ঔপন্যাসিক তারাশঙ্করের অভিনবত্বের দিকগুলি চিত্রিত করুন।
ঔপন্যাসিক তারাশঙ্করের অভিনবত্বের দিকগুলি চিত্রিত করুন।
শরৎচন্দ্র পরবর্তী বাংলা কথাসাহিত্যে তারাশঙ্কর
বন্দ্যোপাধ্যায় এক অনন্য ব্যক্তিত্ব (১৮৯৮-১৯৭১)। রবীন্দ্রোত্তর পর্বে তারাশংকর একজন
যথার্থ শিল্পী। তিনি ৪৫ বৎসর ধরে কথাসাহিত্যে পদচারণা করেছেন। এই অর্ধশতাব্দীর সমস্ত
তরঙ্গ বিক্ষোভ তারাশঙ্করের গল্প- উপন্যাসকে স্পর্শ করেছে কিন্তু সমকালীনতার গণ্ডী অতিক্রম
করে লেখক হয়ে উঠেছেন সর্বকালের। তারাশঙ্কর বলেছিলেন-মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ।
এই ঘোষণা তাঁর উপন্যাস-ছোটগল্পে রক্ত-মাংস-মজ্জা, তাঁর মন-প্রাণ-আত্মা, তাঁর শিল্পের
দলিল। এক কথায় সুস্থ জীবনের মৌরসী পাট্টা।
তারাশঙ্করের দেশকাল চেতনাটি ছিল ঐকান্তিক-তাঁর
জীবনবোধ এবং জীবনবিন্যাসে তাই মহাকাব্যের ব্যাপ্তি এবং অমোঘতা। বীরভূম জেলার ব্রাহ্মণ
জমিদার চালিত গ্রামে ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারে জন্মে গ্রামজুড়ে দরিদ্র অশিক্ষিত আদিবাসী
মানুষের জীবনের সঙ্গে খুঁজে পেয়েছিলেন অন্তরের যোগ। আর একদিকে প্রত্যক্ষ করছিলেন, জমিদারি
আভিজাত্যের সামাজিক বুনিয়াদ ভেঙে গিয়ে চারপাশে গড়ে উঠছিল অর্থগুন্নু আত্মসর্বস্ব ধনতান্ত্রিক
জীবন ব্যবস্থা, সমাজ ভেঙেই যার জন্ম। সেই সঙ্গে শিল্পী আকৃষ্ট হয়েছিলেন গান্ধীপন্থী
আন্দোলনে। সমাজে আর্থ রাজনৈতিক বিপত্তির ঐতিহাসিক তরঙ্গটির সঙ্গেও তাঁর যোগ ছিল আন্তরিক।
প্রধানত গ্রামজীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সংযোগে গল্প উপন্যাসের থীম গড়েছেন তারাশঙ্কর।
তার সঙ্গে কালের ওঠাপড়াকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে নিয়ে জীবনের একটা পরিব্যাপ্ত সামগ্রিক রূপ
গড়ে তুলতে চেয়েছেন উপন্যাসে এবং গল্পেও। সেই জন্যেই গল্পগুলো সঠিক ছোটগল্প হয়ে উঠেনি-উপন্যাসে
ধরতে চেয়েছে মহাকাব্যের অবয়ব। রূপের নিটোলতায় না হোক, জীবন সংবেদনের অমোঘতায় তারাশঙ্কর
তাঁর কালের শ্রেষ্ঠ উত্তীর্ণ শিল্পী, আর সে জীবন একান্তভাবে বীরভূমের শিল্পী-পরিচিত
আঞ্চলিক জীবন।
অচিন্ত্য সেনগুপ্ত বলেছেন, তাঁর সাহিত্যের দুই প্রধান উপজীব্য মাটি আর মানুষ। মাটির মমত্ব আর মানুষের মহিমা। একথা যথার্থ। প্রসঙ্গত বলা যায়, চল্লিশের যুগে সমাজকে ব্যাপক এবং সমগ্ররূপে দেখার প্রবণতা আমাদের সাহিত্যে যেমন দেখা যেতে থাকে, তেমন আসে সমাজ ও ব্যক্তি জীবনের ঘটনা পর্যায়কে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক কার্যকারণ সূত্রের মাধ্যমে দেখার চেষ্টা। তারাশঙ্কর এই কাজে অগ্রসর হয়েছিলেন, কিছুটা সাফল্যও দেখিয়েছিলেন। তারাশঙ্করের আর একটা বড় কৃতিত্ব, বাংলা সাহিত্যের পরিধি সম্প্রসারণে। রবীন্দ্রনাথ গল্পগুচ্ছে। বাঙালি সমাজের থেকে চরিত্র ও ঘটনাগত উপাদান সংগ্রহের কৃতিত্ব দেখালেও তার পরিমাণ সীমিত, শরৎচন্দ্র সেক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রসর হতে পেরেছিলেন। কিন্তু তারাশঙ্কর যেভাবে ও যতটুকু বাঙালির সমাজজীবনকে, জীবনের অন্তর্গত চরিত্রকে সাহিত্যরূপ দানের চেষ্টা করেছেন তার তুলনা নেই। অনেকদিন আগে শ্রীযুক্ত অতুলচন্দ্র গুপ্ত এক সাহিত্য সভায় তারাশঙ্করকে বঙ্গ সরস্বতীর খাসতালুকের মণ্ডল প্রজা আখ্যা দিয়েছিলেন। এ আখ্যা নিঃসংশয়ে সার্থক বলা
কোন মন্তব্য নেই
ok