বাংলা উপন্যাস যথার্থ পরিণতি লাভ করেছে বঙ্কিমচন্দ্রের লেখনীতে : ড. নীলোৎপল জানা
. 'বাংলা উপন্যাস যথার্থ পরিণতি লাভ
করেছে বঙ্কিমচন্দ্রের লেখনীতে' মন্তব্যটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করুন।
সঙ্গীতে
সুরমূর্ছনায় মানুষের হৃদয়ে যেমন আনন্দের দোলা লাগে উপন্যাসও তেমনি সুরসৃষ্টি করতে পারে।
কাহিনি, আখ্যায়িকা, চরিত্রের মধ্যে পূর্ণ সামঞ্জস্য সৃষ্টি হলে আমরা সুরের পরিচয় পেয়ে
থাকি। উপন্যাসে সমাপ্তি নয় বিস্তীর্ণতাই মূল কথা শ্রেষ্ঠ উপন্যাস পাঠ করার পর আমাদের
মনে একটি বিশেষ সুর বাজতে থাকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে বঙ্কিমচন্দ্র উপন্যাসের
রাজপুত্রকে সাহিত্যের দরবারে এনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করলেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,-
"বঙ্কিম আনলেন সাত সমুদ্র
পারের রাজপুত্রকে
আমাদের সাহিত্য রাজকন্যার
পালঙ্কের শিয়রে।“
এর ফলে মানুষের হৃদয় বীণায়
বেজে উঠল এক নতুন সুর। বাঙালির জীবনকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য আদর্শের মিলনভূমিতে স্থান
করে মননশীল সাহিত্য, কথা সাহিত্য, দেশ ও দশের কথা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালীকে
ঊনবিংশ শতাব্দীর জীবনরস ও প্রাণবাণীতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র ঊনবিংশ শতাব্দীর
জীবনরস ইংরেজী রোমান্সাশ্রয়ী ঐতিহাসিক উপন্যাসিক (স্যার Walters Scott) এর আদর্শে এবং
সামাজিক, পারিবারিক কথাসাহিত্যের আদর্শে যে সমস্ত উপন্যাস লিখেছেন আজ সে সব গ্রন্থের
দেশকাল বহুদুরে সরে গেলেও তাঁর গ্রন্থের জনপ্রিয়তা কিছুমাত্র হ্রাস পায়নি। বাস্তবতা,
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মধ্যযুগ প্রীতি মনস্তত্ব ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে তিনি আমাদের ১৪ খানি
উপন্যাস উপহার দিয়েছেন। তাঁর জীবিতকালের শেষ ২২ বছরের মধ্যে (১৮৬৫-১৮৮৭)।
সন তারিখের ক্রমহিসাবে তাঁর ১৪ খানি উপন্যাসের
তালিকা নিম্নরূপ-
(১) 'দুর্গেশনন্দিনী' (১৮৬৫-যদিও এর আগে ১৮৬৪
সালে ইন্ডিয়ান ফিল্ড নামে একখানি সাপ্তাহিক পত্রে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্রের
প্রথম উপন্যাস ইংরেজীতে লেখা Rajmohans Wife) (২) 'কপালকুন্ডলা' (১৮৬৬), (৩) 'মৃণালিনী'
(১৮৬৯), (৪) 'বিষবৃক্ষ' (১৮৭৩), (৫) 'ইন্দিরা' (১৮৭৩), (৬) 'যুগলাঙ্গুরীয়' (১৮৭৪),
(৫) 'চন্দ্রশেখর' ( ১৮৭৫), (৮) 'রজনী' (১৮৭৭) (৯) 'কৃষ্ণকান্তের উইল' (১৮৭৮), (১০)
