ছোটোগল্পে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
ছোটোগল্পে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) ছিলেন একজন বিখ্যাত বাঙালি লেখক। তিনি উপন্যাস, ছোট গল্প, ভ্রমণকাহিনী ও দিনলিপি রচনা করেছেন। তাঁর কাজের মধ্যে "পথের পাঁচালী" বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একজন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ।
বিভূতিভূষণের ছোটগল্পের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য
বৈশিষ্ট্য:
- প্রকৃতি
প্রেম:
বিভূতিভূষণ
প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন এবং তার লেখায় প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর বর্ণনা পাওয়া
যায়। তার
ছোটগল্পে প্রকৃতি শুধু পটভূমি নয়, বরং গল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
- সাধারণ
মানুষের জীবন:
তার
গল্পে সমাজের তথাকথিত "ছোট" বা "সাধারণ" মানুষের জীবনযাত্রা
প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি তাদের
সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, অভাব-অনটন, আনন্দ-বেদনা অত্যন্ত দরদ দিয়ে ফুটিয়ে
তুলেছেন।
- মানবতাবাদী
দৃষ্টিভঙ্গি:
বিভূতিভূষণের
গল্পে মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি মানুষের প্রতি সহানুভূতি,
ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
- দার্শনিক
দৃষ্টিভঙ্গি:
তার
গল্পে জীবনের গভীরতা, জীবনের প্রতি মমত্ববোধ, এবং জীবনের দার্শনিক দিকটিও প্রকাশিত
হয়েছে। তিনি
জীবনকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার এবং তা গল্পে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
- গল্পের
ভাষা ও রচনাশৈলী:
তার
ভাষা সহজ, সরল এবং সাবলীল। গল্পের
ঘটনাবলী বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি অসাধারণ মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন।
- অতীতচারণ:
বিভূতিভূষণের
ছোটগল্পে প্রায়শই অতীতচারণ বা স্মৃতিকাতরতা লক্ষ্য করা যায়। তিনি ফেলে
আসা দিন, শৈশবের স্মৃতি, গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ইত্যাদির প্রতি বিশেষভাবে
আকৃষ্ট ছিলেন।
- শিশুদের
প্রতি আকর্ষণ:
ছোটদের
প্রতি তার গভীর মমত্ববোধ ছিল এবং শিশুদের নিয়েও তিনি অনেক গল্প লিখেছেন।
- হাস্যরসাত্মকতা:
তার
গল্পে হাস্যরসেরও অবতারণা দেখা যায়, যা গল্পগুলিকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম ছোটোগল্প সংকলন মেঘমল্লার-এর অন্তর্গত দশটি গল্পের মধ্যে সাতটি প্রবাসী পত্রিকায় ও তিনটি বিচিত্রা পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। গল্পগুলির রচনাকাল
১৯২১ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যবর্তী সময়।
- মেঘমল্লার (১৯৩১)
- মৌরীফুল (১৯৩২)
- যাত্রাবাদল (১৯৩৪)
- জন্ম ও মৃত্যু (১৯৩৮)
- কিন্নর দল (১৯৩৮)
- বেণীগির ফুলবাড়ী (১৯৪১)
- নবাগত (১৯৪৪)
- তালনবমী (১৯৪৪)
মৌরীফুল সংকলনটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের ভাদ্র
মাসে। এই গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ১০টি গল্পের মধ্যে "মৌরীফুল" গল্পটি প্রবাসী পত্রিকার অগ্রহায়ণ ১৩৩০ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।
ইংরেজি ও বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় অনূদিত এই গল্পটিকে বিভূতিভূষণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প
মনে করা হয়।
(১) "মৌরীফুল",
(২) "জলসত্র",
(৩) "রোমান্স",
(৪) "রাক্ষস-গণ",
(৫) "হাসি",
(৬) "প্রত্নতত্ত্ব",
(৭) "দাতার স্বর্গ",
(৮) "খুঁটি-দেবতা",
(৯) "গ্রহের ফের",
(১০) "মরীচিকা"।
যাত্রাবদল সংকলনের গল্পগুলি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার
