Translate

বিদ্যাসাগরকে শ্রদ্ধাঞ্জলি :ড. নীলোৎপল জানা

বিদ্যাসাগরের প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি

 ড.নীলোৎপল জানা

     দ্বি-শত জন্মবর্ষে বিদ্যাসাগর নিয়ে এত পণ্ডিত, মনীষী, বিদ্বজ্জন আলোচনা ও লেখালেখি করছেন;সেখানে আমার মতো সাধারণের কী বা বলার থাকতে পারে। তবু আমার মনে হয় যেহেতু বিদ্যাসাগর বাঙালি ও বর্তমান সময়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এবং কুসংস্কারাগ্রস্ত বাঙালি তথা সমাজের সংস্কারক, সে হেতু আমার কিছু বলার আছে। আমরা সকলেই জানি তিনি বিদ্বান ,দানশীল,সমাজ সংস্কারক। কিন্তু এই বিষয়টি কী আমরা জানি, তাঁর এই মহৎ গুণগুলো কবে থেকে কীভাবে তা প্রকাশিত ? প্রদীপ জ্বালাবার আগে সলতে পাকানো যেমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ তেমনি বিদ্যাসাগরের মহিমান্বিত জীবনকে জানতে গেলে জীবনের শুরুটা জানা দরকার । সাগরের জলে কত লবণ আছে তা যেমন পরিমাপ করা শক্ত,তেমনি বিদ্যাসাগরের পরিমাপ করা আমার মতো সাধারণের  পক্ষে তা অসম্ভব ; তবুও কিছু বলতে চাই। পাঠকের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ ,আমার এই আলোচনা কাউকে জ্ঞান দানের জন্য নয় ;সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অভিপ্রায়।

     ঈশ্বরচন্দ্র বিশেষ প্রতিভার অধিকারী। প্রসঙ্গত,রবীন্দ্রনাথ যতদূর লেখাপড়া শিখেছিলেন অনেকেই সমাজে অনেক বেশি লেখাপড়া শিখেছেন কিন্তু কেউই তাঁর সমান হতে পারেননি। কারণ সকলের সমান প্রতিভা নয়। বিদ্যাসাগরের যেমন প্রতিভা ছিল তেমনি ছিল স্মৃতিশক্তি। এরই ফলে মাত্র নয় বছর বয়সে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন বিদ্যাসাগর ;যখন আমাদের বাড়ির ছেলেরা নয় বছর বয়সে তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে ।  আমরা আরো হতবাক হই ঐ সময়ে তাঁর কার্য-প্রণালী দেখে। সকালে স্নান সেরে বাজার করতে হতো। এর পর আনাজ কেটে রান্না করতে হত;তাও চার পাঁচজনের। সকলের খাওয়ার পর ঈশ্বর খেতো ও সকলের থালা এবং বাসন মেজে তারপর কলেজে যেতো । বর্তমান সময়ে অনেকে গল্প বলে মনে করবেন কিন্তু বাস্তবটা এমনই ছিল যে; কোনো কোনো দিন শুধু লবণ দিয়ে ভাত খেতে হতো বা মাছের ঝোল হলে মাছ একবেলা খেতো আর ঝোল একবেলা খেতো । এমতাবস্থায় ‘মুগ্ধবোধ’ শেষ করে পঞ্চদশ বর্ষে  সংস্কৃত কলেজে অলংকার শ্রেণিতে ভর্তি হন। খর্বাকৃতি বালককে দেখে অন্য ছাত্ররা উপহাস্য করলেও এক বৎসরের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে পারিতোষিক লাভ করে চমকে দিলেন সকলকে।

    ঈশ্বরের অধ্যাবসায়ের একটি নমুনা তুলে ধরা যাক। একদিন প্রসিদ্ধ দর্শণশাস্ত্রবিদ জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন মহাশয় মধুসূদন বাচস্পতির গৃহে এক ক্ষুদ্র বালকের হাতে সাহিত্য দর্পণ দেখে বাচস্পতি মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করলেন – ‘এই বালকটি কি সাহিত্য দর্পণ বুঝিতে পাারে ?’বাচস্পতি – ‘বুঝিতে পারে কি না…পরীক্ষা করিয়া দেখুন না ? দু- একটি প্রশ্নের উত্তর শুনে তর্কপঞ্চানন মহাশয় বলেছিলেন – “এ বালক নিশ্চয়ই অদ্বিতীয় পণ্ডিত হইবে।” ঐ সময়ে ঈশ্বর মাসিক আট টাকা বৃত্তি পেতেন । এরও আগে যখন পাঁচ টাকা বৃত্তি পেতেন তখন সমস্ত টাকাই পিতার হাতে তুলেদিতেন । সেই টাকা দিয়ে তাঁর পিতা কয়েক বিঘা জমি ও কিছু পুস্তক কিনেদেন। যখন থেকে ৮ টাকা করে পান তখন তাঁর পিতা সমান্য টাকা  নিয়ে  বাকিটা ঈশ্বরকে খেতে ও যেমন খুশি খরচ করতে বলতেন । সেই সময় থেকে ঈশ্বরচন্দ্র যে  কীরূপে ব্যয় করতেন তা শুনলে দয়ারসাগর বিদ্যাসাগর হয়ে ওঠার পরিচয় পাওয়া যাবে। তাঁর অন্তর ছিল দয়ার আধার । দয়াময় মধু দান করে তিনি যেমন তৃপ্তি পেতেন তেমনি অন্যকেও তৃপ্তি দিতেন । তিনি যখন দোকানে খেতে যেতেন তখন অভুক্ত ছাত্রদের ডেকে খাওয়াতেন। কারোর ছেঁড়া কাপড় দেখলে না কিনে দেওয়া পর্যন্ত শান্তি পেতেন না। এমনকী নিজের কাছে পয়সা না থাকলেও ধার করে মানুষের উপকার করতেন। এইসব দানের কথা শুনে তাঁর মাতার চোখে অশ্রু বর্ষিত হত। কলিকাতায় বন্ধুদের কারও যদি সংক্রামক রোগ হত তা শুনতে পেলে তৎক্ষণাৎ দৌড়ে যেতেন এবং সেবা করতেন। ঈশ্বরের খরচের বহর দেখে তাঁর বন্ধুরা ভাবতো ঈশ্বর বড় ধনী। কিন্তু তা  নয় ,ঈশ্বর ধনে বড় ছিলেন না ; মনে বড় ছিলেন। তাঁর অন্তরে যে মণি-মাণিক্য লুকানো ছিল তা অর্থ দিয়ে মূল্যায়ন সম্ভব নয় ।

