প্রহসন বা ফার্স
প্রহসন বা ফার্স
সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য: বিশ্বনাথ 'সাহিত্যদর্পণ' দৃশ্যকাব্যকে দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন-
রাপক ও উপরূপক। রূপক-কে তিনি দশটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। সেই দশটি শ্রেণির একটি ভাগ হল কৌতুক বা ব্যঙ্গ নাটক। আর তিনি সেই কৌতুক বা ব্যঙ্গ নাটককে যে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন, তার একটি শ্রেণি হল প্রহসন। পাশ্চাত্যে অনেক সমালোচক প্রহসনকে কমেডির একটি শ্রেণি হিসাবে দেখেছেন। J.T.Shipley বলেছেন 'Farce generally means low comedy intended solely to provoke laughter through gestures; buffonery, action or situation, as opposed to comedy of charaeter or Manners.' সমালোচক Norwood বলেছেন 'Farce may be defined as exaggerated comedy; its problem is unlikely, and absurd; its manners en- tirely laughable, প্রহসনের সংজ্ঞা রসরাজ অমৃতলাল বসু তাঁর 'চৌসা' প্রহসনের একটি গানেই পরোক্ষভাবে বলে দিয়েছেন,
'শুধু একটুখানি তামাসা
সং সাজায়ে রং বাজারে
পাঁচজনের নিয়ে আসা
হাসির কথা উড়িও হেসে।
বুঝবো কেমন মেজাজ খাসা।'
প্রহসনের বৈশিষ্ট্য
(১) আচারমূলক কমেডি অবক্ষয়িত হয়ে প্রসহনে পরিণত হয়- "as opposed to the comedy of manners.' আচারমূলক কমেডিতে মানুষের আচার আচরণ কর্ম বৈশিষ্ট্যকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা হয়েছে অপরদিকে প্রহসনে এমন এক অবাস্তব জগতের কথা বলা হয়েছে- যেখানে চিৎকার, ধস্তাধস্তি ও ভাঁড়ামি প্রাধান্য লাভ করেছে।
(২) হাস্যসৃষ্টি প্রহসনের মূল লক্ষ্য। সেই হাসি নিম্নমানের আনন্দ পরিবেশন করে থাকে। সেইজন্য বলা হয়েছে- Farce generally means low comedy.
(৩) প্রহসনে কাহিনির ভাব পরস্পরা থাকে না। কাহিনিকে কেন্দ্র করে চরিত্র সৃষ্টি হয়।
(৪) প্রহসনে জীবনের খণ্ডিত রূপ প্রকাশিত হয়।
(৫) প্রহসনের আয়তন ক্ষুদ্র হয়। ইংরেজি প্রহসন তিন অঙ্কের বেশি হয় না। সংস্কৃত প্রহসন এক অঙ্কের হয়।
(৬) ল্যাটিন 'Farcio' শব্দ থেকে ইংরেজি Farce এর জন্ম, যার অর্থ হল 'ঠেসে ভর্তি করে কোনো জিনিসকে স্ফীত করে তোলা।' পরবর্তীকালে নিম্নশ্রেণীর কৌতুক ও ভাঁড়ামি প্রাধান্য লাভ করে ফার্স বা প্রহসনে।
(৭) অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে বড়ো ট্র্যাজেডি মঞ্চস্থ হবার আগে বা পরে একটি করে প্রহসন মঞ্চে মঞ্চস্থ হত।
(৮) আচারমূলক কমেডি বিশ শতক প্রহসনে পরিণত হয়ে তিনটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে
হাজির হল- 'a low comedy intended solely to provoke laughter through gestures, buffoonery, action or situation.'
