মহাকাব্য
মহাকাব্য
ড. নীলোৎপল জানা ,মহিষাদল গার্লস কলেজ
কাব্য দুই প্রকার-দৃশ্যকাব্য
ও শ্রব্যকাব্য । শ্রব্যকাব্য তিন প্রকার – পদ্য,গদ্য,চম্পু। পদ্যকাব্য তিন প্রকার-
মহাকাব্য,খন্ডকাব্য,কোষকাব্য।
আলংকারিক বিশ্বনাথ কবিরাজ তার ‘সাহিত্য
দর্পণ’ এ মহাকাব্য সম্পর্কে অভিমত পোষণ করেছেন—
“সর্গ বন্ধো মহাকাব্যং তত্রৈকো নায়কঃ
সুরঃ
সদ্বংশঃ ক্ষত্রিয়োবাইপি ধীরোদাওগুণান্বিতঃ।।
এক চংশ ভবা ভূপা কুলজা বহবোইপি বা।
শৃঙ্গার-বীর-শান্তানামেকোইঙ্গী রস ইষ্যতে।।
ইতিহাসোদ্ভবং বৃত্তমন্যদ্বা সজ্জনাশ্রয়ম্।
চত্বারস্তস্য বর্গা স্যুস্তেম্বেকঞ ফলং লভেৎ।।”
অর্থাৎ, মহাকাব্য হবে সর্গবন্ধে বিভাজিত,
নায়ক হবে দেবতা বা সংকুলজাত, ধীরোদাত্ত
গুণসম্পন্ন। রস হবে শৃঙ্গার বীর বা শাস্ত এবং ঘটনা কোনও ইতিহাস বা পুরাণ থেকে
সংকলিত হবে।
প্রাচ্য
মত (বিশ্বনাথ কবিরাজ কৃত)—
(i) মহাকাব্যের আখ্যান বস্তু হবে পৌরাণিক বা
ঐতিহাসিক।
(ii) মহাকাব্যের নায়ক ধীরোদাত্ত গুণ সমন্বিত
কোনও দেবতা বা উচ্চ বংশ জাত নৃপতি।
(iii) কম পক্ষে ন’টি ও সর্বাধিক তিরিশটি সর্গে
মহাকাব্য বিভক্ত হবে; প্রতি সর্গের শেষে পরবর্তী সর্গের
সূচনা থাকবে; বিভিন্ন সর্গ একই ছন্দে রচিত হবে, যদিও সর্গের শেষে অন্য বৃন্দ ব্যবহৃত হবে ।
(iv) আশীর্বচন, নমস্ক্রিয়া
বা বস্তু নির্দেশ দিয়ে মহাকাব্যের আরম্ভ ।
(v) মহাকাব্যের পটভূমি হবে স্বর্গ মর্ত্য
পাতাল প্রসারী ।
(vi) শৃঙ্গার, বীর ও
শান্ত রসের একটি হবে প্রধান ও অন্যগুলি প্রধান রসের অঙ্গীরস ।
(vii) মহাকাব্যে প্রাকৃতিক জগৎ, মিলন বিরহ যুদ্ধ বিগ্রহ ইত্যাদি বর্ণনা থাকবে।
(viii) রচনা হবে অলঙ্কার সজ্জিত ও রসভার সম্বলিত
।
(ix) মহাকাব্যের ভাষা হবে ওজস্বী ও
গাম্ভীর্যপূর্ণ ।
(x) প্রতি স্বর্গের নামাঙ্কন প্রয়োজন
।
(১) রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—“কালে কালে একটি
সমগ্র জাতি যে কাব্যকে একজন কবির কবিত্ব শক্তি আশ্রয় করিয়া রচনা করিয়া
তুলিয়াছে, তাহাকেই যথার্থ মহাকাব্য বলা যায়।”
(২) সমালোচক শ্রীশ চন্দ্র দাস বলেছেন—‘ঐশী
প্রেরণায় অনুপ্রাণিত নানা সর্গে বা পরিচ্ছেদে বিভক্ত যে কাব্যে কোনও সুমহান
বিষয়বস্তুকে অবলম্বন করিয়া এক বা বহু বীরোচিত চরিত্র অথবা অতিলৌকিক শক্তি
সম্পাদিত কোনও নিয়তি নির্ধারিত ঘটনা ওজস্বী ছন্দে বর্ণিত হয়, তাহাকে মহাকাব্য বলে।”
ড.নীলোৎপল জানা ,মহিষাদল গার্লস কলেজ cc12
(৩) সমালোচক হীরেন চট্টোপাধ্যায় বলেছেন—“মিত
ছন্দে ও বর্ণনাত্মক ভঙ্গিতে রচিত গুরু বিষয় বস্তু আশ্রিত ও সুনির্দিষ্ট আদি মধ্য
অন্ত সমন্বিত এমন এক স্বয়ং সম্পূর্ণ আখ্যান, যার ঐক্য
সম্বন্ধ হয় জৈবিক প্রকৃতির এবং প্রচুর বৈচিত্র্য সত্ত্বেও যা উদ্দিষ্ট রসানুভূতি
জাগাতে পারে।”
