেই মাথার প্রসঙ্গ এসেছে। কিন্তু হৃদয়াবেগ প্রবল বলেই
কোনো কাজ গুছিয়ে করা যায় না। অন্যদিকে 'বোধ' জানিয়ে দেয় তথাকথিত সাংসারিক কাজ, ভোগসুখ
অতি তুচ্ছ। শুধু দিন যাপনের, শুধু প্রাণ ধারণের আনন্দ বোধহীনদের জন্য। বোধযুক্ত মানুষ
সেখানে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ক্লান্তি বোধ করে। চাওয়া-পাওয়ার আর্তি 'শূন্য মনে হয়।'
সুতরাং যারা সহজ মানুষ, সাধারণ মানুষ তারা 'নিশ্চয়তা' খোঁজে। জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে
বেছে নেয় ভোগময় জীবনকে। যেমনভাবে "আট বছর আগের একদিন" কবিতার বৃদ্ধ পেঁচা,
গলিত স্থবির ব্যাং, মশা 'জীবনের স্রোত' ভালোবাসে। যদিও তাদের মধ্যেও থাকে অন্য জীবনের
আকাঙক্ষা- 'রক্ত-ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি।' কবিও সেই রৌদ্রাভিসারে যেতে
চান। যদিও চেষ্টা করেন, সহজ লোকের মতো জীবনযাপন করতে। তাই 'বোধ'-এর তীব্র প্ররোচনা
সরিয়ে দিতে চান।
‘মড়ার খুলির মতো ধ'রে
আছাড় মারিতে চাই, জীবন্ত মাথার মতো
ঘোরে
তবু সে মাথার চারিপাশে,
তবু সে চোখের চারিপাশে,
তবু সে বুকের চারিপাশে,’
বুদ্ধি,
দৃষ্টি, হৃদয় আচ্ছন্নকরা বোধ থেকে কবির এই মুক্তির ব্যাকুলতা মনে হতে পারে তাঁর বিতৃষ্ণা।
কিন্তু তিনি দেখতে চান, এই বোধ-এর হাত থেকে সচেতন মানুষ মুক্ত হতে পারে না। যেমন পারেনি
'লাসকাটা ঘরে'-র মানুষটি। পরিত্রাণের পথ না-পেয়ে সে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু কবি শেষ
পর্যন্ত বোধ-কে আত্মস্থ করতে চেয়েছেন। তাই সকলের ছন্দে-পছন্দে তাঁর মিল নেই। যদিও অন্যের
চোখে তাঁর এই আচরণ অস্বাভাবিক। কবির মনেও সংশয়-
সকল লোকের
মাঝে ব'সে আমার নিজের মুদ্রাদোষে আমি একা হতেছি আলাদা?
‘আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমার পথেই শুধু বাধা?’
এই প্রশ্নমালার
মধ্যে কবির আত্ম-অন্বেষণ ধরা পড়ে। নিজের জানার মধ্যে বেদনা ও বিচ্ছিন্নতা থাকেই। "ছিন্নপত্রাবলী'তে
রবীন্দ্রনাথ এমনই অনুভবের কথা বলেন- 
           "সকলের মতো হয়ে, সকল মানুষের সঙ্গে
বেশ সহজ ভাবে মিলে মিশে, সহজ আমোদ প্রমোদে আনন্দলাভ করবার জন্যে আমার মনকে আমি প্রতিদিন
দীর্ঘ উপদেশ দিয়ে থাকি, কিন্তু আমার চারদিকেই এমন একটি গণ্ডি আছে, আমি কিছুতেই সে লঙ্ঘন
করতে পারি নে। লোকের মধ্যে আমি একটি নতুন প্রাণী, কিছুতেই তাদের সঙ্গে আমার সঙ্গে সম্পূর্ণ
পরিচয় হয় না।" (১৫৬ সংখ্যক পত্র)
জীবনানন্দ
বলেন, জনগণের সঙ্গে সংযোগ রাখতে তিনিও একসময় উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু তৃপ্তি পাননি।
বিশ্বাসের ভূমি খুঁজে পাননি। কর্মময় পথ বা শ্রমনিষ্ঠ জীবন তাঁর বোধের পূর্ণতা আনে নি।
