"প্রভাতসংগীত" কাব্যের 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ'। ড. নীলোৎপল জানা ।।
নির্বাচিত কবিতার আলোচনা
ক।। "প্রভাতসংগীত" কাব্যের 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ'।
'প্রভাতসংগীত' কাব্যের রচনার সময় ১২৮৮ বঙ্গাব্দের চৈত্র থেকে ১২৮৯ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসের মধ্যে। কাব্যের প্রকাশ ১২৯০ অর্থাৎ ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে। এই কাব্যের শ্রেষ্ট কবিতা 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ' যা 'সঞ্চয়িতা'য় স্থান পেয়েছে।
ভারতী পত্রিকায় ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের অগ্রহায়ণ সংখ্যায় 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ' কবিতাটি প্রথম মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হয়। কবিতার উৎস সম্পর্কে বলতে গিয়ে কবি 'জীবনস্মৃতি' গ্রন্থের 'প্রভাতসংগীত' অধ্যায়ে বলেছেন- "সদর স্ট্রীটের রাস্তাটা যেখানে গিয়া শেষ হইয়াছে সেখানেই বোধ করি ফ্রি-স্কুলের বাগানের গাছ দেখা যায়। একদিন সকালে বারান্দায় দাঁড়াইয়া আমি সেই দিকে চাহিলাম। যখন সেই গাছগুলির পল্লবান্তরাল হইতে সূর্যোদয় হইতেছিল। চাহিয়া থাকিতে থাকিতে হঠাৎ এক মুহূর্তের মধ্যে আমার চোখের উপর হইতে যেন একটা পর্দা সরিয়া গেল। দেখিলাম একটি অপরূপ মহিমায় বিশ্বসংসার সমাচ্ছন্ন, আনন্দে এবং সৌন্দর্যে সর্বত্রই তরঙ্গিত। আমার হৃদয়ে স্তরে স্তরে যে একটা বিষাদের আচ্ছাদন ছিল তাহা এক নিমেষেই ভেদ করিয়া আমার সমস্ত-ভিতরটা বিশ্বের আলোক একেবারে বিচ্ছুরিত হইয়া পড়িল। সেই দিনই 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ' কবিতাটি নির্ঝরের মতোই যেন উৎসারিত হইয়া বহিয়া চলিল।" (বিশ্বভারতী সংস্কারণ-১৯৭৪)।
এর পরেও কবি আরো বললেন-
"লেখা শেষ হইয়া গেল কিন্তু জগতের সেই আনন্দরূপের উপর তখনো যবনিকা পড়িয়া গেল না।"
'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ' কবিতার মধ্যদিয়ে 'প্রভাতসংগীত' কাব্যের মূল সুর প্রকাশিত হয়েছে। 'প্রভাতসংগীত' যেন কবি প্রতিভার প্রথম উন্মেষ বা জাগরণ। ক্ষুদ্র আমির পাথর চাপা গুহা হতে কবি মন বৃহত্তর বিশ্বে, সত্যের জগতে মুক্তিলাভ করলেন।
পাহাড়ের বুকে অবরুদ্ধ নির্ঝর যেমন একসময় প্লাবনতৈরী করে, তেমনি অন্ধকার হৃদয়ারণ্যে পথভ্রষ্ট হয়ে ঘুরেছিলেন; হঠাৎ প্রভাতের সূর্যোদয় বহির্জগতের রাজপথে নামিয়ে দিল, কবি অধিক আগ্রহে জগতের মুখ দেখলেন। যে নির্জন রুদ্ধ গুহায় কোনো শব্দই প্রবেশের পথ পেতো না, সেখানে প্রভাত পাখির গান হয়েছে অনুরণিত।