(৪) সমালোচক কুন্তল চট্টোপাধ্যায় বলেছেন—“যে
দীর্ঘ ও মহত্বব্যঞ্জক আখ্যায়িকা কাব্য জাতীয় জীবনের ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক
বৃত্তান্ত এক বা একাধিক সমুন্নত ও বীরোচিত চরিত্রের কীর্তিকলাপকে অবলম্বন করে
ওজস্বী ভাষা ও ছন্দে নানা সর্গে এক অখণ্ড, গরিমমণ্ডিত
রূপে বর্ণিত হয় তাকেই বলা হয় মহাকাব্য। গীতি কবিতার একক, ‘আত্মনিষ্ট, হৃদয়ানুভূতির প্রকাশ নয়, দেশ ও জাতীর সংকট এ পরিবর্তনের বিপন্নতার অন্তর্লোক থেকে এক বস্তুনিষ্ট
সমাজবীক্ষণ রূপে মহাকাব্যে জন্ম।”
সব
মিলিয়ে বলতে হয়, বিভিন্ন ভাবে মহাকাব্যের
সংজ্ঞা নির্ণয় করা হলেও মূলগত বৈশিষ্ট্যগুলিকে কেউই অস্বীকার করেননি। মহাকাব্য হল
বস্তুনিষ্ঠ সমাজ বীক্ষণ সেই যুগ বা দেশের যখন জাতীয় সংকট বা বিপন্নতা হতে
উদ্ধারকারী কোনও ব্যক্তি বিশেষের কীর্তি কাহিনি ও মহত্ব গৌরবের সঙ্গে বর্ণিত হয়।
পাশ্চাত্যমত (অ্যারিষ্টটল কৃত)
(i) মহাকাব্য হয় আদি মধ্য অন্ত্যযুক্ত নাট্যধর্মী বিকৃতমূলক পূর্ণাঙ্গ
কাহিনি।
(ii) একজন নায়কের ঘটনা নিয়ে মহাকাব্য রচিত।gg hyu
(iii) এক প্রকার ছন্দ, বীরত্ব ব্যঞ্জক Dactylic
hexameter ব্যবহার করা দরকার। এ সম্পর্কে ফিলিপ সিড়নি
জানিয়েছেন—মহাকাব্যের প্রত্যেকটি ঘটনা আমাদের মনকে যেমন মহৎভাবে উদ্বোধিত করে
জ্ঞান সঞ্চার করে, তেমনি মহৎ চরিত্রের সুউচ্চ বর্ণনা
আমাদের মনে মহৎ হবার বাসনা জাগ্রত করে। (An Apology for the poetrie) আর, সমালোচক W.M.Dixon ও মহাকাব্যের লক্ষণ নির্দেশ করতে গিয়ে বিষয়বস্তু, আখ্যান, চরিত্র ও রচনা রীতির ওপর জোর দিয়েছেন,
বীর রসাত্মক হবে মহাকাব্য।
অন্যদিকে সমালোচক ড্রাইডেন জানিয়েছেন—বীরত্ব ব্যঞ্জক নাটক ও মহাকাব্যের বিষয় বস্তুও হবে প্রেম এবং বীরত্ব। অর্থাৎ প্রত্যেক সমালোচক মহাকাব্য সম্পর্কে নিজ নিজ অভিমত পোষণ করলেও মহাকাব্যের গাম্ভীর্য ও বীরত্ব ব্যঞ্জক রীতিকে কিন্তু কেউ অস্বীকার করেননি।
মহাকাব্যের শ্রেণিবিভাগ:
(১) Authentic Epic রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়ড (Iliod), এডিসি (Odyssey) হল Authentic Epic। চিরকালের সমস্ত দেশ ও জাতির সৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সামগ্রিক রাপও এইসব মহাকাব্যে প্রত্যক্ষ করা যায়। গ্রিক জাতির ঐতিহ্যের সঙ্গে ইলিয়ডের ট্রোজানদের যুদ্ধ অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত থেকেছে, ওডিসিতেও সেই সূত্রেই রাজা ওডেসিয়াসকে যুদ্ধ সেরে স্বদেশে ফিরে আসতে দেখা যায়।
'রামায়ণ' ও 'মহাভারত' ও সেই যুদ্ধ, বীরত্ব ও দেবদেবীর কাহিনি প্রাধান্য লাভ করেছে।
(২) Literary Epic-Ennius Annales, ভার্জিলের 'ইলিড' (Aeneid) Comones-এর Os Lusiadas, Tasso Gerusalemme Liberata, Milton-এর Paradise Lost.
