রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলির বিষয়ে একটি প্রবন্ধ : ড. নীলোৎপল জানা
রবীন্দ্রনাথের
প্রথম দুটি উপন্যাস 'বউঠাকুরাণীর হাট' ও 'রাজর্ষি'-তে বাংলাদেশ ও ত্রিপুরার ইতিহাসের
কাহিনি অনুসৃত হয়েছে। তাই বলা যায় এ দুটি উপন্যাস ইতিহাসাশ্রিত রচনা যা বঙ্কিমের আদর্শে
গড়া। আসলে এ দুটি উপন্যাস রচনার সময় রবীন্দ্রনাথ ততটা পরিপস্তু হয়ে ওঠেননি। তাই বঙ্কিমের
ছত্রছায়ায় তাঁর নিজস্ব আঙ্গিক ও শৈল্পিক সৃজনপ্রক্রিয়া পরিণতি লাভ করতে পারেনি। তাই
এতে উচ্চশ্রেণীর উপন্যাসের কলাকৌশল বড় একটা ফুটে উঠতে পারে নি। কিন্তু অচিরেই বঙ্কিম
উপন্যাসের ধারা পরিত্যাগ করে রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করে নিলেন নিজস্ব বস্তুতান্ত্রিক উপন্যাসের
ধারা। ১৩০৮-০৯ সালে বঙ্গদর্শনে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হল এক বড় ধরনের উপন্যাস 'চোখের
বালি'। 'চোখের বালি'তে মনোবিশ্লেষণের বৈপ্লবিক নতুনত্ব সঞ্চারিত হল। বাংলা উপন্যাসে
বঙ্কিমচন্দ্রের 'কৃষ্ণকান্তের উইল' এর পর বড় রকমের পালাবদল ঘটল 'চোখের বালি'তে। এই
উপন্যাসের মূল উপজীব্য হল সমাজনীতি বিবর্জিত প্রেম।
বাল্যবিধবা
বিনোদিনী'র চিত্তে পুরুষের প্রতি দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা জন্য এবং তার মানসিক পরিবর্তনের
টানাপোড়েন এই উপন্যাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বোধ করি পরবর্তীকালে এ আদর্শই শরৎচন্দ্রকে
'চরিত্রহীনের' কিরণময়ী চরিত্র সৃষ্টিতে প্রেরণা দিয়েছিল। মহেন্দ্র, আশা, বিহারী ও বিনোদিনী-দু'জন
পুরুষ ও দু'জন স্ত্রীলোকের জীবনের সমস্যা কিভাবে এমন জটপাকিয়ে গেল কেমন করে তার গ্রন্থিমোচন
হল বাঙালি সমাজ পারিবারিক জীবনের যুগ সঞ্চিত সংস্কারে কবিগুরু কীভাবে আঘাত দিলেন, তার
এক বিচিত্র, বলিষ্ঠ, বিশ্লেষণাত্মক বর্ণনা-এ উপন্যাসে পাওয়া যায়। বঙ্কিমচন্দ্রও বিধবার
মনীর পুরুষাসক্তি সহ্য করতে পারেন নি। অপরাধিনীকে হয় বিষপানে আর না হয় পিস্তলের গুলিতে
পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ বাল্য বিধবার প্রেমকে স্বীকার করতে পারেন নি
আবার তাকে সমাজ সংস্কারের স্বাভাবিক জীবনের মধ্যেও প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজন বোধ করেন
নি। যাথেকে মনস্তত্বের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ, ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া, অবচেতন সত্ত্বার নিগূঢ়
ইঙ্গিত, সমাজ সংস্কারের সঙ্গে স্বাভাবিক প্রবৃত্তির সংঘাতের ফলে নারী জীবন কোন পরিণতির
দিকে অগ্রসর হয়, রবীন্দ্রনাথ অদ্ভুত নিপূণতার সঙ্গে সে কথা বলেছেন। গীতিকবির পক্ষে