(৯) বাংলা প্রহসনে সংস্কৃত শুদ্ধ প্রহসনের যেমন সব লক্ষণ নেই, তেমন ইংরেজি ফার্সেরও সব লক্ষণ নেই। সাধারণভাবে বাংলা প্রহসনে চারটি শ্রেণি দেখা যায়-
(ক) বিশুদ্ধ ফার্স-জ্যোতিরিন্দ্রনাথের 'হিতে বিপরীতে', দ্বিজেন্দ্রলালের 'বিরহ', অমৃতলালের 'ডিসমিস' ইত্যাদি।
(খ) কমেডির লক্ষণাক্রান্ত মিশ্র ফার্স-মধুসূদনের 'একেই কি বলে সভ্যতা', দীনবন্ধুর 'সধবার একাদশী', রবীন্দ্রনাথের 'বৈকুণ্ঠের খাতা' ইত্যাদি।
(গ) সামাজিক ফার্স-মধুসূদনের 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ'।
(ঘ) ব্যক্তি ব্যঙ্গাত্মকমূলক ফার্স-দ্বিজেন্দ্রলালের 'আনন্দ-বিদায়'।
(১০) প্রহসনের কাহিনি মিলনান্তক হয়।
(১১) প্রহসনে সমাজচিত্র প্রতিফলিত হয়।
বাংলা প্রহসনের বিকাশ
প্রহসনের ইতিহাস: গ্রিক কমেডির জন্মদাতা অ্যারিস্টোফেনিসের কমেডিগুলোতে ফার্স বা প্রহসনের উপাদান যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান। কমেডিই বিবর্তিত হয়ে ফার্স বা প্রহসনে পরিণত হয়েছে। ল্যাটিন 'Farcio' শব্দ থেকে ফার্সের উদ্ভব হয়েছে। ইংরেজি সাহিত্যে পাঁচ অঙ্কের কমেডি নাটকের পরিবর্তে তিন অঙ্কের যে সব হাস্যরসাত্মক নাটক রচিত হল তাই ফার্স নামে পরিচিত হল। এখানে সমস্ত চরিত্রই অতিরঞ্জিত ভাবে বর্ণিত হয়ে হাস্যরসের উদ্রেক করে। আচারমূলক কমেডির অবক্ষয়িত রূপ প্রহসন-'As opposed to the comedy of manners, 'সংস্কৃত প্রহসন এক অঙ্কের, ইংরেজি ফার্স দুই বা তিন অঙ্কের হয়ে থাকে। সামাজিক ভন্ডামিকে নগ্নভাবে প্রকাশ করে ফার্স। বাংলা প্রহসনে সংস্কৃত প্রহসনের সব লক্ষণ যেমন' নেই, তেমন ইংরেজি ফার্সেরও সব লক্ষণ নেই।
বাংলা প্রহসনকে চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়-
(১) বিশুদ্ধ ফার্সঃ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের 'হিতে বিপরীতে' অমৃতলাল 'ডিসমিস', দ্বিজেন্দ্রলালের 'বিরহ' ইত্যাদি।
(২) উন্নত কমেডির লক্ষণাক্রান্ত মিশ্র ফার্সঃ মধুসূদনের 'একেই কি বলে সভ্যতা', 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ', দীনবন্ধুর 'সধবার একাদশী' রবীন্দ্রনাথের 'বৈকুণ্ঠের খাতা' ইত্যাদি।
(৩) সামাজিক ফার্স: দীনবন্ধুর 'বিয়ে পাগলা বুড়ো'।
(৪) ব্যক্তি ব্যঙ্গাত্মক ফার্স: দ্বিজেন্দ্রলালের ফার্স এই শ্রেণির অন্তর্গত।
বাংলা প্রহসন
দীনবন্ধু মিত্র: ১৮৬৬ সালে প্রকাশিত হয় দীনবন্ধু মিত্রের 'বিয়ে পাগলা বুড়ো' ও 'সধবারএকাদশী'। দুটিই প্রহসন। দু'টি প্রহসনেই মধুসূদনের প্রভাব প্রত্যক্ষ করা যায়। মধূসূদনের 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ'র ভক্তপ্রসাদের মতো
'বিয়ে পাগলা বুড়ো'র বুড়ো রাজীবলোচন মুখে ধর্মের কথা বললেও নিজের বিধবা মেয়েদের কথা একটুও ভাবেন না। তিনি আবার বিয়ে করতে গেলে সকলের ষড়যন্ত্রে জব্দ হয়ে যান। বুড়ো রাজীবলোচনের দ্বিচারিতাকে প্রহসনকার পরিস্ফুট করেছেন। '
সধবার একাদশী'তে সমকালের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত যুবকদের শিক্ষাভিমান ও চরিত্রবিকৃতি ফুটে উঠেছে। এখানে 'একেই কি বলে সভ্যতা'র প্রভাব মেলে। তরুণ যুবকদের খামখেয়ালীপনা, উচ্ছৃঙ্খলতা, ভোগাকাঙ্ক্ষায় স্যাটায়ার, হিউমার ও উইটের সংমিশ্রণ ঘটেছে। নিমচাঁদের জুড়ি বাংলা সাহিত্যে মেলা ভার। মদ্যাসক্ত নিমচাঁদ নায়ক অটলবিহারীর ইয়ার বন্ধু। অটলবিহারী সর্বদা কুকর্মে নিয়োজিত থাকে নিমচাঁদ তার ইয়ার হলেও বিদূষক নয়। ১৮৭২ সালে