কাস্তে হাতে মাঠে ঘোরা, জেলেদের সঙ্গে জলে ঘোরা-
‘এইসব স্বাদ
-এসব পেয়েছি আমি;
তবু 'চলে গেছি ইহাদের ছেড়ে।'
কেন? সুধীন্দ্রনাথ
দত্তের অভিমত এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়-"একটা লোকোত্তর পটভূমি না জুটলে কবি তো কবি,
খুব স্থূল অনুভূতির মানুষও বাঁচে না।" (স্বগত)। তাহলে ত্রাণ বা আশ্রয় কোথায়? নারী
ও প্রেম রোমান্টিক কবিদের প্রাণিত করে, আমরা জানি। কিন্তু জীবনানন্দের উপলব্ধি ভিন্নতর।
‘ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
অবহেলা করে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
ঘৃণা করে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে;’
নারী, রমণী,
মহিলার পরিবর্তে 'মেয়েমানুষ' শব্দ প্রয়োগে কবির ঘৃণা, অনাদর ফুটে উঠেছে। যাদের ভালোবাসা
ও উপেক্ষা কবিকে বারংবার এই অভিজ্ঞতা এনে দিয়েছে 'ছিঁড়ে ফেড়ে গেছে প্রেম'। তাই তাঁর
হাহাকার-'উপেক্ষা সে করেছে আমারে'। নক্ষত্রের দোষে প্রেমে ব্যর্থ হয়েও বলেন- 
'তবুও সাধনা ছিল একদিন-এই ভালোবাসা।'
শেষ পর্যন্ত হতাশায় বলতে হয়-
'তবু এই ভালোবাসা-ধুলো আর কাদা।'
বড়ই পার্থিব,
রিরংসাময়, গ্লানিময়। এই প্রেম 'বিলাসের সম্ভাষণ'। নারীর মধ্যে গোটে যে অমৃত পেয়েছেন,
জীবনানন্দ তা পান নি। বরং তাঁকে নিয়ে নারী প্রেমের খেলা খেলেছে। আর শেক্সপীয়রের প্রশ্ন
ছিল কোনো নারীকে কোনোদিন সম্পূর্ণ জানা যায় কিনা-Who is't can read a woman? (দ্র.
Cymbeline/v)
যখন প্রেমেও আশ্রয় নেই, তখন মাথার ভিতরে 'বোধ কাজ করে'। যে জানতে চায়, জীবন অনেক বড়ো। তথাকথিত কর্মজগৎ, যৌন জগৎ বা প্রেমের জগতে আবদ্ধ থাকা যথেষ্ট নয়। তাই-
 "আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি।"
হৃদয়কে কবি
ভর্ৎসনা করে বলেন: 'সে কেন জলের মতো একা ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়।' হৃদয় সর্বস্বতার এই
ভাবাবেগ থেকে কবি মুক্ত হতে চান। ভালোবাসা-বাসির গতানুগতিক নাট্যাভিনয়ে ক্লান্তি বোধ
করেন। হৃদয়ের কাছে জানতে চান-
'অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়?'
কবির প্রশ্ন:- ‘এই বোধ-শুধু এই স্বাদ
পায় সে কি অগাধ-অগাধ!’
"আট
বছর আগের একদিন" কবিতার বোধসম্পন্ন মানুষটিও বুঝেছিল- 
"নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয়
সবখানি।"
তার রক্তের
গভীরে তাই খেলা করে 'বিপন্ন বিস্ময়।' এখানে কবি হৃদয় বা হৃদয়সর্বস্ব মানুষের কাছে জানতে
চান-
‘পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের
পথ চায় না সে?
করেছে শপথ দেখিবে সে মানুষীর মুখ?
দেখিবে সে মানুষের মুখ?
দেখিবে সে শিশুদের মুখ?’
