ব্রতের সংজ্ঞা ও উপাচার : ড. নীলোৎপল জানা
ব্রতের সংজ্ঞা ও
উপাচার
এই বাংলায় এমন কোনো মাস নাই যে মাসে একটাও
ব্রত নেই। মানুষের কামনা বাসনা পূরণের জন্য কৃত সম্পাদনই ব্রত। কোনো কিছুর উদ্দেশ্যে
নারী সমাজ আন্তরিকভাবে যে সকল ক্রিয়াচার পালন করে তাই হল ব্রত। (শাস্ত্রে স্ত্রী-পুরুষ
নির্বিশেষে ব্রত উদযাপনের কথা বলা আছে) প্রাচ্যতত্ত্ববিদ যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি
লিখেছেন—"পূজা মাত্রই ব্রত, ব্রত মাত্রই সংকল্প প্রধান। ব্রত ধারণ দ্বারা আত্মার
প্রসন্নতা হয় চিত্তের সংযম অভ্যাস হয়, ইস্টের প্রতি একাগ্র ভক্তি এবং সমুদয় নরনারীর
প্রতি উদারভাব জাগ্রত হয়...ব্রত মাতই দেবার্চনা আছে, দেবার্চনা মাত্রই ব্রত” (বারোমাসে
তেরো পার্বণ, বঙ্গদর্পণ, প্রথম পৃঃ২৩৫) ‘অমরকোষ’
টীকায় দেখা যায় শাস্ত্র বিহিত নিয়ম ও উপবাসাদি লক্ষনান্বিত ধর্মাচরণকেই ব্রত বলা
হয়। আসলে মানুষ বাস্তববাদী তাই জগতের কল্যাণ নিয়েই তার যত মাথাব্যথা। মুক্তি, মোখ্য,
স্বর্গলাভ, অভিলাপ মুক্ত জীবন লাভই ব্রত উৎযাপনের সঙ্গে যুক্ত। বাংলার ব্রতগ্রন্থে
অবনীন্দ্রনাথ বলেছেন—" বিচিত্র অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মানুষ বিচিত্র কামনা সফল
করতে চাচ্ছে, এই হল ব্রত”।
যেখানে মানুষের ব্রত পালনের কথা আসছে সেখানে ব্রতে শুধু নারীর অধিকার আছে বা
নারীর প্রাধান্য এই ভাবনা কিভাবে সমাজে বদ্ধমূল হল। দ্বাদশ শতাব্দীর ‘আর্যসপ্তশতী’
গ্রন্থে আছে- মেয়েরা হল বাড়ির শ্রী অর্থাৎ বাড়ির সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনায় নারীর
জুড়ি মেলা ভার। ব্রতীর মাধ্যমে মহিলারা দুই পরিবারের কল্যাণ কামনায় ব্যস্ত থাকে।
নারী মাত্রেই মা। এই পৃথিবীর সমস্ত জীব মায়েরই সন্তান। অতএব সন্তানের মঙ্গল কামনা
নারীরাই করতে পারে। তাই বলা হয়েছে ‘গৃহিণী গৃহমুচ্ছতে’ বা ‘সংসার সুখের হয় রমনীর
গুণে’ ইত্যাদি ভাবনা থেকেই ব্রতে নারীর ভূমিকা প্রাধান্য পেয়েছে বলে মনে হয়।
এই ব্রত পালনই নারী স্বাধীনতার প্রথম সোপান বলা যেতে পারে কারণ এই ব্রত পালনে
মহিলারা স্বাবলম্বী ভূমিকা পালন করে এতে উপাচারের কোনো বাহুল্য নেই। বাড়িতে সহজলভ্য
উপাচারে ব্রত উদযাপিত হয় যা নারীরা সহজে সংগ্রহ করতে পারে। পুরুষের কোনো প্রয়োজন
এতে পড়ে না, ব্রাহ্মণ পুরোহিতও লাগে না। সংস্কৃত ভুল মন্ত্র উচ্চারণের প্রয়োজনও
হয় না। মনের ইচ্ছা অনুযায়ী ছড়া কেটে ব্রতীরা
ব্রত সম্পাদন করে।
ব্রতের উপাদান হল মূলত চারটি- ১) ছড়া, ২) আলপনা,৩) ব্রতকথা ও ৪) উপাচার।
সকল ব্রতেই চারটি উপাদান সব সময় থাকে না
তবে আলপনা ও উপাচার থাকে।
এছাড়াও ব্রত পালনের জন্য কতগুলি জিনিসের বেশ প্রয়োজন সেগুলি হল- ঘট, আম্রপত্র,
পল্লব, ফুল, দূর্বা, ধান, তুলসী, বেল, পাতা, সিদ্ধি, প্রদীপ, তিল, হরিতকি, মধু ,দুধ,
চিনি, ঘী, সশীষ ডাব, পঞ্চ শস্য ,পান, সুপারি, চালের গুড়া, ধানের শীষ, কুলা, পিটুলি,
পাকা কলা, বস্ত্র, গামছা, ধূপ, ঘটি, সরা, থালা, তামার টাট, গঙ্গাজল, আসন, বিড়ি, চাঁদমালা,
ফল-মূল, যোজ্ঞ, চন্দন কাঠ, দক্ষিণা ইত্যাদি। এই উপকরণগুলির দ্বারা বোঝা যায় বাংলার
ব্রতের উপকরণ ইকোসিস্টেমকে মেনে যেন তৈরি। আবার কিছু উপাদান মাতৃতান্ত্রিক সমাজের ঐতিহ্য
বহনকারী কিছু আবার মনুষ্য জীবনের প্রতীক। যেমন- ডাব হল উর্বরতা বাদের স্বরূপ, কড়ি হল-
টাকার প্রতীক, পান হল নারীর যৌনাঙ্গের প্রতীক, জলভরা ঘট ও ডাব হল অন্তঃসত্ত্বা নারীর
প্রতীক, ধানেরগুচ্ছ উর্বরতার প্রতীক। ঘটের গায়ে তেল সিন্দুর দিয়ে আঁকা মানব মূর্তিটির
মধ্য দিয়ে বোঝানো হয় সমগ্র ব্যাপারটাই মানুষের জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত।

কোন মন্তব্য নেই
ok