বাংলা গদ্যে বিদ্যাসাগরের অবদান : ড. নীলোৎপল জানা
বাংলা গদ্যে বিদ্যাসাগরের অবদান
বাংলা গদ্যের ধারাবাহিক ইতিহাসের সূচনা ঊনবিংশ
শতাব্দীর প্রথম থেকেই। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখকদের মধ্যে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার
ভাল গদ্য লিখলেও তাঁর রচনা পাঠ্য পুস্তকের গণ্ডীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। রামমোহন বাংলা
গদ্যের দুর্বদ্ধতা, ছেদ চিহ্নের একান্ত বিরলতা ইত্যাদি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তাঁর
গদ্য তাঁর বক্তব্য প্রকাশে সক্ষম ছিল। কিন্তু সারস্বত প্রকাশ বলতে যা বোঝায় তা তাঁর
গদ্যে ছিল না।
রামমোহন
বাংলা গদ্যকে পরিণতির যে স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন, ঈশ্বরচন্দ্র তার মধ্যে শৃঙ্খলা, পরিমিতিবোধ
ও অবিচ্ছিন্ন ধ্বনি প্রবাহ সঞ্চার করে তাকে পরিণতির এক উচ্চতর পর্যায়ে স্থাপন করলেন।
একথা ঠিক তাঁর হাতেই গদ্য ভাষা কৈশোরের অনিশ্চয়তা ও অস্থির গতি ছাড়িয়ে পূর্ণ সাহিত্যিক
রূপের স্থিরতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সংস্কৃত সাহিত্যের প্রসঙ্গে আশৈশব সুনিবীড় পরিচয়
এবং সহজাত শিল্পবোধ নিয়ে বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের আসরে অবতীর্ণ হলেন। একদিকে সংস্কার
আর এক দিকে সৃষ্টি, যুগপৎ বিদ্যাসাগরের লেখনী এগিয়ে চলল। বিদ্যাসাগর ও সব্যসাচী। ড.
সুকুমার সেন মন্তব্য করেছেন-
"বিদ্যাসাগরের বই প্রায়
সবই পাঠ্যপুস্তক জাতীয়।"
কিন্তু পাঠ্য
পুস্তকের বাইরেও বিদ্যাসাগরের আর একটি পরিচয় আছে। তাঁর প্রথম পুস্তক 'বাসুদেব চরিত'
সম্বন্ধে নানা সংশয় ও সমস্যা রয়েছে। সম্ভবত গ্রন্থটি পুরোপুরি নিজের রচনা নয়। 'বেতাল
পঞ্চবিংশতি' (১৮৪৭) গ্রন্থটি পাঠ্য পুস্তক হিসেবেই রচিত। এর পরে লেখা গ্রন্থগুলি অধিক
উল্লেখের দাবী রাখে। এগুলির অধিকাংশই অনুবাদ।
'শকুন্তলা'
(১৮৫৪) কালিদাসের 'অভিজ্ঞান শকুন্তলম্'; 'সীতার বনবাস' (১৮৬০), বাশ্মিকী রামায়ণের উত্তর
কাণ্ড এবং ভবভূতির 'উত্তর চরিত', 'ভ্রান্তিবিলাস' (১৮৬৯), শেক্সপীয়ারের Comedy of
Errors, 'বাঙলার ইতিহাস' (১৮৪৮), মার্শম্যানের 'History of Bengal', জীবন চরিত' (১৮৪৯),
'বোধদয়' (১৮৫৯), চেম্বার্সের 'Biographies ও Rudiments of knowledge' এবং 'কথামালা'
(১৮৫৬) ঈশপের ফেবলস্ অবলম্বনে রচিত। কিন্তু অনুবাদ হলেও বিদ্যাসাগর স্বীয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। শকুন্তলা' বিদ্যাসাগরের
রচনার যশকে অনেক উদ্বেলিত করেছিল।
'শকুন্তলা',
'সীতার বনবাস'-এর ভাষা যেমন লালিত্যপূর্ণ তেমনি শিল্পশ্রীমণ্ডিত।
"এই সেই জন স্থান মধ্যবর্তী প্রস্রবণ
গিরি, এই গিরির শিখর দেশ আকাশ পথে সতত সঞ্চরমান জলধর মণ্ডলী যোগে নিরস্তর নিবিড় নিলীমায় অলংকৃত।"
বিদ্যাসাগর মৌলিক রচনাগুলিকে পৃথক করে দেখিয়েছেন