এভাবে কঠোর বাস্তবকে অনুসরণ ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মনোবিশ্লেষণ বিস্ময়কর ব্যাপার সন্দেহ
নেই। বঙ্কিমচন্দ্রের 'বিষবৃক্ষ', 'কৃষ্ণকান্তের উইল' ও 'রজনী'তে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের
সূচনা হয়েছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের 'চোখের বালি'-তে বাস্তবতার দিক থেকে আরও গভীর ও
ব্যাপক বিশ্লেষণ লক্ষ করা যায়।
'চোখের বালি'র
কয়েক বছর পর 'নৌকাডুবি' উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। এর কাহিনি ও চরিত্রের মধ্যে তেমন কোন
বৈচিত্র্য নেই। 'চোখের বালি'র লেখকের পরিণত ও পরিপক্ক লেখনী থেকে কাহিনি সর্বস্ব দ্বিতীয়
শ্রেণির এই উপন্যাস কিভাবে জন্মলাভ করল তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের 'কপালকুন্ডলা'র
পর 'মৃণালিনী'তে যেমন উৎকৃষ্ট প্রতিভার পরিচয় ছিলনা, আর কেনই বা এরকম হল সে বিষয়ে কোন
কারণ নির্দেশ করা যায় না, তেমনি 'চোখের বালি'র পর তরল রোমান্সাশ্রয়ী ঢিলেঢালা ধরনের
'নৌকাডুবি' কেন রচিত হল তার কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঘটনা সূত্রের আকস্মিকতায় চরিত্রগুলিও
আবর্তিত হয়েছে। তবে রমেশ ও হেমনলিনী চরিত্রদ্বয় মাঝেমধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাতময় জীবনের
সজীবতায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। হেমনলিনী চরিত্রটি এজন্যই উল্লেখযোগ্য যে পরবর্তীকালে
রবীন্দ্র উপন্যাসে এরকম নারী চরিত্রই ঘুরে ফিরে দেখা গেছে। যেমন-সুচরিতা, লাবণ্য, কুমুদিনী।
পরবর্তীকালে লেখা রবীন্দ্রনাথের আরেকটি জটিল চরিত্রধর্মী উপন্যাসের নাম করতে পারি।
তার নাম 'যোগাযোগ'। এ উপন্যাসটি 'বিচিত্রা' পত্রিকায় 'তিনপুরুষ' নামে প্রকাশিত হয়েছিল।
মধুসূদন ও কুমুদিনীর বিড়ম্বিত দাম্পত্য জীবনের অশান্তি ও তার পরিণাম এ উপন্যাসের মুখ্য
বিষয়। উপন্যাসটিতে মনস্তাত্ত্বিক দাবী পুরোপুরি রক্ষিত হয়নি। চরিত্রগুলিতেও বৈচিত্র্যের
অভাব রয়েছে। যা হোক সবশেষে বলতে পারি এ পর্বের উপন্যাসগুলির মনস্তাত্ত্বিক বৈচিত্র্য
এবং প্রায়শই নারীর মনস্তত্ব লক্ষণীয়।
বিংশ শতকের
গোড়ারদিকে অশান্ত সমাজ ও বিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক চেতনার আঘাতে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস বিশাল
পটভূ মিকায় জীবনের বৃহত্তর সমস্যার সমাধানে এসে দাঁড়ায়। 'গোরা', 'ঘরে বাইরে' ও 'চার
অধ্যায়' এ যুগধর্ম নর-নারীর জীবনকে কেমনভাবে প্রভাবিত করতে পারে, রাজনীতি, স্বাদেশিকতা
ও সমাজ সমস্যার উদ্বেল তরঙ্গমালা বাঙালি জীবনকে কতটা সংক্ষুব্ধ করছিল তার প্রকৃষ্ট
দৃষ্টান্ত এই উপন্যাসগুলি। 'গোরা' উপন্যাসটি তাই আধুনিক ভারতীয় সাহিত্যে একটি যুগান্তকারী
উপন্যাস। যাকে তুলনা করা যায় ইউরোপের এপিক
