শাক্ত পদাবলিতে বাঙালি পরিবার চিত্র / সমাজ চিত্র
আগমনী ও বিজয়া গান মধ্যযুগের শেষলগ্নে অর্থাৎ
অষ্টাদশ শতাব্দীতে এবং তার পরবর্তীকালে রচিত শাক্ত পদাবলি বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য
সাধারণ সম্পদ। বৈষ্ণব পদাবলির মত শৃঙ্গার রস এর উপজীব্য নয়, তার পরিবর্তে এখানে প্রাধান্য
পেয়েছে বাৎসল্য রস। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত রাধাকৃষ্ণের প্রেমভক্তি
মূলক বৈষ্ণব পদাবলি বাংলা সাহিত্যে প্রভাব বিস্তার করেছিল। ধীরে ধীরে রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা
জাতীয় জীবনে তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে এবং মাতৃদেবীর পূজার্চনা প্রভাব বিস্তার করে।
বৈষ্ণব সাহিত্য যেমন রাধাকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে, তেমনি শাক্ত পদাবলির উদ্ভব
ও বিকাশ ঘটেছে উমা, পার্বতী, চণ্ডী ও কালিকাকে কেন্দ্র করে। শাক্ত পদাবলির দু'টি বিশিষ্ট
পর্যায় হল আগমনী ও বিজয়া। এগুলিতে উমার পিতৃগৃহে আসা ও পিতৃগৃহ ত্যাগ করে স্বামীগৃহে
যাত্রা প্রসঙ্গে মা মেনকার হৃদয়ের নানা টানাপড়েন প্রাধান্য লাভ করেছে। এই পর্যায়গুলি
দেবদেবীকে কেন্দ্র করে রচিত হলেও এগুলির মধ্যে বাঙালির জীবনের প্রাত্যহিক নানা ঘটনার
পরিচয় দেওয়া আছে। ফলে পদগুলি সাধনা ও ভক্তিবাদকে অতিক্রম করে অনেকটাই মানবিক হয়ে উঠেছে।
মধ্যযুগের
উজ্জ্বল সৃষ্টি শাক্ত পদাবলির আগমনী ও বিজয়া বিষয়ক পদগুলিতে একদিকে যেমন মা মেনকার
মাতৃহৃদয় উদ্ঘাটিত হয়েছে তেমনি এ পদগুলিতে তৎকালীন বাঙালি লীন বাঙালি জীবনের নানা
চিত্র ফুটে উঠেছে।
এ প্রসঙ্গে ড. শশীভূষণ দাশগুপ্ত বলেছেন-"আগমনী
ও বিজয়া সঙ্গীত চয়িতা কবিগণ মোটামুটিভাবে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সমাজ। সমাজ উদ্ভূত।
ফলে আগমনী ও বিজয়া সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত
সমাজের ছবিটি যেমন বাস্তবরূপে ফুটে উঠেছে, তেমনি আমাদের অন্য কোনো জাতীয় সাহিত্যে আর
এমনটি দেখিতে পাই না।"
শাক্ত পদাবলির একটি বিশিষ্ট দিক হল উমাসঙ্গীত
অর্থাৎ আগমনী ও বিজয়া সঙ্গীত। তিন দিনব্যাপী দুর্গোৎসবের সঙ্গে অল্পবয়স্কা, বিবাহিতা
বাঙালি কন্যার তিন তিন দিনের জন্য পিতৃগৃহে আগমনের বিষয়টি এই গানগুলির সঙ্গে গভীরভাবে
সংযুক্ত। দশমীতে বেজে ওঠে বিষাদের সুর। বাঙালি কন্যার প্রতীক তথা প্রতিনিধি উমা সেদিন
পিতৃগৃহ পরিত্যাগ করে পতিগৃহ হিমালয়ের কৈলাসে ফিরে যান। মা মেনকা কন্যার বিরহে অশ্রুপাত
করেন এবং আগামী বছরের শরৎকালের জন্য আবার প্রতীক্ষা করেন। উমার বিবাহ হয়েছিল বাল্যকালে।
সেকালে এজাতীয় বিবাহকে বলা হত গৌরিদান প্রথা। উমার বর্ষীয়ান স্বামী মহাদেব কুলীন ব্রাহ্মণের
প্রতিনিধি। তার সংসারে একাধিক পত্নী; তিনি শ্মশানচারী, নেশাগ্রস্থ, ভিক্ষাজীবী এবং
বিষয়কর্মে উদাসীন। এরূপ স্বামীর গৃহে উমা থাকায় তার মা মেনকা ভীষণ চিন্তিত। এই চিন্তারই
প্রকাশ ঘটেছে আগমনী ও বিজয়া সঙ্গীতগুলিতে।
বাঙালির
ঘরে অভাবগ্রস্ত কন্যার জন্য মায়েদের যেমন বিনিদ্র প্রহর কাটে তেমনি অভাবগ্রস্ত কন্যা
উমার জন্য মা মেনকার বিনিদ্র প্রহর কাটে।
শরৎকালের