ড. অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়। এই শ্রেণিতে তিনি যে গ্রন্থগুলি স্থান দিয়েছেন সেগুলি হচ্ছে-
ক) সংস্কৃত
ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য শাস্ত্র বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৩)।
খ) বিধবা
বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৫ প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড)।
গ) বহু বিবাহ
রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার (১৮৭১, ৭৩)।
ঘ) বিদ্যসাগর
চরিত (১৮৯১)।
৫) প্রভাবতী
সম্ভাষণ (১৮৬৩ সম্ভবত)।
প্রথম তিনটি
গ্রন্থে বিদ্যাসাগর মনন প্রধান গদ্যরীতি অবলম্বন করেছেন। তীক্ষ্ণ তর্কের জটিল জাল,
বিচার বিশ্লেষণ এখানকার প্রধান কথা। ভাষা ও তথ্যভিত্তিক। কিন্তু পরের গ্রন্থ দুটিতে
তাঁর রসিক মনের পরিচয় পাওয়া যায়। বিদ্যাসাগরের কলম কিভাবে কথার ফুল ফোটাতে পারে, তার
পরিচয় এখানে লক্ষ করা যায়। ভঙ্গি এখানে বিশ্লেষণের উপলবন্ধুর পথ পরিত্যাগ করেছে।
মন খুলে এখানে বিদ্যাসাগর কথা বলেছেন। রচনা রীতিতে
সেই প্রসন্ন মেজাজ মুদ্রিত। সাধু গদ্যের ছাদটি বেঁধে দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। তাই তিনি
বাংলা সাহিত্য স্মরণীয় গদ্য
শিল্পী।
ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন যে বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যকে-
"পূর্ণ
যৌবনের গার্হস্থ্যাশ্রমে প্রতিষ্ঠিত করিয়া জীবনের বিচিত্র কর্তব্য পালনের উপযোগী দীক্ষায়
অভিষিক্তকরিয়াছেন।" (বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা, পৃষ্ঠা-১৯)
রবীন্দ্রনাথের
মতে-
"বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্য ভাষার উচ্ছৃঙ্খল
জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুপরিচ্ছন্ন এবং সুসংযত করিয়া তাহাকে সহজ গতি এবং কর্মকুশলতা
দান করিয়াছেন......"
সমাজ সংস্কারক
বিদ্যাসাগর ভাষা সংস্কারেও কম কৃতিত্ব দেখান নি। তাঁর গদ্য রীতির বৈশিষ্ট্য কয়েকটি
উল্লেখ করতে পারি।
১. বাংলা
বাক্যগুলিকে বাক্যাংশে বিভাগ।
২. শ্বাস
পর্বানুসারে বাক্যাংশের ব্যবহার।
৩. বাক্যাংশগুলির
পরস্পর সম্পর্ক নির্ণয় ও অর্থসাপেক্ষে ব্যবহার।
৪. ছেদ ও
যতির ব্যবহার সম্বন্ধে সচেতনতা।
৫. সংস্কৃত
শব্দ ও ক্রিয়াপদ গ্রহণ; কথোপকথনে কথ্যরীতির সঙ্গে সাধু রীতির সুষম সমন্বয়।
৬. অর্থানুসারে
কমা, ড্যাস, সেমিকোলন প্রভৃতির ব্যবহার।
৭. অধীন
বাক্যের সংখ্যা হ্রাস।
৮. দীর্ঘ
সমাসের ব্যবহার কমিয়ে ফেলা।
বিদ্যাসাগরের শক্তিশালী গদ্য আধুনিক যুগ পর্যন্ত
প্রভাবশীল। ড. সুকুমার সেন অনুপ্রাস রচনার সুবাদে বিদ্যাসাগরকে 'দ্বিতীয়' শ্রেণির শিল্পী
হিসেবে বাংলাদেশে 'অদ্বিতীয়' বলেছেন। বক্তব্যকে কেবল প্রকাশ করা নয় সুন্দররূপে প্রকাশ
করা প্রকৃত লেখকের কাছে কলা লক্ষ্মীর এটাই দাবী। আর বিদ্যাসাগর এ দাবী পূরণ করেছিলেন
বলেই তিনি শিল্পী পূর্ববর্তীদের মতো লেখক মাত্র নন।
কোন মন্তব্য নেই
ok