পর পুস্তকাকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৪১ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে।
১) "ভণ্ডুলমামার বাড়ি",
(২) "পেয়ালা",
(৩) "উইলের খেয়াল",
(৪) "কনে দেখা",
(৫) "সার্থকতা",
(৬) "একটি দিন",
(৭) "বাইশ বছর",
(৮) "বৈদ্যনাথ",
(৯) "ডানপিটে",
(১০) "যাত্রাবদল"।
জন্ম ও মৃত্য গল্প-সংকলনের গল্পগুলি বঙ্গশ্রী ও অন্যান্য পত্রপত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।
১৩৪৪ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে কাত্যায়নী বুক স্টল থেকে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হওয়ার
পর আরেকটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশিং কোম্পানি (প্রাইভেট)
লিমিটেড থেকে--
(১) "যদু হাজরা ও শিখিধ্বজ",
(২) "জন্ম ও মৃত্যু",
(৩) "সই",
(৪) "রামশরণ দারোগার গল্প",
(৫) "খুড়ীমা",
(৬) "বায়ুরোগ",
(৭) "অরন্ধনের নিমন্ত্রণ",
(৮) "লেখক",
(৯) "বড়বাবুর বাহাদুরি",
(১০) "অন্নপ্রাশন",
(১১) "তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প",
(১২) "ডাকগাড়ী",
(১৩) "অকারণ"।
কিন্নরদল সংকলনের গল্পগুলি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
"মণিডাক্তার" গল্পটি বঙ্গশ্রী পত্রিকার আশ্বিন ১৯৩৭ সংখ্যায় এবং "কিন্নরদল"
গল্পটি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত পরিচয় পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়।
(১) "মণিডাক্তার",
(২) "পুরোনো কথা",
(৩) "খোসগল্প",
(৪) "একটি দিনের কথা",
(৫) "বাটি-চচ্চড়ি",
(৬) "তারানাথ তান্ত্রিকের দ্বিতীয় গল্প",
(৭) "ডাইনী",
(৮) "বুধীর বাড়ি ফেরা",
(৯) "বিধু মাস্টার",
(১০) "উন্নতি",
(১১) "কিন্নরদল"।
বেণীগীর ফুলবাড়ি গল্প-সংকলনের গল্পগুলি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত
হয়। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখ কাত্যায়নী বুক স্টল থেকে এটি প্রথম গ্রন্থাকারে
প্রকাশিত হয়। সাহিত্যায়ন থেকে প্রকাশিত এটির দ্বিতীয় সংস্করণের নাম ছিল কুয়াশার রঙ--
(১) "কুয়াশার রঙ",
(২) "মাস্টার মশায়",
(৩) "তিরোলের বালা",
(৪) "জনসভা",
(৫) "জনসভা",
(৬) "প্রত্যাবর্তন",
(৭) "প্রাবল্য",
(৮) "বাঁশি",
(৯) "পাঁচুমামার বিয়ে",
(১০) "শান্তিরাম",
(১১) "ফিরিওয়ালা",
(১২) "নিষ্ফলা",
(১৩) "বেণীগীর ফুলবাড়ি"।
উপলখণ্ড গল্প-সংকলনটি লেখকের নবম গল্পগ্রন্থ। এটি ১৯৪৫ সালে
প্রকাশিত হয়।
(১) "আহ্বান",
(২) "একটি ভ্রমণ কাহিনী",
(৩) "নসুমামা ও আমি",
(৪) "দৈবাৎ",
(৫) "বিড়ম্বনা",
(৬) "ভুবন বোষ্টুমি",
(৭) "শাবলতলার মাঠ",
(৮) "পৈত্রিক ভিটা",
(৯) "দুর্মতি",
(১০) "ফকির",
(১১) "আইনস্টাইন ও ইন্দুবালা"।
নবাগত গল্প-সংকলনটি ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত হয়। এই সংকলনের
"স্বপ্ন-বাসুদেব" গল্পটি দেশ পত্রিকার অগ্রহায়ণ ১৩৫১ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল
(১) "দ্রবময়ীর কাশীবাস",
(২) "ক্যানভাসার কৃষ্ণলাল",
(৩) "পারমিট",
(৪) "মুক্তি",
(৫) "গায়ে হলুদ",
(৬) "ঠাকুরদা’র গল্প",
(৭) "ভিড়",
(৮) "আরক",
(৯) "থিয়েটারের টিকিট",
(১০) "পার্থক্য",
(১১) "স্বপ্ন-বাসুদেব"।
অনুসন্ধান গল্প-সংকলনটি ১৩৬৬ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে প্রকাশিত
হয়। "অনুসন্ধান" গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল ঢাকা থেকে প্রকাশিত সোনার বাংলা পত্রিকার ১৩৫৪ বঙ্গাব্দের শারদীয়া সংখ্যায়।
(১) "অনুসন্ধান",
(২) "টান",
(৩) "চ্যালারাম",
(৪) "যাচাই"।
তাঁর লেখায় প্রকৃতির
সৌন্দর্য ও মানুষের জীবনের গভীর সম্পর্ক বারবার উঠে এসেছে। তিনি ছিলেন একজন জীবনবাদী লেখক, যিনি জীবনের জয়গান গেয়েছেন। ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর তিনি মারা যান।

কোন মন্তব্য নেই
ok