দীনবন্ধুর 'জামাই বারিক' প্রহসন প্রকাশিত হয়। কলকাতার ধনী পরিবারে ঘরজামাই পোষাকে এই প্রহসনে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। শ্বশুরবাড়িতে পরাধীন থাকা জামাইদের অন্তরবেদনাকে প্রহসনকার হাস্যরসের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। এই প্রহসনের একদিকে আছে বাংলা বিন্দু পদ্মলোচনের আখ্যান, অন্যদিকে আছে কামিনী, অভয়, ভবী ও ময়রাবুড়োর আখ্যান। এখানে ঘরজামাই সমস্যা এবং দ্বিপরি স্বামীর স্বপন্থী কলহ সমস্যা প্রহসনে অদ্ভুতত্ত্বের বাতাবরণ সৃষ্টি করে হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর: জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর মলিয়েরের ফার্সকে অনুসরণ করে বাংলাপ্রহসনগুলো রচনা করেন। স্ত্রী স্বাধীনতাকে ব্যঙ্গ করে তিনি তাঁর প্রথম প্রহসন 'কিঞ্চিৎ জলযোগ' (১৮৭২) রচনা করেন। স্বামী-স্ত্রীর মিথ্যা-সন্দেহও ঈর্ষা প্রহসনে হাস্যরস উদ্রেক করেছে। পূর্ণচন্দ্রের সন্দেহের যেমন কোনো কারণ নেই, বিধুমুখীর আতঙ্কেরও তেমন কোনো কারণ নেই। 'কিঞ্চিৎ জলযোগ'-এ ত্রুটি থাকলেও 'অলীকবাবু' (১৮৭৭) তাঁর লেখা প্রথম সার্থক প্রহসন। এই প্রহসনে মূর্খ অলীকের মিথ্যাভাষণ আর হেমাঙ্গিনীর রোমান্স প্রিয়তা হাস্যরসের উদ্রেক করেছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের প্রহসনে মধুসূদনের প্রহসনের প্রভাব অপ্রত্যাশিত ভাবে এসে গেছে। বিয়ে পাগলার জব্দ হওয়ার আখ্যান 'হিতে বিপরীত' (১৮৯৬)। মলিয়ের এর 'The city turned Gentle- man' কে অনুসরণ করে 'হঠাৎ নবাব' (১৮৮৪) এবং 'Marriage Force' কে অনুসরণ করে 'দায়ে পড়ে 'দারগ্রহ' (১৯০২) রচনা করেছেন।
গিরিশচন্দ্র ঘোষঃ গিরিশচন্দ্র ঘোষ ইতর পল্লির পরিবেশকে ব্যঙ্গ করে ক্ষুদ্রাকৃতির কয়েকটি প্রহসন ধর্মী নাটক রচনা করেন। সেগুলি হল 'সপ্তমীতে বিসর্জন', 'বেল্লিক বাজার', 'বড়দিনের বকশিস', 'সভ্যতার পান্ডা' ইত্যাদি।
কমেডি ও প্রহসনের মধ্যে তুলনা।
কমেডি ও প্রহসনের তুলনা: এদের মধ্যে পার্থক্য অতীব সূক্ষ্ম-
১। প্রহসনের স্থূল রঙ্গরস ও আতিশয্য যুক্ত দৈহিক অঙ্গভঙ্গি অনেক বেশি থাকে যা সর্বদাই দর্শককে কৌতুক উত্তেজনা দিতে চায়। এ জাতীয় স্থূল হাস্যরস ও দৈহিক বা ক্ষেত্র বিশেষে নিম্ন রুচির অঙ্গভঙ্গি উচ্চাঙ্গের কমেডিতে বিশেষ থাকে না।
২। সমকালীন সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি ইত্যাদির কুৎসিত ও কলঙ্কময় দিকগুলি খোলাখুলিভাবে প্রহসনে চিত্রিত হয়। ফলে প্রহসনের আখ্যানভাগ বহু আলোচিত ও বিতর্কিত বিষয়ের প্রত্যক্ষ ব্যঙ্গধর্মী উন্মোচনে যতখানি তৎপর থাকে কমেডিতে তেমন দেখা যায় না।
৩। প্রহসনের চরিত্রের সর্বদাই টাইপ-ধর্মী, সমকালীন সমাজ বাস্তবের অন্তর্গত বিশেষ বিশেষ শ্রেণি বা গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে তারা। চরিত্রেরা হয় সাধারণ ভাবে একমাত্রিক ও নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কমেডির চরিত্রেরা তুলনায় অনেক বেশি গভীর, জটিল ও বহুমাত্রা যুক্ত।
৪। কমেডির মতো পূর্ণাঙ্গ বিস্তার প্রহসনে থাকে না। প্রহসন একটি বা দুটি অঙ্কে শেষ হয়ে যায়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তার বিন্যাস হয় নক্শাধর্মী, টুকরো টুকরো চিত্রের মাধ্যমে প্রহসনের কাঠামো গড়ে ওঠে।
৫। নাট্য-দ্বন্দ্ব প্রহসনের স্বল্প আয়তনে সেভাবে গড়ে উঠতে পারে না বলে চটুল ও চাতুর্যপূর্ণ পরিস্থিতির ওপরেই প্রহসন নির্ভর করে।
৬। প্রহসনের সংলাপ হয় হালকা, কিছুটা অমার্জিত ও কমেডির সংলাপ তুলনায় অনেক বেশী পরিশীলিত। বুদ্ধিদীপ্ত হিউমার কিংবা বাগবৈদগ্ধ্য প্রদর্শনের সুযোগ প্রহসনে তেমন থাকে না।
৭। পেট ফাটা হাসি বা 'belly laughs' প্রহসনকে যে আদ্যোপান্ত টইটম্বুর করে রাখে তা কমেডিতে থাকে না। কমেডির হাস্যরস অনেক বেশি চিন্তামূলক 'thoughtful laughter'।
কোন মন্তব্য নেই
ok