ঐতিহাসিক উপন্যাস : ড. নীলোৎপল জানা
ঐতিহাসিক উপন্যাস
ঐতিহাসিক উপন্যাসকে নির্দিষ্ট কোনও সংজ্ঞায় বিভূষিত করা যায় না। তথাপি আমরা এর আঙ্গিক ও বিষয়ের উপর দৃষ্টি আরােপ করে ধারণাগত একটা সংজ্ঞা রচনা করতে পারি--
ইতিহাসের কাহিনি ও চরিত্রকে আশ্রয় করে তার লেখক যখন ইতিহাসের অন্তরলােকে উকি দিয়ে একটি বিশেষ যুগ ও তার কিছু ঘটনা এবং ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, আশা নিরাশার কথা ফুটিয়ে তােলেন তখন তাকে বলা হবে ঐতিহাসিক উপন্যাস।
বস্তুত ইতিহাসের বিশাল পটভূমিতে পারিবারিক জীবনের ছবি আঁকা খুবই কঠিন। ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে তৎকালীন দৈনন্দিন জীবনের সংযােগ সাধনের অনিবার্যতা বুঝে নেওয়াও অনেক সময় সহজ হয় না।
ঐতিহাসিক উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য:
একটা সার্থক ঐতিহাসিক উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য কি কি হওয়া আবশ্যক তা সূত্রাকারে নিম্নে দেওয়া হল-
- সমসাময়িক জীবনের বিষয় বস্তু বা বাস্তব চরিত্র সমূহের পরিবর্তে ঐতিহাসিক উপন্যাসে উপন্যাসকার বেছে নেন অতীত ইতিহাসের কোনও একটি বিশেষ সময় পর্ব।
- উপন্যাসের বর্ণিতব্য যুগ তথা ঘটনা-কাহিনির প্রতি তাঁকে বিশস্ত থাকতে হয় সেই সময় কালের রীতি-নীতি, আচার ব্যবহার সংস্কার পােশাক পরিচ্ছদ ইত্যাদি সকল বিষয়ে লেখককে সচেতন থাকতে হয়।
- ঐতিহাসিক উপন্যাসের নায়ক নায়িকা তথা প্রধান কুশীলব সকলেই হন ইতিহাসের সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। তাঁরা কেউ আপন কীর্তির বলে কীর্তিমান আবার কেউ দরুণ।এইসব চরিত্রের রূপায়ণে ঔপন্যাসিকে ইতিহাসের প্রতি যথাসম্ভব বিশ্বস্ত থাকতে হয়।
- অবশ্য শিল্পগত প্রয়ােজন বা মূল্যের তাগিদে ঔপন্যাসিক কিছু কিছু উদ্ভাবন বা পরিবর্তন করতে পারেন।
- ইতিহাসাশ্রিত চরিত্রগুলির ঐতিহাসিকতা যথাসম্ভব অক্ষুন্ন রেখেও তাদের যথেষ্ট প্রাণবন্ত করে তােলা ও উপন্যাসে জীবন ভাবনা ব্যক্ত করার ক্ষমতাই ঐতিহাসিক উপন্যাস কারের কাছ থেকে প্রত্যাশিত।
- ঐতিহাসিক উপন্যাসের কারবার ঐতিহাসের বিশাল পটভূমিতে আবর্তিত জীবনের উত্থান পতন নিয়ে। ইতিহাসের সামাজিক রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সংঘাত, আবেগ আলােড়ন এই জাতীয় উপন্যাসের প্রধান অবলম্বন।
- ঐতিহাসিক উপন্যাসে থাকে মহাকাব্যিক বিস্তার ; একটি বিশেষ স্থান কালের সীমা অতিক্রম করে উপন্যাস পায় বিশ্বজনীন ব্যাপ্তি।
- মহাকাব্যের সঙ্গে ঐতিহাসিক উপন্যাসের এই হৃদ্যতার কারণেই তার ভাষাকে হতে হয় গম্ভীর ও ধ্রুপদী।
বঙ্কিমচন্দ্রের রাজসিংহ ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসটির কাহিনি, ভাষা ও গঠন কৌশল দেখে সহজেই সবাই ‘চন্দ্রশেখরকে’ ঐতিহাসিক উপন্যাসরূপে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র রাজসিংহ উপন্যাসের ভূমিকায় বলেছেন- “পরিশেষে বক্তব্য যে আমি পূর্বে কখনও ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখি নাই। ‘দুর্গেশ নন্দিনী’ বা ‘চন্দ্র শেখর’ বা সীতারামকে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা যাইতে পারে না। এই প্রথম ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখিলাম।”