'রাজসিংহ' (১৮৮২), (১১) 'আনন্দমঠ' (১৮৮৪), (১২) 'দেবীচৌধুরাণী' (১৮৮৪), (১৩) 'রাধারাণী'
(১৮৮৬), (১৪) 'সীতারাম' (১৮৮৭)। গুরুত্বপূর্ণ সরকারী কর্মে নিযুক্ত থেকেও মাত্র ২২
বছরের মধ্যে তিনি যে এতগুলি বিচিত্র শ্রেণীর উপন্যাস আমাদের উপহার দিয়েছেন এতেই তাঁর
প্রতিভার ব্যাপকতা বা বলিষ্ঠতা প্রমাণিত হয়েছে। এবার আমরা সংক্ষেপে তাঁর উপন্যাসগুলির
শ্রেণী ও গুণগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করতে পারি।
ইতিহাস, ও রোমান্সধর্মী উপন্যাস-এপর্বের অন্তর্গত উপন্যাসগুলি হল 'দুর্গেশনন্দিনী',
'কপালকুন্ডলা', 'মৃণালিনী', 'যুগলাঙ্গুরীয়', 'রাজসিংহ', 'চন্দ্রশেখর', ও 'সীতারাম'।
এরমধ্যে বিশুদ্ধ ইতিহাসও ঐতিহাসিক ঘটনা এবং চরিত্র নিয়ে লেখা রাজসিংহ'ই একমাত্র ঐতিহাসিক
উপন্যাস। বঙ্কিমচন্দ্র নিজেও তাই বলেছেন এবং সাহিত্য একটি বিচারের মাপকাঠিতেও তা নির্ধারিত
হয়। উপন্যাস এবং ইতিহাসকে পরস্পর সাপেক্ষ করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র এই উপন্যাসে। কিন্তু
ইতিহাসের মানুষ এখানে চিরন্তর পৃথিবীর মানুষ হয়ে দেখা দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এই উপন্যাসের
কাহিনির মধ্যে প্রচণ্ড গতির কথা বলেছেন। সমালোচকদের মতে রাজসিংহই বঙ্কিমের শ্রেষ্ঠ
উপন্যাস। ইতিহাসের চেয়ে নিত্য সচল মানবজীবনের নানান ঘাত প্রতিঘাতই উপন্যাসের প্রধান
অবলম্বন।
'দুর্গেশনন্দিনী', 'মৃণালিনী', 'চন্দ্রশেখর'
ও' সীতারামের' পটভূমিকাতেও ঐতিহাসিক কাহিনি ও চরিত্র আছে কিন্তু এখানে ইতিহাসের পটে
অনৈতিহাসিক মানুষের কথা বেশী প্রাধান্য পেয়েছে। 'দুর্গেশনন্দিনী'তে বিমলা-আয়েযা-তিলোত্তমা,
'কপালকুন্ডলা'য় কপালকুন্ডলা- মতিবিবি-নবকুমার; 'মৃণালিনী'তে হেমচন্দ্র-মৃণালিনী-পশুপতি,
মনোরমা: 'চন্দ্রশেখর'-এ চন্দ্রশেখর প্রতাপ শৈবলিনী; কাল্পনিক সেগুলি অধিকতর গুরুত্ব
লাভ করেছে। অথচ 'দুর্গেশনন্দিনী'তে বাংলার পাঠানমুঘলুের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, কপালকুন্ডলায়
মুঘল শাসনের জাহাঙ্গীর সমসায়মিক ঘটনা, ও 'সীতারাম'এ মুঘল আমলের শেষাংশ পটভূমিকা স্বরূপ
ব্যবহৃত হয়েছে। যুগলাঙ্গুরীয়তে হিন্দু আমলের আবহাওয়া থাকলেও এখানে সন তারিখযুক্ত কোন
ইতিহাসের প্রভাব নেই। বঙ্কিমচন্দ্র ইতিহাসের সঙ্গে রোমান্স ও কল্পনার খাদ মিশিয়ে যে
উপন্যাসগুলি রচনা করেছেন, সেগুলিকে বিশুদ্ধ ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা না গেলেও শিল্পবস্তু
হিসেবে তার দাম সব যুগেই স্বীকৃতি হবে। 'দূর্গেশনন্দিনী' বিমলার পরিণাম জগৎসিংহ তিলোত্তমা