প্রভাতের আগমনে যেমন পৃথিবী নতুন রূপে জেগে ওঠে তেমনি কবির হৃদয় উঠেছে জেগে, হয়েছে আবেগঘণ। আবেগের তীব্রতায় আপন প্রাণের বাসনাকে কবি আর রোধ করে রাখতে সমর্থ হননি, তাই কবিতার পরবর্তী অংশে রয়েছে তারই প্রতিক্রিয়া। পর্বত কাঁপছে থরথর করে, প্রবল ভূমিকম্পে রাশি রাশি শিলা পড়েছে খসে, সমুদ্র নিদারূণ রুষ্টভাবে ফেনায়িত হয়ে উঠেছে। এভাবেই কবি হৃদয়ের জাগরণ লক্ষ্য করা যায়।
কবির প্রাণের অভ্যন্তরে জাগরণ ঘটেছে, পথ খুঁজছেন সেখান থেকে বেরুবার, পথ খুঁজে পাননি। তাই লিখলেন- "হেথায় হোথায় পাগলের প্রায় ঘুরিয়া ঘুরিয়া মাতিয়া বেড়ায়-বাহিরিতে চায়, দেখিতে না পায় কোথায় কারার দ্বার।"
এই অন্বেষণ, কবি হৃদয়ের পথের অন্বেষণ, তার আর বুঝতে অসুবিধা থাকে না। প্রসঙ্গ ত মনে হয় কবি বিহারীলালের ভাবশিষ্য রবীন্দ্রনাথের উপর সারদা অন্বেষণের ছায়া পড়েছে।
কবিতার পরবর্তী অংশে দেখা যায় কবির রুদ্ধ আবেগ বাহিরে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে না পেয়ে ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছে। ক্ষোভ ঝরে পড়েছে বিধাতার উপর। বিধাতা যেন কঠিন প্রস্তরের বাঁধন দিয়ে রেখেছে চারিদিক, কবি সেই বাঁধন ছিন্ন করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন-
"ভাঁঙরে হৃদয় ভাঙরে বাঁধন সাধরে আজিকে প্রাণের সাধন লহরীর পরে লহরী তুলিয়া আঘাতের পরে আঘাত কর।"
মনও হৃদয় যখন মত্ত হয়ে ওঠে তখন অম্লকার, বাঁধন কোনো কিছুই মানুষকে প্রতিরোধ করতে পারে না। মানুষের বাসনা যখন তীব্র হয়ে ওঠে তখন আর তাকে আটকানো যায় না, সে সাফল্য পাবেই পাবে। কবি যেন এখানে পুরুষকারের উপর জোর দিয়েছেন। মানুষের চেষ্টা ও আন্তরিকতা তাকে সাফল্য দেবেই, দেবে।
কবিতার পরবর্তী অংশে দেখা যায় হৃদয় আবেগের প্রাবল্যে বোধগুলি কোন পথ দিয়ে মুক্তি পাবে তা ভেবে কবি অস্থির। অর্থাৎ এক অবরুদ্ধ ভাব, প্রকাশের আকাঙ্ক্ষায় প্রহর গুণছে, সমগ্র বিশ্বব্যাপী ঢেলে দেবেন করুণার স্নিগ্ধ ধারা। কবির বাসনা তিনি জগৎকে প্লাবিত করে পাগলের মত ঘুরে বেড়াবেন গান গেয়ে। চলার সময় এলিয়ে পড়বে তার চুল; ফুলকুড়িয়ে, রামধনু আঁকা পাখা উড়িয়ে সূর্যের অমৃত কিরণে হাসি ছড়িয়ে ঘুরে বেড়াবেন। কবি কখনো হয়ে উঠেছেন দুর্বার ঝর্ণা আবার কখনো আত্মপ্রকাশের উন্মুখ এক ব্যক্তিত্ব।
নির্ঝরের আশা হলো শিখর থেকে শিখরে ছুটে যাওয়া। এর কারণ, জমে থাকা অনেক কথা প্রকাশের আশায়। তেমনি কবির অন্তরেও জমে থাকা অনেক কথা প্রকাশের জন্য ব্যাকুল ছিল, আজ তা প্রকাশিত হতে পেরেছে। কবিতার শেষাংশে তাই লক্ষ্য করা যায় মুক্তির বার্তা। কবির এই প্রাণের মুক্তি ঘটেছে যে যে কারণে, তা হলো-
ক) প্রভাত রবির কিরণ।
খ) প্রভাত পাখির গান।
দীর্ঘ দিন ধরে কবি যেন কারাগারের মধ্যে বদ্ধ ছিলেন, আজ সেই বদ্ধ জীবন থেকে মুক্তির ডাক এসে পৌঁচেছে, তাই তাঁর ঘোষণা-
"ভাঙ্ ভাঙ্ ভাঙ্ কারা আঘাতে আঘাত কর্। ওরে আজ কী গান গেয়েছে পাখি, এসেছে রবির কর।।"


কোন মন্তব্য নেই
ok