Translate

বিলুপ্তপ্রায় লোকখেলা:ড. নীলোৎপল জানা



বিলুপ্তপ্রায় লোকখেলা

      মনকে ভালো রাখার জন্য শরীরচর্চা এবং খেলাধুলা মানব জীবনের যে অপরিহার্য অঙ্গ তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বাংলা ভাষা- সাহিত্য-সংস্কৃতি যদি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখা যায়, তাহলে দেখা যাবে প্রত্যেকটিক্ষেত্রে খেলাধুলা ও শরীরচর্চার গুরুত্ব অপরিসীম। আজ একুশ শতকে দাঁড়িয়ে আমরা দেখছি, বাঙালি তার প্রাচীন সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসাবে বহু লোকজ খেলা ভুলতে বসেছে। অসংখ্য খেলা বাঙালির চিত্ত বিনোদনের অঙ্গ হিসাবে সুদীর্ঘকাল ধরে চলে আসছিল। কিন্তু আজ সেই সব খেলা বিলুপ্তির পথে। শুধু স্মৃতি হিসাবে রয়ে গেছে বাঙালির মনীষা ও মননে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে বাঙালি Indoor ও Outdoor সেই সমস্ত খেলাগুলিলি একেবারেই বিস্মৃত হয়ে যাবে। শুধুমাত্র স্মৃতি আর বাঙালির সত্ত্বা হিসাবে ভবিষ্যতের রোমন্থনের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। যে খেলাগুলো গৃহের অভ্যন্তরে এবং বাইরে শিশু, নারী-পুরুষ সকলেই জীবনের অঙ্গ করে তুলেছিল এক সময়ে, সেই খেলাগুলি বাঙালির সংস্কৃতি থেকে একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে বসেছে। এমনকি কতকগুলি খেলা আজ আর তেমন চোখে পড়ে না। আধুনিক সভ্যতা, দুরাভাষ, চলচ্চিত্র, দূরদর্শন, সমাজ-মাধ্যমের অঙ্গ হিসাবে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ আজ মানুষের জীবনকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে। মানুষ আজ পাশাপাশি বসে থেকেও কেউ কারোর খবর রাখে না। দুরাভাষে মুখ গুঁজে জীবন অতিবাহিত করছে। তাই মনে হয় যে, মানুষের হাতে একটুও সময় নেই শরীর ও মনকে সুস্থ রাখার জন্য কিছুটা সময় খেলাধুলার সঙ্গে বিচরণ করার জন্য। সেই কারণেই হয়তো, আধুনিক ব্যস্ত জীবনযাপন ও জীবনযাত্রার ফলেই আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে বহু লোকক্রীড়া। বাংলার লোকায়ত খেলাগুলিকে প্রাথমিকভাবে তিন ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। যথাক্রমে-    

১. স্থলের খেলা-

ক. শ্রমহীন আমোদমূলক খেলা: বাঘবন্দী, ১৬ঘুঁটি, চামড়িখেলা, এক্কাদোক্কা,, কড়িখেলা, গুটিখেলা,সেপটিপিন খেলা,বাইট খেলা, কানামাছি,  এলাটিং বেলাটিং, ছি-ছত্তর, রুমালচুরি, কুমির কুমির খেলা ইত্যাদি।

খ. শ্রমসাপেক্ষ শরীরচর্চার খেলা: হাডুডু, গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্দা, নুনতা, চিক্কা,   ডাংগুলি,লাঠিখেলা, গাছুয়া গাছুয়া,  প্রভৃতি।

গ. আনুষ্ঠানিক খেলা: কাদামাটি, পাতা খেলা ইত্যাদি।

ঘ. ছড়া ও ধাঁধার খেলা: আগডুম বাগডুম, ইকড়ি মিকড়ি,  গোলাপ-টগর, কইল্যা, ব্যাঙের মাথা প্রভৃতি খেলা।

ঙ. পশু-প্রাণী নিয়ে খেলা: সাপের খেলা, বানর খেলা, ভালুকের খেলা, ষাঁড়ের লড়াই মোরগ লড়াই ইত্যাদি।

২. জলের খেলা-  নৌকা বাইচ, লাই খেলা, তইতই খেলা, পানিঝুপ্পা খেলা, ছিলকি খেলা,  ইত্যাদি।

৩. অন্তরীক্ষের খেলা-  কবুতর ওড়ানো, বুলবুলির লড়াই, ঘুড়ি ওড়ানো,   ইত্যাদি।


আমার আলোচ্য লোকখেলা- ক)সেফটিপিন

আগেই বলা হয়েছে লোকখেলা আজ প্রায় অবলুপ্ত। লোকখেলা হল সেই খেলা যার জন্য নির্দিষ্ট কোনো মাঠ বা সময় নির্ধারিত থাকে না। এমনই হারিয়ে যাওয়া খেলা হল সেফটিপিন।

আমার ছোটবেলায় এই সকল খেলা বহুল প্রচলিত ছিল, আমি নিজেও খেলেছি। খেলার মূল উপাদান হল সেফটিপিন। আখেলয়াড় কমপক্ষে দুজন; এরপর যত বেশি হতে পারে তবে ১২ জনের বেশি নয়। এই খেলা ইনডোর বা আউটডোর দুইভাবেই খেলা যেত ।