আয়েসা কাহিনি ও চরিত্র সহজে ভুলা যায় না।
তত্ত্ব ও দেশাত্মবোধক উপন্যাস-'আনন্দমঠ' ও 'দেবীচৌধুরাণী' কে তত্ত্বপ্রধান উপন্যাস
বলা যেতে পারে। ড. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় 'আনন্দমঠ' উপন্যাসটিকে 'দেশাত্মবোধের
মহাকাব্য' বলেছেন। 'বন্দেমাতরম্' সঙ্গীতটি এই উপন্যাসের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। মুঘলযুগের
শেষ ও ইংরেজ আমলের প্রথমদিকে এর কাহিনির পট বিস্তৃত। কিন্তু বাইরে মুসলমান বিরোধিতা
থাকলেও আসলে ইংরেজ কুশাসনের বিরুদ্ধেই এই উপন্যাস রচিত হয়েছিল। সরকারি কর্মচারী বঙ্কিমচন্দ্র
সেকথা ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য গোপন রেখেছিলেন। কিন্তু কল্পনাকুশলী ও দূরদর্শী পাঠক
মাত্রেই এই উপন্যাসে আসল তাৎপর্য বুঝতে পারেবেন। যদিও এ উপন্যাসের মধ্যে শিল্প কলাগত
ত্রুটি রয়েছে এবং কাহিনীতেও সংযমের অভাব, সৃষ্ট চরিত্রের দিক থেকেও একমাত্র শান্তি
ও ভবানন্দ ছাড়া অন্য কোন চরিত্র সুপরিস্ফুট হয়নি।
'দেবী চৌধুরাণী'র কাহিনি বয়নে এ ধরনের দুর্বলতা
না থাকলেও চরিত্রসৃষ্টিতে বঙ্কিমচন্দ্র সফল হতে পারেননি। এই উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র
গীতাতত্ত্ব ও হিন্দুনারীর যথার্থ স্থান সম্পর্কে অনেক উপদেশ দিয়েছেন যা উপন্যাসের পক্ষে
অনেকটাই অবান্তর। যাহোক, শেষ জীবনে বঙ্কিমচন্দ্র নীতি আদর্শ ধর্ম ও সদাচার সম্বন্ধে
নিষ্ঠাবান হিন্দুর দিক্ থেকে যা ভাবছিলেন তার কিছুগাঢ় প্রভাব এযুগের উপন্যাসে পড়েছে।
সমাজ ও গার্হস্থ্যধর্মী উপন্যাস: বাঙালির পারিবারিক সামাজিক গার্হস্থ্য সমস্যাসংকুল
উপন্যাসের জনক বঙ্কিমচন্দ্র। বর্তমানেও আধুনিক উপন্যাসদের গুরুস্থানীয় বঙ্কিমচন্দ্র।
বঙ্কিমচন্দ্রের কতগুলি উপন্যাসে সমস্যাবর্জিত বাঙালি পরিবারের মসৃণ ঘরোয়া কাহিনি বিবৃত
হয়েছে। এতে কোন অদ্ভুত কাহিনি বিন্যাস নেই। চরিত্রের গূঢ় মনস্তত্ত্বও উপস্থিত নেই।
কিন্তু একটি প্রসন্ন সহজ সরল ও সরস আখ্যান সহজেই পাঠকের প্রীতি আকর্ষণ করতে পারে। যেমন
ইন্দিরা ও রাধারাণী আকারে এদুটি উপন্যাস 'অনেকটা বড় গল্পের মতোই একে ইংরাজীতে
Novelette অর্থাৎ ছোট মাপের নোভেল বলা হয়। নানা বিপত্তির মধ্যে 'ইন্দিরা'র সঙ্গে স্বামীর
মিলন প্রথমাখ্যানে এবং রাধারাণী নামে একটি বালিকার বাল্যপ্রেমের সফলতা দ্বিতীয়ত আখ্যানে
বর্ণিত হয়েছে। চরিত্রদ্বন্দ্ব এবং অন্যান্য ঐতিহাসিক লক্ষণ এতে না থাকলেও সুখপাঠ্য
বড়গল্প হিসেবে এর জনপ্রিয়তা রয়েছে।
এবার আমরা বঙ্কিমের এমন কয়েকটি উপন্যাসের কথা