কালিদাসের 'কুমারসম্ভব', 'রঘুবংশ', মধুসূদনের 'মেঘনাদবধ কাব্য', হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বৃত্রসংহার' এই শ্রেণির মহাকাব্যের অন্তর্ভুক্ত। অতীত কাহিনি এবং প্রাচীন মহাকাব্যের ধারা অনুসরণ করে সমকালের জাতীয় চিন্তা ও চেতনাকেই পরিস্ফুট করেছেন এই শ্রেণির মহাকবিরা। এই শ্রেণির কাব্যে ক্লাসিক কল্পনা সার্থকভাবে পরিস্ফুট হয়েছে। এই শ্রেণির সর্বোৎকৃষ্ট epic হল মিল্টনের 'Paradise Lost' এবং মধুসূদনের 'মেঘনাদবধ কাব্য'। 'invocations digres- sions, similes, legend, history, folklore, magic and the supernatural, eloquent speeches, perilious journeys, bottles and the sence of the underworld.' এই সব লক্ষণ দেখা গেছে 'Paradise Lost'-এ।
সার্থক মহাকাব্য: মধুসূদনের ক্লাসিক কল্পনা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করেছে তাঁর সাহিত্যিক মহাকাব্য 'মেঘনাদবধ কাব্যে'। বীররস দিয়ে কাব্য শুরু হয়েছে। বীরবাহুর মৃত্যু সাধারণ মৃত্যু নয়-সম্মুখ সমরে পড়ি বীরচূড়ামণি বীরবাহু', রাবণের সঙ্গে চিত্রাঙ্গদার শুধু স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নয়, রাজা-প্রজার সম্পর্কও। প্রজা চিত্রাঙ্গদা রাজা রাবণকে সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। এ কাব্যে বিলাপ শুধু চিত্রাঙ্গদা করেননি, বিলাপ করেছেন মন্দোদরীও। ক্লাসিক সাহিত্যিক মহাকাব্যের নায়কের যেসব গুণ ও অনুভূতি থাকে, সেইসব গুণ ও অনুভূতি প্রত্যক্ষ করা গেছে রাবণ ও ইন্দ্রজিৎ চরিত্রে। শ্রীতারাপদ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, 'পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যিক মহাকাব্যগুলির মধ্যে যে জাতীয় সুর (National Spirit) আছে, দেশ ও জাতি একটি অখণ্ড ভাবাদর্শরূপে যে কাব্যের চরিত্রগুলির চিন্তা ও কর্মকে যেভাবে নিয়ন্ত্রিত করিয়াছে, ভারতীয় মহাকাব্যগুলির চরিত্রের মধ্য সেরূপ জাতীয়-সচেতনতা দেখা যায় না। ভারতীয় কবি মর্ত্যের মানুষের মধ্যে দেবদুর্লভ মহত্ত্ব-মহিমার বিকাশ দেখিয়েছেন কিন্তু যে কারণেই হউক জাতীয়তাবোধ তাঁহাদের মনন-কল্পনাকে কখনও অধিকার করে নাই। হয়তো ইহার কারণ ভারতীয় দৃষ্টির অখণ্ডতা, তাহা সকলকে এক করে না, বহুকে গ্রহণ করে না। জাতীয়তাবোধ আপনাকে সঙ্কোচ করে, তাই বিশ্ব মৈত্রীর বাণী যাঁহারা উচ্চারণ করিয়াছেন, অখণ্ড ভূমানন্দের স্বাদ যাহারা পাইয়াছেন, জাতীয়তা মন্ত্রের খণ্ড আদর্শ তাঁহাদের ধ্যানে ও সাহিত্যে আসিতে পারে নাই। অথচ এই National Spirit সাহিত্যিক মহাকাব্যের একটা বিশিষ্ট লক্ষণ এবং মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য সে বিশেষ লক্ষণে বিশেষিত। 'মেঘনাদবধ কাব্য' দুহাজারেরও বেশি শ্লোক থেকে মহাকাব্যের গম্ভীর এবং উদাত্ত সুর ধ্বনিত হয়েছে।
অলংকার শাস্ত্রের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী 'মেঘনাদবধ কাব্য 'কে আলংকারিক মহাকাব্য বলা যাবে না। কারণ-
(১) অষ্টাধিক সর্গে 'মেঘনাদবধ কাব্য' রচিত হয়নি। 'মেঘনাদবধ কাব্যে'র সর্গ সংখ্যা হল নয়টি।
(২) সর্গের শেষে কবি নতুন ছন্দের প্রয়োগ করে ছন্দ বৈচিত্র্য আনেননি।
(৩) আলংকারিকেরা মহাকাব্যকে মিলনান্তক বললেও 'মেঘনাদবধ কাব্যে'র বিষাদান্তক পরিণতি প্রত্যক্ষ করি।
(৪) নায়কের জয়ের মধ্য দিয়ে কাব্যের সমাপ্তি ঘটেনি।
দুটি অলংকারিক মহাকাব্যের দৃষ্টান্ত সংস্কৃত ভাষায় লেখা 'রামায়ণ ও মহাভারত' এ আলংকারিক মহাকাব্যের দৃষ্টান্ত মেলে।
=========================================
পড়ার পর লাইক বা কমেন্ট দিও।
ড.নীলোৎপল জানা ,মহিষাদল গার্লস কলেজ cc12
কোন মন্তব্য নেই
ok