নভেলের সঙ্গে।
আকারে, প্রকারে, ভাবে, আদর্শে'গোরা' মহাকাব্যের মতোই বিশাল। আর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের
প্রতিক্রিয়ায় যখন দেশের মধ্যে সন্ত্রাসবাদী আবহাওয়া উত্যক্ত হয়ে উঠেছিল, তারসঙ্গে দাম্ভিক
দেশপ্রেম যা অগ্রপশ্চাত বিবেচনা ত্যাগ করে, প্রচণ্ড লোভের মধ্যে সমস্ত শুভ প্রচেষ্টাকে
ব্যর্থ করে দেয়, তারই পটভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ 'ঘরে বাইরে' উপন্যাসটি রচনা করেন। একসময়
রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। কিন্তু সমস্ত আন্দোলন যখন গুপ্ত ষড়যন্ত্রের
রূপ নেয়, তখন সেই তামসিক মত্ততা থেকে সরে দাঁড়ালেন রবীন্দ্রনাথ। স্বাদেশিকতার নাম করে
নির্জলা প্রমত্ততাকে প্রশ্রয় দেওয়া রবীন্দ্রনাথের রুচিকে তীক্ত করে তুলেছিল। আর সেই
তিক্ততা প্রকটভাবে ধরা পড়েছে 'ঘরে বাইরে' উপন্যাসে। আর 'ঘরে বাইরে'র বেশ কিছু পরে আগ্রাসী
জাতীয়তাবাদ ও সন্ত্রাসবাদের কবলে নর-নারীর আপন স্বরূপ কীভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যায় তারই
মর্মন্তুদ কাহিনি নিয়ে তিনি লিখলেন 'চার অধ্যায়'। অতীন্দ্র ও এলার সেই ব্যর্থতার কথা
এই উপন্যাসে মাত্র চার অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে।
উপরিউক্ত
উপন্যাসগুলি ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ দু'একটি উপন্যাসে অসাধারণ কল্পনা বৈচিত্র্য ও রোমান্সের
ঐশ্বর্যকে ফুটিয়ে তুলেছেন। 'চতুরঙ্গ'-এ মিষ্টিক জীবন রহস্য ও 'শেষের কবিতায়' মর্ত্যজীবনকে
রোমান্টিক পটভূমিকায় উন্নীত করার আশ্চর্য্য কৌশল ফুটে উঠেছে। 'চতুরঙ্গে' সতীশ দামিনীর
যে বিচিত্র মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ও সম্পর্কের টানাপোড়েনের আভাস ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে
তাকে শুধু মনোবিজ্ঞানের সাহায্যে বিশ্লেষণ করা যায় না। চেতন মনের অন্তরালে যে রসের
ধারা বহমান আমাদের দেশের বাউল সহজিয়া সাধকরা যে রসে রসিক, সতীশ সে তত্ত্বে বিশ্বাসী।
অপরদিকে দামিনী সতীশকে রূপচেতনা ও পার্থিব সত্ত্বার মধ্য দিয়ে কামনা করে। যুদ্ধোত্তরকালের
আদর্শ সন্ধানী যুবক সতীশ 'শ্রাবণ মেঘের' ভিতরে দামিনীর প্রেম প্রত্যাখ্যান করে অগ্রসর
হয়েছে। একের পর এক ছক ভেঙ্গে এগিয়েছে সতীশ। জীবনের পরীক্ষা নিরীক্ষার আবর্ত সংকুল পথ
সোপানের পর সোপান অতিক্রম করতে হয়েছে সতীশকে। দামিনীও জীবন দিয়ে জীবনলাভ করেছে।
রবীন্দ্রনাথের
শেষ জীবনে রচিত কাব্য ধর্মী ও রোমান্সাশ্রিত উপন্যাস হল 'শেষের কবিতা'। এ যেন এক বিচিত্র
বিস্ময়। তখন রবীন্দ্রনাথ সুবৃদ্ধ। কল্পনাভিত্তির কিঞ্চিৎ খর্বতা হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু
রবীন্দ্রনাথ যেন শেষের কবিতায় নতুন রামগিরি, নতুন অলকাপুরীর অপার্থিব সৌন্দর্যের সৃষ্টি
করলেন। অবশ্য শেষের কবিতাকে পুরো দস্তুর উপন্যাস বলা যায় কিনা সে বিষয়ে বিতর্ক থেকে
যায়। প্রচুর কাব্যধর্ম উৎকৃষ্ট গীতিকবিতার স্তবক এবং রোমান্সের উচ্ছ্বাস এই গ্রন্থকে
ক্ষণে ক্ষণে গদ্য কাব্যে রূপান্তরিত করেছে। অমিত লাবণ্যে প্রেমের আখ্যান এ কাহিনির
প্রধান উপাদন হলেও এ কাব্যে কবি একটি গভীর তাৎপর্য সংযোজিত করেছেন। দৈনন্দিন বিবাহিত
জীবনের কর্তব্য পীড়িত গতানুগতিকতা এবং অপার্থিব রোমান্টিক প্রেমের স্বপ্নাভিসার-এ দুয়ের
মধ্যে মিল ঘটানো দুঃসাধ্য। তাই অমিত লাবণ্য পরস্পরের প্রেমকে উর্দ্ধশ্বাস তাড়নার দ্বারা
মলিন না করে অমিত কেতকীকে এবং লাবণ্য শোভনলালকে সামাজিক বিবাহ করল। ঘড়ার জলে তৃষ্ণা
মিটল কিন্তু সমুদ্রের জলের অশ্রু লবণাক্ত আস্বাদ উভয়ের মনে জন্মান্তরিন সুখ সৌভাগ্যের
মত বেঁচে রইল। এ উপন্যাস সম্বন্ধে অবশ্যই বলা দরকার, সেকালের তরুণ সম্প্রদায় যারা রবীন্দ্রযুগ
চলে গেছে বলতে আরম্ভ করেছিলেন, তারাও হতচকিত হয়ে গেলেন। আর সেজন্য কথা
সাহিত্যে
আধুনিকতার ইতিহাসে 'শেষের কবিতার' একটি যথার্থ মূল্য আছে।এগুলি ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের
আরো দুটি উপন্যাস হল 'মালঞ্চ' ও 'দুই বোন'। যদিও এগুলি আখ্যানধর্মী গদ্য রচনা, যথার্থ
উপন্যাসের আকার লাভ করতে পারেনি। আসলে ছোট গল্পের আখ্যান থেকে একটু দীর্ঘায়ত করে উপন্যাসের
রূপ দেওয়া হয়েছে। নারী দু'ই রূপে পুরুষের জীবনে প্রভাব বিস্তার করে। প্রিয়া রূপে ও
জননী রূপে। প্রধানত এই তত্ত্বটি দুই বোনের শর্মিলা, উর্মিলা ও শশাঙ্কের কাহিনির মধ্য
বিবৃত হয়েছে। এ সমস্যাই আরেকটু ভিন্ন দিক থেকে 'মালঞ্চ' উপন্যাসে নীরজা, সরলা ও আদিত্যের
জীবনে রূপায়িত হয়েছে। এ দুটি উপন্যাসই ছোট গল্পের কলমে লেখা, ঘটনা ও চরিত্রের পরিপূর্ণতাও
মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব আভাসে ইঙ্গিতে ব্যক্ত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ
মূলত কবি, ভাব রসেই তাঁর আত্মার মুক্তি। ঔপন্যাসিকের যে ধরনের বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি ও
বিশ্লেষণমূলক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন গীতিকবিরা ঠিক সে জাতের শিল্পী নন। কাজেই রবীন্দ্রনাথের
অনেক উপন্যাসে বাস্তব চিত্রগুলি কল্পনার রঙে রঙীন হয়ে উঠেছে। সেজন্য সাধারণ পাঠক রবীন্দ্র
কবিতায় মুগ্ধ হলেও তাঁর উপন্যাসের জনপ্রিয়তা শিক্ষিত সমাজে বেশি করে সীমাবদ্ধ। সে যাই
হোক রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসও যে একটা অসাধারণ শিল্পকর্ম এবং বাংলা উপন্যাসে দিক নির্দেশ
করেছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
কোন মন্তব্য নেই
ok