নিশিশেষে গিরিরাজ পত্নী মেনকা কন্যাকে স্বপ্নে দেখে উৎকণ্ঠিত হয়ে স্বামীকে ডেকে বলেন-
"আমি কি হেরিলাম নিশি স্বপনে
গিরিরাজ,
অচেতনে কতনা ঘুমাও হে।
এই এখনি
শিয়রে ছিল,
গৌরি আমার
কোথা গেল হে।"
এ ভাবনা
যে কোন বাঙালি মায়েরই ভাবনা। স্বামীর ঔদাসীন্য দেখে মেনকার অভিমান আরও বৃদ্ধি পায়।
তার ধারণা হয় দরিদ্র জামাতা মহাদেব হয়ত উমার সমস্ত অলংকার ও বসন-ভূষণ বিক্রি করে দিয়েছে।
সেই আশঙ্কায় তিনি স্বামীকে বলেন-
"যাও
যাও গিরি আনিতে গৌরি
উমা বুঝি
আমার কাঁদিছে
উমার যতেক
বসন ভূষণ ভোলা সব বুঝি বেচে খেয়েছে।"
এভাবে কন্যা
বিচ্ছেদে বাঙালি মায়েদের যে মানসিক অবস্থা হয়, মেনকারও তাই হয়েছে। গিরিরাজ কৈলাসে মেয়েকে
আনতে গেলে মা মেনকার মাতৃহৃদয় উদ্বেল হয়ে ওঠে। মেনকা স্বামীকে জানান-
"গিরি,
এবার উমা এলে আর উমা পাঠাব না
বলে বলবে
মন্দ লোকে, কারও কথা শুনব না।
যদি এসে
মৃত্যুঞ্জয় উমা নেবার কথা কয়
এবার মায়ে
ঝিয়ে করব ঝগড়া জামাই বলে মানব না।"
অপত্যস্নেহের
এই অভিব্যক্তি অত্যন্ত আন্তরিক। শাক্ত কবিরা মেনকার মাধ্যমে বাঙালি জননীর বিশিষ্ট অনুভূতিকে
যথার্থ সজীবতা এইভাবে প্রদান করেছেন।
এরপর পিতার
সঙ্গে উমা হিমালয়ে আসেন। সপ্তমীর প্রভাতে মা-মেয়ের প্রভাত রাগিণী বেজে ওঠে। হাসি, ঠাট্টায়,
গল্পে, আনন্দে, মজায়, কোলাহলে তাদের তিনদিন কেটে যায় আসে নবমীর রাত্রি। এই নবমীর রাতেই
মা মেনকার হৃদয়ে আসন্ন বিচ্ছেদের কালোছায়া নেমে আসতে শুরু করে। তাই তিনি নবমীর রাত্রিকে
প্রার্থনা করেন-
"ওরে
নবমীর রাত্রি না হইওরে অবসান
শুনেছি দারুণ
তুমি না রাখ সতের মান।"
কিন্তু নিষ্ঠুর
প্রকৃতি জননীর মিনতিতে সাড়া দেয় না- নবমীর রাত্রির অবসান ঘটে। এরপর বিজয়ার দিন উপস্থিত
হলে গৌরিকে নিয়ে যাবার জন্য মহাদেব শ্বশুর বাড়িতে এসে হাজির হন। বুক ভর্তি বেদনা নিয়ে
মেনকা কন্যা গৌরিকে শ্বশুর বাড়িতে পাঠান। পাঠা বিদায় লগ্নের মেনকার যন্ত্রণার কথা রামপ্রসাদ
একটি গানে মর্মস্পর্শী ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন
"তনয়া
পরের ধন, বুঝিয়া না বুঝে মন,
হায় হায়
এ কী বিড়ম্বনা বিধাতার।"
এভাবে শাক্ত পদাবলীর আগমনী ও বিজয়া সঙ্গীতগুলির
মাধ্যমে শাক্ত পদাবলিতে মা মেনকাকে আমাদের সামনে প্রকাশ করেছেন। মেনকার এই ব্যথা, এই
উদ্বেগ যেন বাঙালি গৃহের প্রতিটি মায়ের ব্যথা ও উদ্বেগ। কন্যাকে ছেড়ে প্রত্যেকটি বাঙালি
মা-ই মেনকার মত উৎকণ্ঠিত থাকেন। তাই আগমনী ও বিজয়ার গানগুলিতে শুধু কৈলাসের দেবদেবীদের
জীবন কাহিনি প্রাধান্য পায়নি; মর্তের ধূলি ধূসরিত জীবন ও উজ্জ্বল-ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
ফলে এগুলি শাক্তসাধনা ও ভক্তিভাবকে অতিক্রম করে অনেক বেশি মানবিক হয়ে উঠেছে। ড. শশীভূষণ
দাশগুপ্ত আগমনী ও বিজয়ার গানগুলি সম্পর্কে বলেছিলেন যে, এগুলি এগুলি আমাদের অষ্টাদশ
শতাব্দীর বাঙালির গৃহপ্রাঙ্গণে নিয়ে যায়। এ গানগুলি পড়তে পড়তে আমাদের চোখের সামনে ভেসে
ওঠে ছায়া সুশীতল বাঙলার পর্ণকুটিরগুলি। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে শাক্ত পদাবলীতে
কৈলাস ও মানস সরোবর বাংলার আমবাগান, পানাপুকুরে রূপান্তরিত হয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই
ok