• একটি সার্থক ঐতিহাসিক উপন্যাস: রাজসিংহ
ইতিহাসাশ্রয়ী উপন্যাস আর ঐতিহাসিক উপন্যাসের মধ্যে পার্থক্যের সীমারেখা বঙ্কিমচন্দ্রের আমলে নির্মিত না হলেও বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ইতিহাস ও রোমান্স অবলম্বী সাতটি উপন্যাসকে ঐতিহাসিক উপন্যাস না বলে কেবল 'রাজসিংহ' উপন্যাসটিকেই ঐতিহাসিক উপন্যাস বলেছিলেন। কারণ ইতিহাসের সত্য পথকে এখানে তিনি অনুসরণ করতে পেরেছিলেন যথাযথভাবে; কল্পনার হাত ধরে ইতিহাসের অপ্রাপ্ত তথ্যের খানাখন্দ ডিঙোতে হয়নি। আর সম্ভবত সে কারণেই এ উপন্যাসের ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন 'এই প্রথম ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখিলাম।'
কর্ণেল টডের 'Annals and Antiquities of Rajasthan' গ্রন্থ থেকে 'রাজসিংহে'র কাহিনী সংগৃহীত হয়েছে। তা ছাড়া দু'একটি ঐতিহাসিক তথ্য ও ইতিহাসেরও সাহাব্য নিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। 'রাজসিংহে'র মূল কাহিনী নিম্নরূপ-
রাজপুতানার একটি ছোট্ট রাজ্য রূপনগর। এই রাজ্যের রাজকন্যা চঞ্চলকুমারী রূপে, গুণে, সাহসে, সৌন্দর্যে অতুলনীয়। মেবারের রাণা প্রৌঢ় রাজসিংহের অসাধারণ বীরত্বের কথা শুনে তাঁর প্রতি অনুরাগিনী হয়ে উঠেছেন চঞ্চলকুমারী। একদিন এক চিত্রবিক্রেতার কাছে নানা চিত্র দেখতে দেখতে ঔরংজেবের চিত্রটিও হাতে পড়ে তাঁর। নিদারুণ ঘৃণায় তিনি সেই চিত্রটি মাটিতে ফেলে পদদলিত করে সেটি ভেঙে দেন। ঔরংজেব এ খবর পেয়ে রাজকন্যার গর্ব খর্ব করার উদ্দেশ্যে সেনানায়ক মবারকের অধীনে এক বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন-তাঁকে নির্দেশ দেন রূপনগর থেকে চঞ্চলকুমারীকে তাঁর হারেমে নিয়ে যাবার।
ঔরংজেবের ক্রোধ ও তাঁর সেনা পাঠানোর খবর শুনে চঞ্চলকুমারী রাণা রাজসিংহের কাছে এ ব্রাহ্মণকে দিয়ে একটি পত্র পাঠান। সে পত্রে তিনি নিজেকে রাজসিংহের হাতে সমর্পণ করার আকাঙ্ক্ষা এবং তাঁকে রক্ষা করার আবেদন জানান। মাত্র একশ' জন্য সৈন্য নিয়ে বুদ্ধিবলে রাজসিংহ মবারকের বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে। চঞ্চলকুমারীকে রক্ষা করো নিজের অন্দরমহলে নিয়ে যান কিন্তু চঞ্চলকুমারীর পিতা বিক্রম সোলাঙ্কির মত না থাকায় তাঁকে তিনি বিবাহ করতে পারেননি।
এদিকে দরিয়া বিবির প্রতি মবারকের দুর্বলতার খবর পেয়ে ক্রুদ্ধা প্রেমিকা, ঔরংজেব তনয়া জেবুন্নিসা কৌশলে মবারকের ব্যর্থতার জন্য সম্রাটের মাধ্যমে তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়ান। সর্পদংশনের বিষক্রিয়া থেকে মবারককে বাঁচিয়ে মাণিকলাল তাকে নিয়ে যায় রাজসিংহের কাছে।
অন্যদিকে রাজসিংহকে শাস্তি দেবার জন্য ঔরংজেব মেবার আক্রমণ করেন কিন্তুরাণার বুদ্ধিবলে এবং মবারকের কৌশলে বিশাল মুঘল বাহিনীর থেকে সম্রাট বিচ্ছিন্ন হয়ে গিরিপথে বন্দী হন। ফলে রাজসিংহের ইচ্ছে অনুযায়ী ঔরংজেব নিজেই সন্ধির প্রস্তাব পাঠান। কিন্তু দিল্লী ফিরে গিয়েই ঔরংজেব সন্ধিপত্র ছিঁড়ে ফেলে আবার বিশাল বাহিনী পাঠান। রাজসিংহ এবং তাঁর পুত্রদের পরাক্রমে প্রতিটি যুদ্ধক্ষেত্রেই ঔরংজেবের বাহিনী পরাজিত হলে বাধ্য হয়েই ঔরংজেব তাঁর সঙ্গে নতুন করে সন্ধি করেন। বিক্রম সোলাঙ্কির রাজসিংহের হাতে কন্যা দান করেন।