      তিনি শুধু দয়া বা বিদ্যাবলে মানুষের হৃদয় জয় করেছিলেন তা নয়,আরো অনেক মহৎ গুণ ছিল। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বলেছেন -“যে মহত্ত্ব আপন গৌরব ও সৌরভ দিগন্তে ছড়াইয়া মানুষকে দেবত্ব বা অতিমানবত্ব দান করে,ঈশ্বরচন্দ্র তাহার অধিকারী ছিলেন। সেইজন্য চতুষ্পার্শ্বস্থ ক্ষুদ্রতার মধ্যস্থলে বিদ্যাসগরের মূর্তি ধবলগিরির ন্যায় শীর্ষ তুলিয়া দণ্ডায়মান থাকে; কাহারও সাধ্য নাই যে সেই উচ্চচূড়া অতিক্রম করে বা স্পর্শ করে।” একটি ঘটনার কথা বলা দরকার—একদিন পিতা ভায়েদের সঙ্গে খেতে বসে কয়েক গ্রাস খাওয়ার পর তিনি দেখলেন তরকারিতে একটা আরসুলা পড়েছে। তিনি ভাবলেন যদি ঘৃণাবশতঃ খাওয়া ত্যাগ করেন তবে সকলের খাওয়া পণ্ড হবে এবং উপবাসে কাটাতে হবে সকলকে। এই কথা ভেবে  মৃত আরসুলাযুক্ত ব্যঞ্জন ভক্ষণ করলেন। পরে যখন জানালেন সকলের বিস্ময়ের অন্ত থাকল না। এ থেকে বোঝা যায় ঈশ্বরের এমন এক শক্তি ছিল যা সাধরণের  স্তরে পড়ে না। 

    ঈশ্বরচন্দ্র একুশ বৎসর বয়সে কলেজের পাঠ শেষ করে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি লাভ করেন। সরস্বতীর কৃপা না থাকলে এত কম বয়সে বিদ্যার সাগর হওয়া যায় না। পর্বত প্রমাণ বাধা অতিক্রম করে অধ্যাবসায় ও পুরুষকারের   শক্তিতে যে বিদ্যা অর্জন করেছিলেন তা সাগরের মতো বৃহৎ ও গভীর ছিল। তাঁকে পড়িয়ে সকল শিক্ষকই ধন্য হয়েছেন। ছাত্রের কাছে শিক্ষকের হার ঈশ্বর লাভের আনন্দের সমান। কর্ম জীবনের কথা বাদ দিয়ে যদি ছা্ত্র জীবনের কথাই শুধু ধরি -তিনি বড় ,অনেক বড়ই ছিলেন। কারণ যে সময় মানুষ অন্যের কাছে দয়ার পাত্র; তিনি কিন্তু সে সময় অপরকে দয়া করেছেন। তাই তিনি দানে বড়। বিশ বছরের পাঠ বারো বছরে শেষ করেছেন,তাই তিনি প্রতিভায় বড়ো। শত অভাবেও অধ্যয়ন ছাড়েননি,তাই তিনি অধ্যাবসায়ে বড়।  কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত যথার্থই  লিখেছেন ----

“বীরসিংহের সিংহশিশু!বিদ্যাসাগর! বীর!

উদ্বেলিত দয়ার সাগর-বীর্য্যে সুগম্ভীর!

সাগরে যে অগ্নি থাকে কল্পনা সে নয় ,

তোমায় দেখে অবিশ্বাসীর হয়েছে প্রত্যয়। ”

আজ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনের সামান্য অংশ প্রয়াণ দিবসে  স্মরণ করে  তীর্থ-ভ্রমণের স্বাদ অনুভব করলাম।

---------------------------------------  

মৃত্যু  ১৮৯১।। ২৯জুলাই ।।


কোন মন্তব্য নেই

ok

4x6 থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.