বাংলা গদ্য-সাহিত্যে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখকগোষ্ঠীর অবদান ।। ড. নীলোৎপল জানা
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ |
বাংলা গদ্য-সাহিত্যে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখকগোষ্ঠীর অবদান
পদ্যের সমুদ্র মন্থন করে বাংলা সাহিত্যের মাটিতে গদ্যবৃক্ষের বীজ রোপিত হয় ঊনবিংশ শতকের ঊষালগ্নে। পাশ্চাত্য সভ্যতার অগ্রদূত ইংরেজের সান্নিধ্যে বাঙালি জীবনে জ্ঞানালোকের নবীন শাখা পুষ্পায়িত হয় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজকে কেন্দ্র করে। বাংলার সাহিত্যাকাশে ছড়িয়ে পড়ে তারই সৌরভ। একারণে বাংলা গদ্যসাহিত্যে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ ও তার লেখকগোষ্ঠীর অবদান বিশেষ স্মরণীয়।
১৮০০ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা মে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। উদ্দেশ বিদেশী সিভিলিয়ানদের এদেশীয় কর্মক্ষেত্রের উপযোগী ভাষা ও সাহিত্যে শিক্ষাদান। পুস্তকের অভাব পূরণে চলল সৃষ্টির যত্নশীল প্রয়াস। বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার অধক্ষ্য উইলিয়াম কেরী ও অন্যান্য কয়েকজন অধ্যাপকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে বাংলা গদ্য লাভ করল অনিবার্যগতি। বাংলা গদ্য সাহিত্যে যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী।
ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে
শিক্ষা ব্যবস্থা চালু ছিল ১৮৫৪ সাল পর্যন্ত। কিন্তু ১৮১৫ সাল পর্যন্ত ছিল এর প্রকৃত
ঐশ্বর্য পর্ব। এই সময় কেরীর নেতৃত্বে ও উদ্দীপনায় পণ্ডিতমুন্সীরা প্রতিভার বিকাশে অগ্রসর
হয়েছিলেন। এদের মূল কাজ ছিল পাঠ্যপুস্তক রচনা। কিন্তু কেরী ক্রমে বাংলা ভাষাকে
কালজয়ী ভাষায় রূপদানে সচেষ্ট হন। কেরীর পরিকল্পনার প্রধান সহকারী ছিলেন রামরাম
বসু ও মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার।
এদের রচনাগুলি বাংলা গদ্য
সাহিত্যের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। রচনাগুলি হল -
১) উইলিয়াম
কেরী রচিত গ্রন্থ--
ক/ A Grammar of the Bengali language-১৮০১
খ/ কথোপকথন -
১৮০১
গ/ ইতিহাসমালা -
১৮১২
A dictionary of the Bengali language - ১৮১৫-২৫,
২) রামরাম বসু রচিত গ্রন্থ—
ক/রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র - ১৮০১
খ/লিপিমালা -
১৮০২
৩) মৃত্যুঞ্জয়
বিদ্যালঙ্কার রচিত গ্রন্থর
ক/বত্রিশ
সিংহাসন- ১৮০২
খ/হিতোপদেশ
-১৮০৮
গ/রাজাবলি ১৮০৮
ঘ/
বেদান্তচন্দ্রিকা - ১৮১৭ প্র
ঙ/প্রবোধচন্দ্রিকা - ১৮৩৩
এছাড়া অপ্রধান কয়েকজনের রচনা
হল—
গোলকনাথ শর্মা - হিতোপদেশ - ১৮০২
তারিণীচরণ মিত্র-ওরিয়েন্টাল
ফেবুলিষ্ট-১৮০৩
চণ্ডীচরণ মুন্সী-- তোতা ইতিহাস
- ১৮০৫
রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়-'মহারাজা
কৃষ্ণচন্দ্ররায়স্য চরিত্রং-
১৮০৫
রামকিশোর তর্কচূড়ামনি-- হিতোপদেশ-
১৮০৮
হরপ্রসাদ রায় --পুরুষপরীক্ষা-১৮১৫.