'রাজসিংহ' উপন্যাসে ঐতিহাসিক ঘটনাকে যথোচিত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর প্রধান চরিত্রগুলি প্রায় সবই ঐতিহাসিক। রাজসিংহ, ঔরংজেব, জয়সিংহ, জেবুন্নিসা, যোধপুরী বেগম প্রভৃতি চরিত্রগুলি ইতিহাস থেকে নেওয়া। উপন্যাসের প্রয়োজনে কতকগুলি কাল্পনিক চরিত্রও সৃষ্টি করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র। মাণিকলাল, নির্মলকুমারী, দরিয়া বিবি প্রভৃতি চরিত্র। মূলকাহিনীকে যথাযথভাবে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে, তার দীপ্তিকে আরো বাড়ানোর প্রয়োজনে- বঙ্কিমচন্দ্র এ উপন্যাসে দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপকাহিনী সৃষ্টি করেছেন,-
(i) মাণিকলাল-নির্মলকুমারী উপকাহিনী।
(ii) জেবুন্নিসা-মবারক-দরিয়া বিবি উপকাহিনী।
অ্যারিস্টটল বলেছেন ইতিহাসে থাকে ব্যক্তির কৃত্য কিন্তু ঐতিহাসিক রচনায় ঘটে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের প্রকাশ। ঔরংজেবের ঐতিহাসিক চরিত্রের প্রকাশ ও উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র ঔরংজেবকে সেরকমই আত্মকেন্দ্রিকরূপে এঁকেছেন বটে কিন্তু একটা ক্ষেত্রে তাঁর চরিত্রের অনালোকিত দিকের উপর সন্ধানী আলোক নিক্ষেপ করে ঔপন্যাসিক সযত্নে তাঁর আবৃত হৃদয়কে অনাবৃত ও গোচরীভূত করে তুলেছেন পাঠকের কাছে। এ ক্ষেত্রটি হল নির্মলকুমারীর সঙ্গে ঔরংজেবের সম্পর্কের ক্ষেত্র। ঔরংজেবের কাছে নির্মলকুমারী সাধের ইমলি বেগম। দিল্লীর বাদশাহের প্রেমবুভুক্ষু অন্তরের পরিচয় নির্মলকুমারীর সঙ্গে ঔরংজেবের কথোপকথন পরিস্ফুট হয়েছে।
'রাজসিংহ' উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র ঐ যুগের tone and temper of the age-কে যথাযথরূপে তুলে ধরেছেন-পোশাক-আশাকের তো কথাই নেই, সে যুগে রাজপুরুষেরাও যে জ্যোতিষ গণনার উপর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এখানে সে চিত্রও আঁকা হয়েছে একাধিকবার- শুধু তাই নয় মবারকের জীবনে জ্যোতিষ গণনা অভ্রান্তভাবে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তাছাড়া সে যুগে মুঘল হারেমে সংবাদ ক্রয়-বিক্রয়ের পদ্ধতি, সম্রাটের কন্যার কোপে পড়লে কিভাবে কাউকে পৃথিবী থেকে সরে যেতে হত-তাও দেখানো হয়েছে মবারকের সর্প দংশনে মৃত্যুতে পাঞ্জার সাহায্যে কিভাবে সেকালে যত্রতত্র যাওয়া-আসা করা যেত, পায়রার সাহায্যে পাঠানো যেত সংবাদ-তাও দেখানো হয়েছে নির্মলকুমারী উপকাহিনীর মাধ্যমে।
'রাজসিংহ' উপন্যাসের মূল রস রবীন্দ্রনাথের মতে 'ঐতিহাসিক রস' বা 'মানব রস'। ইতিহাসের পুরানো পৃষ্ঠার কথা উপন্যাসের পৃষ্ঠায় সজীব হয়ে উঠেছে এ রসের গুণে। রবীন্দ্রনাথ 'রাজসিংহে'র গতিকে সৈন্যদলের চলার সাথে তুলনা করেছেন। সার্থক ঐতিহাসিক উপন্যাসের যে লক্ষণগুলি থাকা দরকার তার সবই 'রাজসিংহ' উপন্যাসে আছে। তাই 'রাজসিংহ' উপন্যাসকে বাংলা সাহিত্যের একটি সার্থক ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা যেতে পারে।
কোন মন্তব্য নেই
ok