Translate

বাংলা গদ্যের বিকাশে রামমোহন রায় : ড. নীলোৎপল জানা

রামমোহন রায়

বাংলা গদ্যের বিকাশে রামমোহন রায়

        বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাসে রামমোহন রায়ের বিশেষ অবদান অনস্বীকার্য। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতামত অনুযায়ী বলা যায়, বাঙালি জাতিকে তিনি মধ্যযুগের গুটি কেটে আধুনিক আকাশে উড়তে শিখিয়েছিলেন। ১৭৭৪ মতান্তরে ১৭৭২ সালে হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামের এক সম্পন্ন ব্রাহ্মণ ঘরে রামমোহনের জন্ম। রামমোহন রায়ের প্রপিতামহ কৃষ্ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মুর্শিদাবাদের নবাবের অধীনে চাকুরিরত ছিলেন। বাংলার রাজ সরকারের চাকরি করেই তিনি রায় উপাধি পেয়েছিলেন। একেশ্বরবাদের প্রতিষ্ঠাতা রামমোহন রায়কে দিল্লির বাদশাহ দ্বিতীয় আকবর 'রাজা' উপাধি দিয়েছিলেন। বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাসে রামমোহন রায়ের অবদান অবিস্মরণীয়। বাংলার নবজাগরণের মাধ্যমে যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল তা প্রবলভাবে অনুভূত হয় উনিশ শতকে। এই সময়ে বাঙালিদের একটি গোষ্ঠী ইউরোপীয় সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতির সংস্পর্শে এসে বাংলার সার্বিক বিকাশে এগিয়ে গিয়েছিল। তাঁরা ভারতের অতীত ইতিহাসকে পুনরুদ্ধার করে প্রাচীন ভারতের স্বর্ণযুগকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। এই নবজাগরণের প্রাণপুরুষ ছিলেন রামমোহন রায়।

 

      ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের হাত ধরে বাংলা গদ্য চর্চা শুরু হলেও রামমোহনের হাতে তা এক দৃঢ় ভিত্তি পায়। তিনি সর্বপ্রথম বাংলা গদ্যকে সুশৃঙ্খল রূপ দেওয়ার প্রয়াস চালিয়েছিলেন। বাংলা গদ্যের সাধু চলিত নিয়ে তিনি পরীক্ষা চালান। সে যুগের বাংলা গদ্য ছিল সংস্কৃত শব্দবহুল। এটি সাধারণ লোকের পক্ষে বোধগম্য হতো না, রামমোহন এর বিরোধী ছিলেন। তিনি তাঁর রচনা সাধারণ লোকের বোধগম্য করতে চেয়েছিলেন। যদিও রামমোহনের রচনা ছিল সংস্কৃত শব্দবহুল ও আড়ষ্ট। তাতে সাহিত্য রসও ছিল না। কিন্তু তিনি তাঁর গদ্যে যুক্তি, তর্ক, চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়ে তাকে আধুনিক চিন্তাশীল মননের উপযোগী করে তুলেছিলেন। আর তাই আধুনিক যুগের এক বিশিষ্ট বাংলা গদ্য লেখক হিসেবে তাঁর কৃতিত্বকে অস্বীকার করা যায় না। সংস্কৃত, ফারসি, ইংরেজি জানা সেকালের শিক্ষিতদের অগ্রণী ছিলেন রামমোহন রায়।

      রামমোহন রায় ধর্ম সংস্কার করতে গিয়ে বাংলা গদ্যচর্চায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। একেশ্বরবাদের সমর্থন স্বরূপ তিনি বেদান্ত ও উপনিষদ বাংলায় অনুবাদ করেন। রচনাগুলি হল

'বেদান্ত গ্রন্থ' (১৮১৫),

'বেদান্ত সার' (১৮১৫),

'কেনোপনিষদ' (১৮১৬),

'ঈশোপনিষদ' (১৮১৬),

'কঠোপনিষদ' (১৮১৭) ইত্যাদি।

     এই অনুবাদমূলক গ্রন্থগুলি বাংলায় শিক্ষিত সাধারণের জন্য লিখিত বাংলা গদ্য পুস্তক হলেও পুস্তিকাগুলি রচনার জন্য সেসময় সমাজের রক্ষণশীল ব্যক্তিরা রামমোহনের বিরোধিতা করতে থাকেন। বিরোধীদের প্রতিবাদ ছিল অত্যন্ত কটূক্তিপূর্ণ ও মানহানিকর। এসময় রামমোহনের বিপক্ষে সবচেয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার। রামমোহনের বেদান্ত ব্যাখ্যার নিন্দে করে মৃত্যুঞ্জয় লিখেছিলেন 'বেদান্তচন্দ্রিকা'।