সাহিত্য মূল্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রধান তিনজন লেখকের অবদান নিয়ে আমরা আলোচনার প্রয়াস
রাখতে পারি।
১)উইলিয়াম কেরী
উইলিয়াম কেরী বাংলা
বিভাগের কর্ণধার। কলেজের লেখকগোষ্ঠীর
নিয়ামক ও পরিচালক " রামরাম বসুর কাছে কেরীর বাংলা
শিক্ষার হাতে খড়ি হয়। বাইবেল অনুবাদ প্রসঙ্গে বাংলা
ভাষার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়। বহুভাষাবিদ কেরী বাংলা ভাষাকে অধিক শ্রদ্ধা করতেন। বাংলা গদ্যের শৃঙ্খলা বিন্যাসের চেষ্টা, পাঠ্য পুস্তকের
বিষয়বস্তু নির্বাচন, বাংলা ভাষাকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর
প্রতিষ্ঠা দানের আন্তরিক প্রচেষ্টা তার প্রমাণ দেয়। তাঁর
কথোপকথন' ও ইতিহাসমালা 'গ্রন্থে
সাধু ও চলিত ভাষার ব্যবহার প্রশংসাতীত।
'কথোপকথন' কেরীর স্মরনীয় রচনা। গ্রন্থটি ১১টি অধ্যায়ে সমাপ্ত।
বইটি কেরীর বাস্তববুদ্ধি ও
যুক্তিবাদী মনের অভ্রান্ত স্বাক্ষর। তাই আইডিয়ার আকাশ অপেক্ষা মাটির পৃথিবীর
মানুষের পরিচয় বড় হয়ে উঠেছে।
ইতিহাসমালা' দেশী ও বিদেশী ভাষা থেকে সংগৃহীত প্রায় ১৫টি গল্পের সমাহার গ্রন্থটি
কেরীর মৌলিক রচনা নয়, সম্পাদনামাত্র। গ্রন্থের
আখ্যাপত্রে লেখা আছে -A Collection of stories in the Bengalee Language " গ্রন্থটি পূর্বোক্ত রচনার চেয়ে নিঃসন্দেহে পরিণত রচনা। গ্রন্থের বাকরীতি এবং
ভাষা সুগঠিত, পরিণত কল্পনাশক্তির পরিচয়বহ।
রামরাম
বসু
রামরাম বসু ছিলেন বিচিত্র
চরিত্রের মানুষ, তাঁর ‘রাজা প্রতাপাদিত্য’ চরিত্র বাঙালি রচিত প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ। গ্রন্থটির সাহিত্যশ্রী তেমন উন্নত নয়।
গ্রন্থের মধ্যে সংস্কৃত, আরবী, ফারসী
শব্দের অতিব্যবহার, পদের অন্বয়গত ত্রুটি লক্ষ করা যায়।
রামরামের পরবর্তী রচনা ‘লিপিমালা’য় ভাষা শৈলী
অনেক সংযত। গ্রন্থটিতে পত্রাকারে রাজা পরীক্ষিতের কথা, দক্ষযজ্ঞের
কথা, চৈতন্যের বিবরণ প্রভৃতি নানাকাহিনি বিবৃত হয়েছে। তাঁর সাহিত্যে প্রতিভার তখন ছাপ পড়েনি। কিন্তু বাংলা
গদ্যের বিবর্তনে তাঁর রচনার অবদান অবশ্য স্বীকার্য
মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার
ফোট উইলিয়ম কলেজের লেখকগোষ্ঠীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভাধর ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার তাঁর প্রথম গ্রন্থ 'বত্রিশ
সিংহাসন’ সংস্কৃত 'দ্বাত্রিংশৎপুত্তলিকা ’কাহিনির অনুবাদ, গ্রন্থটিতে চলিত ভাষার তুলনায় সংস্কৃত ভাষার দৃষ্টান্ত বেশী 'হিতোপদেশ 'সংস্কৃত গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ হলেও
মৃত্যুঞ্জয়ের মৌলিকত্ব প্রকাশ পেয়েছে। ‘রাজাবলি'- কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কাল থেকে
ভারতবর্ষে ইংরেজ অধিকার পর্যন্ত রাজা ও সম্রাটদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস গ্রন্থটি কলহন
বিরচিত ‘রাজতরঙ্গিনী’র ভাবাদর্শে
রচিত।
মৃত্যুঞ্জয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ
রচনা প্রবোধচন্দ্রিকা' গ্রন্থটি চারটি স্তবক ও বহু সংখ্যক
কুসুম 'এ বিভক্ত। এতে রয়েছে অলংকার, ব্যাকরণ, ধ্বনি,
লিপিতত্ত্ব, তর্কশাস্ত্র, জোর্তিবিজ্ঞান,
রাজনীতি, আইন প্রভৃতি নানাবিষয়ের
যুক্তিপূর্ণ আলোচনা। গ্রন্থটি লেখকের মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়।
ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের অন্যান লেখকের বিভিন্ন রচনাগুলির অধিকাংশই ছিল অনুবাদমূলক নানা গল্পকথা। রচনাগুলি তেমন ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু বাংলা গদ্যের বিকাশে সেগুলি বিশেষভাবে স্মরনীয়। কলেজের গোধূলি লগ্নে বিদ্যাসাগরের আবির্ভাবকে ঠিক এই পর্যায়ে ফেলা যায় না। তিনি মৃত্যুদয়ের সার্থক উত্তরসুরী,
ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনায়
ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ পরীক্ষা নিরীক্ষার পীঠস্থানে পরিণত হয়েছিল। তা সম্ভব হয়েছিল কয়েকজন
বিদ্যোৎশাহী লেখক ও কেরীর একান্ত সৃষ্টিশীল প্রচেষ্টায় লেখকগোষ্ঠীর হাতে বাংলা গদ্যের যে
ক্ষীন জলধারার উৎসমুখ খুলে গিয়েছিল আজ তো মহাগঙ্গায়
পরিণত হয়েছে। বর্তমান সাহিত্যসাগরের প্রতিটি জলকণা তারই প্রকাশ।
কোন মন্তব্য নেই
ok