বলব যেখানে তাঁর প্রতিভার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। অবশ্য একথাও ঠিক এ উপন্যাসগুলির
ক্ষেত্রে তিনি পাঠক সমাজের কাছে নিন্দা ও প্রশংসার ভাগী হয়েছিলেন। আমরা বলতে চাইছি
'বিষবৃক্ষ', 'কৃষ্ণকান্তের উইল' ও 'রজনী'র কথা যেখানে নরনারীর আদিম সম্পর্কের জটিলতাই
উপন্যাসগুলির মূলকথা। চিত্তসংযমে অনিচ্ছা বা অক্ষমতা থেকে স্ত্রী-পুরুষের শোচনীয় পরিণাম
বর্ণনার জন্যই বঙ্কিমচন্দ্র সেই সময়কার পারিবারিক জীবনের ওপর ভিত্তি করে এই তিনখানি
উপন্যাসের পরিকল্পনা করেছিলেন। নগেন্দ্রনাথ আত্মসংযমে অসমর্থ হয়ে নিষিদ্ধ কামনার যে
বীজ বপন করেছিলেন, তাই একদিন বিষবৃক্ষ হয়ে তার বিষাক্ত নিঃশ্বাসে কুন্দকে গ্রাস করেছিল।
উপন্যাসের সমাপ্তিতে লেখক বলেছেন যে, 'এই বিষবৃক্ষ থেকে ঘরে ঘরে অমৃত ফলে উঠুক।' আমাদের
বুঝতে অসুবিধা হয় না চরিত্রশুদ্ধি এ উপন্যাসে মূল লক্ষ। ঘটনার গতি ও চরিত্রবিকাশও তারদিকে
অগ্রসর হয়েছে। 'কৃষ্ণকান্তের উইল' উপন্যাসেও পুরুষের আত্মসংযমে অনিচ্ছা স্ত্রী ত্যাগ
করে অন্য স্ত্রীলোক নিয়ে মত্ত হওয়া ও তার শোচনীয় পরিণাম ব্যক্ত হয়েছে। 'রজনী' উপন্যাসে
বঙ্কিমচন্দ্র ইংরেজ ঔপন্যাসিক লিটন রচিত 'The Last days of Pompei উপন্যাসে অন্ধ ফুলওয়ালী
নিদিয়ার চরিত্রের আংশিক প্রভাবে বঙ্কিমচন্দ্র জন্মান্ধ রজনী চরিত্র অংকন করেছেন। নানা
জটিল ও রহস্যময় ঘটনার মধ্য দিয়ে নায়ক সচীশ ও অন্ধ রজনীর বিবাহ এবং এরপরে কোন মহাপুরুষের
কৃপায় তার দৃষ্টিশক্তি লাভ, এই হল উপন্যাসে মূল আখ্যান।
সবশেষে আমরা একথা বলতে পারি যে, রবীন্দ্রনাথ
ও শরৎচন্দ্রের কথা মনে রেখেও একথা বললে বোধ করি অত্যুক্তি হবে না বঙ্কিমচন্দ্রই বাংলা
সাহিত্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক। বিষয়বৈচিত্র্যে রচনা প্রকরণে, ঔপন্যাসিকের জীবনদর্শনে
তিনি এখনও অতুলনীয়। রবীন্দ্রনাথ কোন কোন ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রকে পাশ কাটিয়ে অগ্রসর
হয়েছেন আবার শরৎচন্দ্র সে পথকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে বিপরীত পথে যাত্রা করেছেন। কিন্তু
একথা ঠিক তাঁকে এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। বঙ্কিমচন্দ্রের পর এক শতাব্দী পার হয়ে গেছে কথা
সাহিত্যের অনেক বৈচিত্র্য, কলাকৌশল রক্ষা করছি কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র যে বিশাল হিমালয়ের
মতো বাংলা উপন্যাসের শীর্ষদেশে দাঁড়িয়ে আছেন তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই।
কোন মন্তব্য নেই
ok