     রামমোহনের প্রতিপক্ষরা যুক্তি অপেক্ষা শাস্ত্রেরই দোহাই দিতেন। যুক্তিবাদী হলেও এরকম প্রতিপক্ষের সঙ্গে বিচারে রামমোহন শাস্ত্রীয় যুক্তিকে নিজের অস্ত্র রূপে গ্রহণ করেছিলেন। মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের 'বেদান্তচন্দ্রিকা'-র উত্তরে তিনি লেখেন ৬৪ পৃষ্ঠার বই 'ভট্টাচার্যের সহিত বিচার' (১৮১৭) এছাড়াও রামমোহনের বিরুদ্ধে এসেছিলেন সেকালের রাজবাড়ির গোস্বামীরা। তাদের জবাবে তিনি লেখেন 'গোস্বামীর সহিত বিচার' (১৮১৮)। এরপর তিনি লেখেন 'কবিতাকারের সহিত বিচার' এবং শেষে লেখেন 'পথ্য প্রদান' (১৮২৩)। যেখানে তিনি কাশীনাথ তর্কপঞ্চাননের 'পাষণ্ড পীড়ন' এর প্রত্যুত্তর দেন। এছাড়াও রামমোহন ইংরেজিতে বাংলা ব্যাকরণ লেখেন ১৮২৬ সালে; বইটি লেখক কর্তৃক 'গৌড়ীয় ব্যাকরণ' (১৮৩৩) নামে বাংলা ভাষান্তরিত হয়। বাঙালি রচিত এই প্রথম বাংলা ব্যাকরণ আমরা পেলাম, যেখানে পাই রামমোহনের যুক্তিনিষ্ঠ মনের ও ভাষাবোধের পরিচয়। রামমোহন সেকালের সংবাদ পরিচালনায়ও অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁর পরিচালনায় দু-দুটি বাংলা সংবাদ-সাময়িক পত্র 'ব্রাহ্মণ সেবধি' (১৮২১) এবং 'সম্বাদ কৌমুদী' (১৮২১) প্রকাশিত হয়েছিল। এই সংবাদপত্র প্রকাশ সেকালের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ছিল। সতীদাহ প্রথা নিবারণ এর জন্য তিনি বাংলায় তিনটি ও ইংরেজিতে চারটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। বাংলা গ্রন্থগুলি হল 'সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক ও নিবর্তক সম্বাদ' (১৮১৮), 'প্রবর্তক ও নিবর্তকের দ্বিতীয় সম্বাদ' (১৮১৯) এবং 'সহমরণ বিষয়' (১৮২৯)'সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ' ছিল তাঁর সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে রচিত প্রথম গ্রন্থ। সতীদাহ অশাস্ত্রীয় ও নীতি বিগর্হিত প্রমাণ করার জন্যই তিনি এই পুস্তক রচনা করেছিলেন। এই গ্রন্থে রামমোহন দুটি কল্পিত প্রতিপক্ষ খাড়া করে সতীদাহ প্রথার পক্ষপাতী ও এর বিরোধী মতবাদ প্রকাশ করেছিলেন। এই পুস্তকটির মধ্যে দিয়ে রামমোহন প্রবর্তকের মাধ্যমে সমাজের রক্ষণশীল গোড়া হিন্দুদের পরাজিত করেছিলেন।

রামমোহনের গদ্যরীতির বৈশিষ্ট্যগুলিকে আমরা নিম্নোক্তভাবে সাজিয়ে নিতে পারি-

    ১) রামমোহনের প্রধান কৃতিত্ব তিনি বাংলা ভাষায় গদ্যরীতিকে নিয়ন্ত্রিত করে প্রথম বেদ বেদান্তচর্চার পথ উদ্ভাবন করেন।

