বধূ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর by Dr.Nilotpal Jana
বধূ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
'বধূ' কবিতাটি রচিত হয় ১২৯৫ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ। পরে ঐ সালের ৭ই কার্তিক শান্তিনিকেতনে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান রূপ লাভ করে। এই কবিতাটি 'সঞ্চয়িতা' গ্রন্থে স্থান পেয়েছে, এবং এ থেকে বোঝা যায় এটি কবির প্রিয় ছিল।
এই কবিতটিতে কবির Human interest গভীরভাবে ধরা পড়েছে। বঙ্গের বধু সম্পর্কে কবি যে কতটা মানবিক ছিলেন; তাঁর ছোটগল্প 'সমাপ্তি' এবং 'শাস্তি'তে যেভাবে ধরা পড়েছে, 'বধূ' কবিতায়ও তার পরিচয় মেলে। এই কবিতার মধ্যে কোনো গূঢ় তত্ত্ব নেই; সম্পূর্ণ মানবিক সংবেদনা দিয়ে সরল, নির্যাতিতা বধুর সীমাবদ্ধ জীবনের করুণ চিত্র অঙ্কন করেছেন। এই কবিতার মধ্যে আছে এক পল্লী কিশোরী বালিকার মহানগরের কৃত্রিম জীবনে আত্মিক অবক্ষয় ও মানবিকতার অপমৃত্যুর সকরুণ চিত্র।
উদার পল্লী প্রকৃতির কোল থেকে বিবাহ সূত্রে বালিকার আগমন ঘটেছে মহানগরে। প্রতিবেশীহীন এই মহানগরে বালিকা বধূটি একা হয়ে গেছে ফলে উদার মুক্ত জীবন তার কাছে বিষময় হয়ে উঠেছে। বধূটি বলে উঠেছে-
কোথা সে ছায়া সখী, কোথা সে জল।
কোথা সে বাঁধা ঘাট, অশথতল!
বধুটির আরো মনে পড়েছে-
কলসী লয়ে কাঁখে, পথ সে বাঁকা-
বামেতে মাঠ শুধু সদাই করে ধু ধু
ডাহিনে বাঁশ বন হেলায় শাখা।
দিঘির কালো জলে সাঁঝের আলো ঝলে
দুধারে ঘন বন ছায়ায় ঢাকা।
গভীর থির নীরে ভাসিয়া যাই ধীরে,
পিক কুহরে তীরে অমিয় মাখা।
পথে আসিতে ফিরে, আঁধার তরুশিরে
সহসা দেখি চাঁদ আকাশে আঁকা।
এইভাবে বধূটি তাঁর মন থেকে সেই গ্রামবাংলার সহজ সরল চিত্রগুলিকে ভুলতে পারেনি ক্রমশ বলে চলেছে। কিন্তু এরই বিপরীতে গড়িয়ে চলেছে মহানগরের জটিল জীবনযাত্রা। কবি বলেছেন-
হায় রে রাজধানী পাষাণকায়া।
বিরাট মুঠিতলে চাপিছে দৃঢ়বলে
ব্যাকুল বালিকারে নাহিকো মায়া।
বধূটি কিছুদিন শহরে থেকে বুঝে ফেলেছে নগরের মানুষ হলো আত্মকেন্দ্রিক, উদাসীন।
বধূটির উক্তি-
হেথায় বৃথা কঁদো দেয়ালে পেয়ে বাধা
কাঁদন ফিরে আসে আপন-কাছে।
নগরের কেউই বধূটির মনের খবর বোঝে না, বিচার করে তার বাহ্য রূপ নিয়ে-
কেহ বা দেখে মুখে, কেহ বা দেহ-
কেহ বা ভালো বলে বলে না কেহ।
ফুলের মালাগাছি বিকাতে আসিয়াছি
পরখ করে সবে করে না স্নেহ।
এ কারণেই বধূটি সকলের কাছে থেকেও একাকিত্ব বোধ করেছে।
সবার মাঝে আমি ফিরি একেলা।
কেমন করে কাটে সারাটা বেলা!
ইটের 'পরে ইট মাঝে মানুষ কীট-
নাইকো ভালোবাসা, নাইকো খেলা।
এর জন্যই হৃদয়হীন এই মহানগরে বধূটির পক্ষে থাকা খুবই কষ্টকর। এইভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে তাঁর মৃত্যু শ্রেয় বলে মনে করেন।
দেবে না ভালোবাসা দেবে না আলো।
সদাই মনে হয়- আঁধার ছায়াময়
দিঘির সেই জল শীতল কালো
তাহারি কোলে গিয়ে মরণ ভালো।
কবিতাটি এখানেই Tragic হয়ে উঠেছে। কবিতাটির মধ্যে কবির অসীম প্রকৃতি চেতনা এবং গ্রামজীবনের প্রতি মমত্ব প্রকাশিত হয়েছে। কবিতাটির মধ্যে Tragic রসের পাশাপাশি রোমান্টিকতা প্রকাশিত। কবিতার মধ্যে যে বিষণ্ণতার সুর প্রকাশিত গীতিকবিতার মর্যাদা লাভে তা সক্ষম হতে পারে।
২.