    এই খেলা হয় পরিষ্কার রাস্তার উপর যাতে সেফটিপিনগুলো দেখা যায়। একটি সমান্তরাল দাগ টানা হয়। সেই দাগের ভেতর সকলের দাঁড়ায়। এরপর এক গোছা সেফটিপিন হাতে নিয়ে প্রথমজন অনেকটা দূরে ছুঁড়ে দেয় এবং সে'ই মুখে পয়েন্ট বলে অর্থাৎ একটি সেফটিপিন সমান দশ পয়েন্ট মোট ১০০ পয়েন্টের খেলা। এর বেশি কেউ ডাকতে পারবে না। প্রথমজন যদি কুড়ি পয়েন্ট ডাকে তবে দ্বিতীয় জন এক গোছা সেফটিপিন প্রথম জনের গোছার উপর যদি ছুঁড়ে দিয়ে স্পর্শ করতে পারে তবে প্রথমজনকে দুটো সেফটিপিন দ্বিতীয় জনকে দিতে হতো। আবার দ্বিতীয় জন যদি না ছুঁতে পারে তবে দ্বিতীয় জনকে দুটো সেফটিপিন প্রথমজনকে দিতে হবে এইভাবে খেলা চলতে থাকত।

     প্রথমজন হারলে দ্বিতীয়জন আবার এক গোছা সেফটিপিন ছুড়ে পয়েন্ট ডাকে তখন প্রথমজন যদি ছুঁতে পারে তবে তার জিৎ; হারলে পয়েন্ট অনুযায়ী সেফটিপিন খুলে দিতে হত।

    এতে দেখা যায় কেউ কেউ একেবারে শূন্য হয়ে বাড়ি ফেরে; আবার কেউ মালার মতো গলায় পরে নিয়ে বাড়ি ফেরে। এইভাবে গ্রামের ছোট ছোট ছেলেরা আনন্দ পেতো । এখানে টাকা পয়সা দেওয়া নেওয়া হয় না ঠিক তবে সেফটিপিন দেওয়া নেওয়া করতে হতো। এ এক ধরনের জুয়া খেলা বলা যেতে পারে। এই খেলার মধ্য দিয়ে ছেলেদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির পরিচয় যেমন পাওয়া যেত সেই সঙ্গে অংকের পরীক্ষাও হয়ে যেত। এখন এই ধরনের খেলা আর গ্রাম-বাংলায় দেখা যায় না এর জায়গা করে নিয়েছে ইন্টারনেটওয়ালা স্মার্টফোন।

খ) চিনি বিস্কুট

     এই ধরনের খেলার জন্য খোলা মাঠ বা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বাহির প্রয়োজন হতো। ফলে এই খেলার সময় মূলত পৌষ মাস থেকে শুরু করে বর্ষার আগে পর্যন্ত। এই খেলার প্রধান উপকরণ হল একটি খুঁটি যেটা পরিষ্কার বাহিরের মাঝখানে পোতা থাকতে হতো। দুই দলে খেলোয়াড়ের সংখ্যা হতে হতো পাঁচ যুক্ত পাঁচ বা এর বেশি হলেও চলবে তবে দশ যুক্ত দশের বেশি নয়। এই খুঁটিকে কেন্দ্র করে হাত ধরাধরি করে মালার মত একদল ঘুরতে থাকে। আর অন্য দল  শত্রুপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত হয়। ওরা পাহারাদার হিসাবে কাজ করে । যারা প্রথম খুঁটি ধরে মালার মত ঘুরতে থাকে সেই মালা থেকে একজন করে পাহারাওয়ালাদের চোখ এড়িয়ে যদি পালাতে পারে তবে সে জয়ী। আর যদি ধরা পড়ে তবে সে মর অর্থাৎ বাতিল তখন শত্রুপক্ষের এক পয়েন্ট হয়। এইভাবে একে একে মালা থেকে প্রত্যেকটি খেলোয়াড় দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। যতজন ধরা পড়ে তত পয়েন্ট শত্রুপক্ষ বা পাহারাওয়ালাদের হয়। এরপর শত্রুপক্ষ আবার খুঁটি ধরে ঘুরতে থাকে।তখন তখন তারাও এইভাবে আগেরজনদের মতো পালাতে থাকে। যতজন ধরা পড়ে ততগুলো পয়েন্ট পাহারা ওয়ালাদের হয়। খেলার শেষে পয়েন্ট ভাগাভাগি হয়। যে দল বেশি পয়েন্ট লাভ করে সেই দল জয়ী হয়। ঘোরার সময় সকলে মুখে বলতে থাকে চিনি বিস্কুট, চিনি বিস্কুট।
    এই খেলার মধ্য দিয়ে যেমন অনাবিল আনন্দ ছিল তেমনি ছেলেমেয়েদের শরীরচর্চা হতো। খেলার শেষে ক্ষুধার্ত ছেলেমেয়েরা বাড়ি ফিরে যেত। তবে এই খেলার সময় ছিল মূলত বিকাল বেলা। স্কুল থেকে ফিরে মুখে কিছু দিয়ে কচিকাঁচারা খেলায় অংশ নিত। শুধু কি এই খেলা হত তা নয়; গাদি খেলা, চোর পুলিশ, রাম-সীতা ইত্যাদি।














কোন মন্তব্য নেই

ok

4x6 থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.