আঞ্চলিক উপন্যাস (Regional Novel):
• আঞ্চলিক উপন্যাস (Regional Novel):
যে উপন্যাস কোন এক বিশেষ অঞ্চলের মানুষের কথা, তার পরিবেশ, জীবনচর্যাসহ শিল্পসম্মতরূপে পরিবেশিত হয় তাকে বলা হয় আঞ্চলিক উপন্যাস। নির্দিষ্ট এই সংজ্ঞায় সম্পূর্ণরূপে এ উপন্যাসের স্বরূপকে তুলে ধরা সম্ভব নয় বলেই সমালোচকেরা এর কতকগুলি বৈশেষিক লক্ষণের দিকে ইঙ্গিত করেছেন--
(i) কোন এক বিশেষ অঞ্চলের কথা এ শ্রেণীর উপন্যাসে উপজীব্য বিষয় হয়।
(ii) এ শোর উপন্যাসে কোথাও কোথাও ভৌগোলিক চৌহদ্দিও নির্দেশ করা থাকে।
(iii) বিশেষ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মূল্যবোধ, লোকধর্ম, লোকবিশ্বাস এ শ্রেণীর উপন্যাসে থাকে।
(iv) বিশেষ অঞ্চলের মানুষের উপর অন্যদের শোষণ ও নির্যাতনের কথাও বিবৃত হতে পারে।
(v) এ শ্রেণীর উপন্যাসে নায়কোপম চরিত্র থাকলেও যথার্থ নায়ক চরিত্র থাকে না, কারণ এখানে নায়ক হয়ে ওঠে হয় জনগোষ্ঠী নতুবা স্থানীয় প্রকৃতি।
(vi) চরিত্রগুলির ভাষা হয় লোকভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা। কোন কোন সমালোচক বলেছেন এই চলিত বা লৌকিক ভাষা প্রয়োগ পঞ্চাশ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি ক্ষেত্রে ঘটা চাই।
(vii) আঞ্চলিক উপন্যাসে অনেকক্ষেত্রে নিসর্গকে উপস্থাপিত করা হয় পশ্চাৎ-পটরূপে, কোথাও যা চরিত্রকে জীবন্ত করে তুলতে-কোথাও নিসর্গ নিজেই হয়ে ওঠে চরিত্র।
(viii) আঞ্চলিক জীবনকথাকে অবলম্বন করে রচিত এ উপন্যাসে শাশ্বত জীবনধর্মের প্রকাশ ঘটা জরুরী।
ইংরেজী সাহিত্যে মিসেস গ্যাসকেলের (Mrs. Gaskell) 'Mary Barton' (১৮৪৮)
ম্যাঞ্চেস্টার অঞ্চলের দরিদ্র শ্রমিকদের জীবনে অভিজ্ঞতার কথা নিয়ে লেখা, এমিলি ব্রন্টির 'উইদারিং হাইটস্' (Wutering Heights)-এ রয়েছে ইয়র্কশায়ারের পার্বত্যভূমি আর জলাভূমির পরিবেশে হিথক্লিফ আর্ণশের জীবনকথা। শার্লট ব্রন্টির 'জেইন আয়ার' (Jane Ayre), জ্যান ব্রন্টির অ্যানিস গ্রে' (Agnes Gras) টমাস হার্ডির Wessex-এর উপন্যাসগুলিও 'ফার ফ্রম দি ম্যাডিং ক্রাউড' (Far From The Madding Crowd), 'আন্ডার দি গ্রীণ উড' (Under the Green Wood) প্রভৃতিও আঞ্চলিক উপন্যাস।
ভারতীয় সাহিত্যে উনিশ শতকেই ওড়িয়া ও মারাঠী ভাষায় আঞ্চলিক উপন্যাসের সন্ধান পাই। মারাঠী ঔপন্যাসিক হরিনারায়ণ আপ্তের 'মজলিস স্থিতি' (১৮৮৫), 'কিন্তুকে খবর রাখে' (১৮৮৭) ওড়িয়া ঔপন্যাসিক ফকিরমোহন সেনাপতির 'ছ মান আঠগুষ্ঠ' (১৯০২, পত্রিকায় ১৮৯৮) উল্লেখযোগ্য। বিংশ শতাব্দীতে গুজরাটি ঔপন্যাসিক পান্নালাল প্যাটেলের 'মালেলা জীবা' (১৯৪১), জে মেঘানীর 'গুজরাট বহতা পানী'; ওড়িয়া সাহিত্যে কাহৃচরণ মহান্তীর 'শাস্তি' (১৯৪২) এবং 'হা অন্ন' ১৮৬৭-৬৮-এর পুরীর দুর্ভিক্ষ নিয়ে লেখা, গোপীনাথ মহান্তীর 'পরজা' (১৯৪৫) কোরাপুটের পরজা উপজাতিদের নিয়ে লেখা, মারাঠী সাহিত্যে শ্রীপাদনারায়ণ পেন্ডসের 'গরমবিচা বাপু' (১৯৫২); হিন্দী সাহিত্যে ফণীশ্বরনাথ রেণুর 'ময়লা আঁচল' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য আঞ্চলিক উপন্যাস।
বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক আঞ্চলিক উপন্যাস রূপে চিহ্নিত করা যায় শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের 'কয়লাকুঠি' (বসুমতী পত্রিকায় ১৯২৯-৩০ প্রকাশিত) রচনাটিকে। শৈলজানন্দের 'যোল আনা' (১৯৩২) ও এ ধরনের উপন্যাস। বাংলা সাহিত্যে আঞ্চলিক উপন্যাসিকরূপে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ঔপন্যাসিককে। তারাশঙ্করের 'ধাত্রীদেবতা', গণদেবতা', 'হাঁসুলি বাঁকের উপকথা' প্রভৃতি গ্রন্থে, মানিকের 'পদ্মানদীর মাঝি', 'সহরতলী', সমরেশ বসুর 'গঙ্গা', প্রফুল্ল রায়ের 'পূর্বপার্বতী' এবং ভগীরথী মিশ্রের কয়েকটি সার্থক আঞ্চলিক উপন্যাস রয়েছে।
• একটি সার্থক আঞ্চলিক উপন্যাস
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মানদীর মাঝি' উপন্যাসটিকে একটি সার্থক আঞ্চলিক উপন্যাসরূপে চিহ্নিত করা হয়। কারণ এ উপন্যাসের পটভূমি হল পূর্ববঙ্গের পদ্মা বিধৌত অঞ্চল। কেতুপুর নামক একটি গ্রাম-যা এ অঞ্চলেই পড়ে। এ উপন্যাসের চরিত্রগুলি অধিকাংশই কেতুপুরের মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের লোক। পদ্মানদী হল এদের জীবিকা ক্ষেত্র- এতেই কেহ মাছ ধরে, কেহ মাঝিগিরি করে'। এই চরিত্রগুলির উপর পদ্মার প্রভাবও অত্যন্ত গভীর-প্রয়োজনগত সম্পর্ক ছাড়াও এর সঙ্গে রয়েছে নাড়ীর সম্পর্ক-তাই পদ্মার মত সকাল-বিকালে বদলে যায় কুবের মাঝির চারিত্রক বৈশিষ্ট্য-'এমনি প্রকৃতি পদ্মানদীর • মাঝির, ভদ্রলোকের মত একটানা সংকীর্ণতা নয়, বিরাট বিস্তারিত সংমিশ্রণ।' এ উপন্যাসে • ঔপন্যাসিক কেতুপুরের আর্থ-সামাজিক চিত্রটিও তুলে ধরেছেন। দুর্গাপূজা, রথ এবং দোল তিনটি গ্রামীণ 'উৎসবের কথা এতে বলা হলেও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে ধর্মীয় একাত্মতাকে দেখানোর চেষ্টা নেই। এখানকার মাঝিদের মধ্যে জাতধর্মের কোন ভেদাভেদ নেই কারণ কঠোর বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাদের দৈনন্দিন জীবন। শিক্ষাদীক্ষার বালাই নেই এদের। অলৌকিক ভূত-প্রেতাদিতে বিশ্বাস রয়েছে, তাই কুবের হোসেন মিঞাকে ভেবেছে অলৌকিক বেতাল সিদ্ধ। সবক্ষেত্রেই আঞ্চলিক উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য রক্ষিত হলেও ময়নাদ্বীপের প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ এর আঞ্চলিক উপন্যাসে হয়ে ওঠায় প্রধান প্রতিবন্ধক হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেছেন। ডঃ সরোজমোহন মিত্র, ডঃ গোপিকানাথ রায়চৌধুরী প্রমুখ সমালোচক এ উপন্যাসটিকে সার্থক আঞ্চলিক উপন্যাস বলতে চাননি কারণ এদের মাধ্যমে এই চরিত্রগুলি বিশ্বজগতের শ্রমকাতর ক্ষুধার্ত মানুষের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছে। কিন্তু আঞ্চলিক উপন্যাসে আঞ্চলিকতা একটি শর্ত হলেও বিশ্বজনীনতা যে সেখানে কোন শর্ত নয়-এমন কথা কি বলা যায়? মানুষের স্থায়ী ভাবগুলি চিরকাল সর্বত্র সমান-একই রকম। সুতরাং ক্ষুধাতুর মানুষের চারিত্রিকধর্ম বিশ্বের সর্বত্র একই রকম হওয়া স্বাভাবিক। যে লেখক এই চিত্র আঁকতে পারেন তিনি স্বাভাবিকতার শর্তরক্ষা করার জন্য ধন্যবাদার্হ।
কোন মন্তব্য নেই
ok