কমেডি : ড. নীলোৎপল জানা
কমেডি
• কমেডি শব্দের উৎস
'Comedy' শব্দের উদ্ভব নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। কারো মতে 'Komodia' (মূল শব্দ Komos) থেকে Comedy, শব্দের উদ্ভব। এর অর্থ Merry- making। গ্রীসের দেবতা ডায়োনিসাসের শীতকালীন উৎসব থেকে কমেডির উদ্ভব হয়েছে বলে মনে করেছেন কেউ কেউ। 'কমেডি' শব্দটির গ্রীক ভাষায় অর্থ আমোদকারীদের গান। ডায়োনিসাসের পুনর্জীবন লাভের আনন্দে ফ্যালিকন (Phalic songs) গান গাহিত। শোভাযাত্রা সহকারে গীত এ শোভাযাত্রার নাম 'কোমাস' (Comus), থেকেই 'কমেডি'র উদ্ভব ঘটেছে বলে মনে করেন অ্যারিস্টটল। কারো মতে সিসিলির মোগারীয়রা কমেডির স্রষ্টা। পাশ্ববর্তী গ্রামকে তাঁদের ভাষায় বলা হতো 'কোমাই'। তাঁরা নগর থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন বলে তাদের 'Kata Komas' বলা হতো। Komazeinও বলা হতো। এর থেকে এসেছে 'কমেডিয়ান' শব্দ।
• কমেডির সংজ্ঞা
মিলনান্তক
যে নাটকে চরিত্র উপস্থাপন ও ঘটনা বিন্যাস দর্শক ও পাঠককে প্রভূত 'আনন্দ দেয় সে নাটককে
সাধারণভাবে কমেডি নাটক বলা যায়। কমেডির সংজ্ঞা দিতে
গিয়ে অ্যারিস্টটল
বলেছেন "Comedy is an imitation of men worse than the average; worse
however not as regards any and every sort of fault but only as regards
particular kind. The riduculous which is a species of the ugly. The riduculous
may be defined as a mistake or deformity not productive of pain or harm to
others." অর্থাৎ অ্যারিস্টটলের মতে-
(1)
কমেডিতেচিত্রিত
মানুষের মধ্যে অসংগতি ও বৈসাদৃশ্যের চিত্রণ লক্ষ্য করা যাবে।
(2)
মানব
চরিত্রের ত্রুটি বিচ্যুতির দিকটা তুলে ধরা হবে।
(3)
জীবনসত্যের
আপাত লঘু দিকের মাধ্যমে জীবন-সত্যের গভীর দিকটা তুলে ধরে কমেডি।
(4)
সাধারণ
স্তরের মানুষের চিত্র আঁকা হয় এতে।
কমেডির বৈশিষ্ট্য
চিহ্নিত করতে গিয়ে নানা সমালোচক নানা লক্ষণের কথা বলেছেন তার মধ্যে মুখ্য হল কমেডির
পরিণতি মিলনাত্মক ও আনন্দজনক হবে।
কবি দান্তের
মতে কমেডির সূচনার অপ্রীতিকর অবস্থা পরিণতিতে আনন্দাদায়ক অনুভূতি জাগায়।
স্যার ফিলিপ
সিডনী ষোড়শ শতকে জোর দিয়েছিলেন কমেডির ভাব বৈশিষ্ট্যের উপর।
অষ্টাদশ
শতকের জর্জ ফার্কুহার কমেডিকে সুগ্রথিত এবং আনন্দ মাধ্যমে তিরস্কারের জন্য রচিত গল্পবিশেষ
বলে উল্লেখ করেছেন। স্যামুয়েল জনসন কমেডিকে 'dramatic representation of human
life as may excite mirth' রূপে ব্যাখ্যা করেছেন।
উনিশ শতকের
সমালোচক উইলিয়াম হ্যাজলিটের মতে কমেডির উদ্দেশ্য মানুষের দুর্বলতার হাস্যরসাত্মক রূপদান।
বিশ শতকের
সমালোচক অধ্যাপক এলারডাইস নিকল কমেডির কতকগুলি লক্ষণের কথা উল্লেখ করেছেন-
(i)
কমেডির
মধ্যে সাধারণত একক জীবনের নয় শ্রেণী চরিত্রের রূপ তুলে ধরা হয়।
(ii)
পরিচিত
সাধারণ মানুষের কথা কমেডিতে ব্যক্ত হয়।
(iii)
কমেডিতে
জটিল ধরনের বাস্তব সমস্যা থাকে না।
(iv)
কমেডিতে
থাকে টাইপ ধরনের চরিত্র।
(v)
কমেডিতে
ব্যঙ্গবিদ্রুপ থাকতে পারে হাস্যরসের উদ্ভাবনের জন্য, যেহেতু কমেডির মূলরস হাস্যরস।