    ২) শাস্ত্রীয় বিচারের আলোচনা থেকে যখনই তিনি সমাজিক প্রসঙ্গে এসেছেন তখনই তাঁর ভাষা সরল ও স্বাভাবিক হয়েছে। যেমন- “ স্ত্রীলোকের বুদ্ধির পরীক্ষা কোনকালে লইয়েছেন যে অনায়াসেই উহাদিগকে অল্পবুদ্ধি কহেন? কারণ বিদ্যাশিক্ষা, জ্ঞানশিক্ষা দিলে পরে ব্যক্তি যদি অনুভব ও গ্রহণ করিতে না পারে তখন তাহাকে অল্পবুদ্ধি কহা সম্ভব হয়। আপনারা বিদ্যাশিক্ষা জ্ঞানোপদেশ স্ত্রীলোককে প্রায় দেন নাই তবে তাহারা বুদ্ধিহীন হয় ইহা কি রূপে নিশ্চয় করেন। ” [প্রবর্তক নিবর্তক সংবাদ]

   ৩) দার্শনিক তত্ত্বকেও সহজ ভাষারূপের মাধ্যমে অভিজ্ঞতার উত্তাপে সজীব করে ফেলেছেন।

   ৪) ইংরাজী বাক্যরীতির প্রভাব তার গদ্যভাষার বহুস্থানে দেখা যায়।

   ৫) তিনি লেখেন বক্তব্যকে সরল ও সরস করার জন্য, শব্দ বা বাক্যের খেলা দেখাবার ইচ্ছায় নয়।

   ৬) তার ভাষা প্রায়শই সরল। সময়ে সময়ে প্রাণজ্জ্বল। তার চরিত্রে নির্ভীকতা ও বলিষ্ঠতার

কোন ত্রুটি থাকলেও তার গদ্যভাষার দুটি প্রধান গুণ ছিল-ঋজুতা ও স্পষ্টতা।

   ৭) গদ্য শিল্পী হিসেবে তিনি ছিলেন নিরপেক্ষ। বিপক্ষের উত্তর দিতে গিয়ে কটুক্তি করেন নি।

   ৮) শাস্ত্রীয় ও যুক্তিকে প্রধান অস্ত্ররূপে গ্রহণ, উপনিষদ চর্চাই ছিল তার জীবনের প্রধান লক্ষ্য তর্ক প্রধান, মনন প্রধান।

     প্রথম জীবনে ঘোরতর ইংরেজদ্বেষী রামমোহন কিশোর বয়সে দেশের সনাতন শিক্ষার ধারা অনুসরণ করে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। আর যে যুগে রামমোহন তাঁর লেখনী ধারণ করেছিলেন সে যুগকে পাশ্চাত্য প্রভাবিত আধুনিক বাংলা গদ্যের অনুকরণ ও প্রতিক্রিয়ার যুগ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সময় এক শ্রেণি পাশ্চাত্য অনুকরণের মোহে নিজেদের ভাসিয়ে দিয়েছে, আর অন্য শ্রেণি দাঁড়িয়েছে অন্ধ অনুকরণের বিরুদ্ধে। রামমোহন রায় এই দুই মনোভঙ্গির মধ্যে সমন্বয় সাধনে যত্ন নিয়েছিলেন। এখানেই তাঁর স্বাতন্ত্র্য। পাশাপাশি যুগের সংকীর্ণ গোঁড়ামি ও অন্যদিকে তাঁর নিজের চিন্তাধারার স্বাধীন প্রকাশ ঘটিয়ে রামমোহন রায় অগ্রগামী পুরুষ হিসেবে ইতিহাসে বিশেষ স্থান অধিকার করে নিয়েছিলেন। তথাকথিত সাহিত্যিক তিনি ছিলেন না, তবু বাংলা গদ্যের বিকাশে তাঁর অবদান কোনোভাবে ভোলার নয়। রামমোহনের এই অবদানকে স্বীকৃতি জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ যথার্থ মন্তব্য করেছেন, রামমোহন বঙ্গসাহিত্যকে গ্রানিট-স্তরের উপর স্থাপন করেছিলেন।

====================
যারা পেজটি ফলো করছেন বা দেখছেন অবশ্যই নাম দিয়ে কমেন্ট লিখুন।

কোন মন্তব্য নেই

ok

4x6 থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.