প্রকৃতির প্রতি মমতা রবীন্দ্রনাথের কবিস্বভাবের বৈশিষ্ট্য। দীর্ঘ কবিজীবনে প্রকৃতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন নানাভাবে ও নানারূপে। 'বধূ' কবিতায় প্রকৃতি সম্পর্কিত দার্শনিক উপলব্ধি প্রকাশ পায়নি, বরং গভীর প্রকৃতিপ্রীতি ও রোমান্টিক উপলব্ধি প্রকাশ পেয়েছে। এখানে গ্রাম্য বধূর জবানীতে কবির জীবনের উপলব্ধি ও মানসিকতা প্রতিবিম্বিত হয়েছে। 'জীবনস্মৃতি'তে কবি বলেছেন- "বাড়ির বাহিরে আমাদের যাওয়া বারণ ছিল... সেইজন্য বিশ্বপ্রকৃতিকে আড়াল-আবডাল হইতে দেখিতাম। বাহির বলিয়া একটি অনন্ত প্রসারিত পদার্থ ছিল যাহা আমার অতীত, অথচ যাহার রূপ শব্দ গন্ধ দ্বারা জানালার নানা ফাঁকফুকুর দিয়া এদিক ওদিক হইতে আমাকে চকিতে ছুইয়া যাইত। ...সে ছিল মুক্ত, আমি ছিলাম বন্ধ মিলনের উপায় ছিল না, সেইজন্য প্রণয়ের আকর্ষণ ছিল প্রবল।" কবির কিশোর বয়সে বন্দী জীবনের স্মৃতি ও প্রকৃতির প্রতি বিরহবোধ থেকে বোধ হয় 'বন্ধু' কবিতা রচনার প্রেরণা।
'বধূ' কবিতার বধূটি একটি গ্রাম্য বালিকা। কলকাতায় তার বিয়ে হয়েছে ফলে আজন্ম-লালিত যে গ্রাম, তাকে ছাড়তে হয়েছে। রাজধানীর গণ্ডীবদ্ধ সংকীর্ণ, নিষ্প্রাণ পরিবেশে বালিকার যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে। চারদিকে ইট কাঠ আর মানুষের স্তূপ: খেলার মাঠ নেই, সবুজ প্রকৃতি নেই, পাখির গানও নেই। শুধু এই প্রকৃতির অভাব নয়, মানুষের মধ্যে প্রীতি-মমতার অভাবও বধূটির মানসিক পীড়ার অন্যতম কারণ। সকলের মধ্যে থেকেও বধূটি একা। এখানে স্নেহ নেই, ভালোবাসা নেই। বধূটির চোখে জল দেখে প্রতিবেশী ও আত্মীয়রা অবাক হয়ে দেখে, কেউ তার ভিতরটা পরখ করে দেখে না।
যখন বিকেল বেলা চারদিকে গাঢ় ছায়া নেমে আসে তখন বন্ধুটির অবচেতনে ছায়া ফেলে গ্রামসখীদের পুরানো সুরের ডাক- 'বেলা যে পড়ে এল, জল্কে চল্'। তখন প্রত্যহ সখীদের সঙ্গে দিঘিতে জল আনতে যেত, ফেরার সময় আকাশের চাঁদ দেখতো। সে দেখতো সকালে ঘাসের ডগায় শিশির ঝিকমিক করতে, দেখতো ধু-ধু মাঠ জুড়ে সারি সারি তালগাছ।
এখন শহরের বন্দী জীবনের মধ্যে বারবার মনে পড়ছে মায়ের স্নেহ মমতার কথা। মায়ের জন্য তার হৃদয় কেঁপে উঠছে, কারণ বাড়ির ছাদে বসে মা আকাশের চাঁদ দেখাতো, রূপকথা শোনাতো, তার জন্য মঙ্গল কামনা করে দেবতার উদ্দেশ্যে ফুল নিবেদন করত। এখন তার এই গণ্ডীবদ্ধ জীবন খুবই দুর্বিষহ। তার মনে হয় এর চেয়ে গ্রামের দিঘির শীতল কালো জলে সে যদি মরতে পারত তাহলে ভালো হত।


কোন মন্তব্য নেই
ok