কিন্তু এই
দর্শন যতই রম্য হোক না কেন, কবি জানেন, সেখানে আছে 'চোখে কালো শিরার অসুখ' এবং বধিরতা,
কুঁজ, গলগণ্ড। আর সেই সাধের হৃদয়ও 'নষ্টশসা-পচা চালকুমড়ার ছাঁচে' তৈরি। সেখানে যা জন্ম
নেয় সবই বাসি, মেকি, নষ্ট। তাই কবি যেতে চান তাঁর বোধের কাছে। বোদলেয়ার কথিত
'spleen' ও 'Ennui' শব্দ জীবনানন্দের ক্ষেত্রে ক্লান্তি, বিষাদ, কুশ্রীতা হয়ে এসেছে।
হয়ত বা কবি ইয়েন্সের 'The Circus Animals' কবিতার ছায়াও এখানে পাই। তবু 'বোধ' জীবনানন্দের
নিজস্ব অনুভব। যেন এক 'জ্বলন্ত রুমাল' বুকের কাছে নিয়ে জীবনযাপন করা। 
'সে কেন জলের মতো ঘুরে-ঘুরে একা কথা কয়!'-
উৎস ও অনুষঙ্গ নির্দেশ করে চিত্রকল্পটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।
আলোচ্য অংশটি কবি জীবনানন্দ দাশের 'ধূসর পাণ্ডুলিপি' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত 'বোধ' কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। হৃদয় সর্বস্বতার এক গভীর ভাবাবেগ প্রকাশিত হয়েছে এখানে। বিষাদ ও একাকীত্বে পীড়িত কবি জীবনানন্দ বোধের স্বরূপ বিশ্লেষণ ও তার প্রতিক্রিয়া বর্ণনা প্রসঙ্গে কথাগুলি বলেছেন।
বোধাক্রান্ত কবি প্রেমের স্নিগ্ধ ছায়ায় আশ্রয় নিতে ব্যর্থ হন। কবি এই জীবনকে অনেক বড় করে দেখেন। পার্থিব কর্মজগৎ, যৌনজগতে আবদ্ধ থাকতে পারেন না। তাই সব দেবতাকে ছেড়ে প্রাণের কাছে আসেন। তখনই হৃদয়কে ভর্ৎসনা করেন। হৃদয় সর্বস্বতার ভাবাবেগকে মুক্তি দিতে চান। প্রেম-ভালোবাসার অভিনয়ে কবি ক্লান্তি অনুভব করেন। কবি তাই আত্ম জিজ্ঞাসায় মগ্ন হয়ে ভাবেন হৃদয়ের কি কোন অবসাদ নেই। শান্তির সময় নেই। চেতনার প্রবাহকে বহির্বিশ্ব থেকে অন্তর্জগতে নিয়ে জলের চিত্রকল্পের সঙ্গে বোধের তুলনা দিয়েছেন কবি। 'জলে মতো ঘুরে ঘুরে' কথা বলা জীবনানন্দের কাব্যে প্রথম দৃষ্টান্ত। ভাব ও ভাষার সাযুজ্য চমৎকার ভাবেই প্রকাশিত। কবির হৃদয়ে বোধ আসে নীরবে, নিঃশব্দে, অবারিত ও অবিরত ভাবে। নদী ও সমুদ্রের জল নিরন্তর অবিরত পাক খেয়ে নিঃশব্দে প্রবাহিত হয়। বোধ সেইরকম কবিহৃদয়ে একাই ক্লান্তিহীনভাবে কথা বলে যায়। আর এর প্রভাবে কবিমন নিঃসঙ্গ, একাকীত্ব ও বিষাদে ভরে যায়। কবি সহজ সরল সুখ ও শান্তির জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। স্বপ্ন, শান্তি ও ভালোবাসার সহজ অনুভূতিগুলি কবির কাছে অধরাই থেকে যায়। জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে গিয়ে তৃপ্তি পাননি। বিশ্বাসের মাটিকে সন্ধান করেও পাননি। কর্মময় পথ বা শ্রমনিষ্ঠ জীবন পূর্ণ করেনি কবিকে। নারীর প্রেমে, অনুরাগ বিরাগ, ঘৃণা তাঁকে শান্তি দেয়নি এই বোধ। তাই স্বপ্ন-শান্তি ভালোবাসা নয়। প্রথমে মাথার ভিতরে ও পরে হৃদয়ে বোধ জন্ম নেয়। হৃদয় ও মনে আবেগ সৃষ্টি হয়। এই বোধ হৃদয়ে জন্ম নিয়ে মাথার ভিতর কাজ করে। কবি হৃদয় থেকে মুক্তি না চাইলেও হৃদয়সর্বস্বতা থেকে মুক্তি চান। বুদ্ধি যুক্তি সবকিছু মাথার ভিতরে সুসজ্জিত হয়ে একটি মানুষকে কর্মে পরিচালিত করে। এই হৃদয়াবেগ থাকার জন্য কোন কাজ কবি নিরুদ্বিগ্ন ও সুষ্ঠভাবে করতে পারেন না। আবার এই বোধই সাংসারিক ভোগ সুখ থেকে মুক্ত করে মহাজীবনের স্বপ্ন দেখায়। দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে ক্লান্তিতে ভরিয়ে তোলে। বোধাক্রান্ত কবি অমর্ত্যলোকে আনন্দের সন্ধান করতে ও পৃথিবীর প্রতি গভীর আকর্ষণের দ্বন্দে পীড়িত হন।
শূন্যতা ও বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত কবি তাই হৃদয় সর্বস্বতা থেকে মুক্ত হতে চান।
==============


 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
কোন মন্তব্য নেই
ok