হাস্যরস উৎপত্তির কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন তিনি-
(ক) নীচাশয় ব্যক্তির চরিত্র
বা মানস বিকৃতি
(খ) চরিত্রের অসংগতি,
(গ) চরিত্রের আচরণ, (ঘ)
বাক্চাতুর্য,
(ঙ) বাক্-বিকৃতি,
(চ) পরিস্থিতি ক্রিয়া-বচন
সৃষ্টির কৌশল,
(ছ) হিউমার,
(জ) ব্যঙ্গ,
(ঝ) হাস্যাস্পদ ব্যক্তির অসামাজিকতা থেকে জাত হাস্যরস।
• কমেডির উদ্ভব ও বিস্তার
কমেডির প্রাথমিক ইতিহাস অনেকটা অজ্ঞাত। অ্যারিস্টটলের সমকালীন ধারণা ছিল এই যে ডোরিয়ানরাই ট্র্যাজেডি ও কমেডির উদ্ভাবয়িতা। আনন্দোজ্জল ফ্যালিক শোভাযাত্রার গান থেকে কমেডির উদ্ভব ঘটেছে, বলে মনে করেছেন অ্যারিস্টটল। ডায়োনিসাসের উৎসবে লঘু-চপল আনন্দময় পরিবেশে শোভাযাত্রায় একদল যুবক এই ফ্যালিক গান গাইত। কবি আর্কন 'কমিক কোরাস'কে গৌরবদান করেছিলেন, এথেনীয় লেখকদের মধ্যে ক্রোটিস এ বিষয়ে আরো অগ্রসর হন। বেন জনসন, ড্রাইডেন, মলেয়ার, সেক্সপীয়র বার্ণাড শ' প্রমুখ পাশ্চাত্যে কমেডি রচনায় খ্যাতিলাভ করেছিলেন।
কমেডি নাটকের প্রকারভেদ বা শ্রেণীবিভাগ :-
নাট্যতত্ত্ববিদরা কমেডিকে কয়েকটি প্রকারভেদে বা শ্রেণীতে ভাগ করেছেন যথা -
১ - রোমান্টিক কমেডি বা কমেডি অব রোমান্স,
২ - কমেডি অব হিউমার,
৩ - স্যাটায়রিক্যাল কমেডি,
৪ - কমেডি অব ম্যানারস,
৫ - কমেডি আব ইনট্রিগ বা ষড়যন্ত্র মূলক কমেডি,
৬ - ফার্স বা প্রহসন কমেডি,
৭ - ব্ল্যাক কমেডি,
৮ - জেন্টল কমেডি।
রোমান্টিক কমেডি কাকে বলে (Comedy of Romance) :
যে কমেডির মধ্যে থাকে রোমান্স অর্থাৎ কল্পনার উচ্ছ্বাস তাকে রোমান্টিক কমেডি বলা যায়।
কমেডি অব হিউমার (Comedy of Humour) :
হিউমার মানে নির্ভেজাল হাস্যরস। এই জাতীয় কমেডিতে বিশুদ্ধ হাস্যরস ব্যবহৃত হয়। একটি আবেগপ্রবা প্রেক্ষাপট সৃজন করা হয়।
বেন জনসনের 'এভরিম্যান ইন হিজ হিউমার' ও 'এভরিম্যান আউট অব হিজ হিউমার, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের “কিঞ্চিৎ জলযোগ”, রবীন্দ্রনাথের 'বৈকুণ্ঠের খাতা'- এই শ্রেণীর কমেডির উদাহরণ।
স্যাটায়রিক্যাল কমেডি বা কমেডি অব স্যাটায়ার (Comedy of Satire):
এই শ্রেণীর কমেডিতে প্রকাশিত হয় সামাজিক অপরাধ এবং অপ্রাপ্তির কথা। এই অপরাধ সেই সব মানুষের যারা তাদের শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করেন। বলা যেতে পারে নাট্যকার বিদ্রূপের কশাঘাত চালান।
এই ধরণের কমেডির উদাহরণ বেন জনসনের 'ভোলপোন' (volpone) বা 'সেরিডান স্কুল ফর স্ক্যান্ডাল'; অ্যারিস্টো ফেনিস এর ‘ক্লাউড’ ও ‘বাউস', মধুসূদন দত্তের 'একেই বলে সভ্যতা' ইত্যাদি।
কমেডি অব ম্যানারস (Comedy of Manners) :
সামাজিক রীতিনীতি আচার-আচরণ প্রভৃতি যে কমেডির বিষয়বস্তু তাকে কমেডি অব ম্যানারস বলে। এখানে থাকে উইট বা বাগবৈদগ্ধ।
এই জাতীয় কমেডি শেক্সপীয়রের 'লাভস লাব লস্ট’, বার্নাড শ-এর 'আর্মস অ্যান্ড দি ম্যান', দীনব ‘বিয়ে পাগলে বুড়ো”, অমৃতলাল বসুর 'কৃপণের ধণ", রবিন্দ্রনাথের 'শেষরক্ষা' ইত্যাদি।
কমেডি অব ইনট্রিগ বা ষড়যন্ত্রমূলক কমেডি (Comedy of Intrigue):
ষড়যন্ত্রের জাল, জটিলতা ঘটনার
ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয় কমেডি অব ইনট্রিপে। প্রধান চরিত্র এই ষড়যন্ত্রের
শিকার হলেও শেষপর্যন্ত সমস্ত জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসে।
এই শ্রেণীর রচনা ড্রাইডেনের 'দ্যা স্প্যানিশ ফেয়ার', অমৃতলাল বসুর 'রূপান্নবর্ধনা' রবীন্দ্রনাথের 'বৈকণ্ঠেরখানা' ইত্যাদি।
ফার্স (Erace):
ফার্স এর বাংলা প্রহসন। সমাজ চরিত্রের ভন্ডামী অসংগতি যে নাটকে প্রকাশিত হয় তাকে ফার্স বলা হয়। এই অসংগতি ব্যঙ্গ ও বিদ্রূপসহ ব্যক্ত হয়। এটি লঘুস্তরের কমেডি।
ফার্সের উদাহরণ শেক্সীপীয়রের 'কমেডি অব এররস’ ও ‘হেনরি কোর’; মধুসূদন দত্তের 'একেই কি বলে সভ্যতা’ ও ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’; দীনবন্ধু মিত্রের 'সধবার একাদশী' ইত্যাদি।
ব্ল্যাক কমেডি (Black Comedy) :
যে কমেডিতে অসূয়া
(Cynicism) ও মোহমুক্তি (Disillusionment) প্রতিফলিত তাকে ব্ল্যাক কমেডি বলে। মানব
চরিত্র অজানা শত্রুর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে নিজের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। এই অবস্থাটাই
জীবনের অসংগতিরূপে প্রকাশিত। তবে এ কমেডি মূলত ফরাসী দেখা মেলে। এগুলিতে অ্যাবসার্ড
ভাবনা রয়েছে।
যেমন আয়েনেস্কোর লা চেয়ার বাজেনের ‘রাইনো', মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের 'রাজরক্তা, বাদল সরকারের 'বাকি ইতিহাস'।
জেন্টন কমেডি :
এছাড়া কেউ কেউ জেন্টল কমেডি বা ক্ল্যাসিক্যাল কমেডি-র কথাও বলেছেন। জেন্টল কমেডির বিষয় চরিত্রের নৈতিকতা। ক্ল্যাসিক্যাল কমেডি মূলত অ্যারিস্টটলীয় ধ্রুপদীরা প্রাচীন কমেডি।
ট্র্যাজেডি ও কমেডির মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে--
১. ট্র্যাজেডিতে ঘটনার শুরু থেকেই দুঃখজনক ঘটনা ঘটে এবং শেষ পর্যন্ত সেটাই থাকে। আর কমেডিতে শুরুতে সুখের ঘটনা ঘটে, শেষে হঠাৎ করেই দুঃখজনক ঘটনা ঘটে।
২. ট্র্যাজেডিতে নায়ককে অবশেষে পরাজয়ের সম্মুখীন হতে হয়। কমেডিতে নায়ক জয়ী হন।
৩. ট্র্যাজেডি থেকে দর্শকরা বেদনা ও জ্ঞান লাভ করে। আর কমেডি থেকে আনন্দ ও হাসি লাভ করে।
৪. ট্র্যাজেডিতে চরিত্র ও
ঘটনার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। কমেডিতে মূলত ঘটনার উপর জোর দেওয়া হয়।
কমেডি ও প্রহসনের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে--
১. কমেডির মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষকে হাসানো। কিন্তু প্রহসনের মূল উদ্দেশ্য হলো কোনো ব্যক্তি বা বিষয়কে ঠেলানো।
২. কমেডিতে মানব জীবনের ছোটখাটো ব্যাপারগুলোকে তুলে ধরা হয় যা সবার সাথেই সাদৃশ্য রাখে। কিন্তু প্রহসনে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা বিষয়কে লক্ষ্য করে কটাক্ষ করা হয়।
৩. কমেডিতে মিছিল হাস্যরস থাকে। সবার সাথে একাকার হওয়া যায়। কিন্তু প্রহসনে হাস্যরস বিরক্তিরস হয়ে উঠতে পারে।
৪. কমেডির চরিত্রগুলো বাস্তবিক
এবং সহানুভূতি প্রদর্শন করার মত হয়। কিন্তু প্রহসনের চরিত্রগুলো বাস্তবিক হয় না এবং
সহানুভূতি থাকে না।
কোন মন্তব্য নেই
ok