মেদিনীপুরের লোকখাদ্য: ড. নীলোৎপল জানা
মেদিনীপুরের লোকখাদ্য
ড. নীলোৎপল জানা, বাংলা বিভাগ
মহিষাদল গার্লস কলেজ
মেদিনীপুর প্রাচীন জনপদের একটি
উল্লেখযোগ্য নাম। এই জেলা এখন ভেঙে তিনটি জেলায় বিভক্ত হয়েছে। কিন্তু লোকখাদ্য
বিষয়ক আলোচনায় অবিভক্ত জেলার লোকখাদ্যের পরিচয় থাকবে। বর্তমান শিক্ষা সংস্কৃতিতে
এই জেলা যতই এগোক না কেন এখনো এই জেলায় লোকজ সংস্কৃতি প্রবল ভাবে প্রভাব ফেলে।
তাই বোধ হয় এখনো মেদিনীপুরের ঘরে ঘরে সন্ধ্যাবেলায় তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বলে,
নবান্ন হয়, আলপনা দেওয়া হয়, কৃষ্ণ যাত্রা, মঙ্গল গান ইত্যাদির সঙ্গে ছেলে
ভুলানো ছড়ার পাশাপাশি রূপকথাও ঠাঁই পায়। এর সবের সঙ্গে উঠে আসে আমোদ প্রমোদ ও
রসনার কথা। প্রসঙ্গত লোকখাদ্যের বৃহত্তর সম্ভার হল এই অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা। বেশ
কিছু পরিচিত লোকখাদ্য হল পান্তা ভাত, বড়ি, মাছের টক, পিঁপড়ার ডিমের চাটনি,তালের
বড়া, নানা ধরনের পিঠে, ফেনা ভাত, লাবড়া, বেগুন-আলু-টমেটো পোড়া ইত্যাদি
পান্তা ভাত
শস্য শ্যামলা এই বাংলার পলি
মাটিতে প্রধানত যে শস্য সারা বছর ধরে চাষ হয় তা হল ধান। তাই এই দেশের প্রধান খাদ্য
ভাত। গরম ভাতের সাথে পান্তা ভাতের যথেষ্ট চাহিদা আছে। একদম মেদিনীপুরের মাটি ঘেঁষা
খাদ্য বা লোকখাদ্য পান্তা। আগের দিনের ভাত বেঁচে গেলে তাতে ঠান্ডা জল মিশিয়ে সারা
রাত রেখে দিতে হবে। সকালে সেই ভাত খেলে শরীর যথেষ্ট ঠান্ডা থাকে, বিশেষ করে গরম কালে
খেলে খুব উপকার পাওয়া যায়। পান্তা ভাতের আনুষঙ্গিক খাদ্য হিসেবে থাকে বড়ি ভাজা, আলু
ভাজা, বেগুন পোড়া, নানান রকম ভর্তা, মাছ ভাজা ও টক, শুকনো লঙ্কা ভাজা ইত্যাদি। আর
থাকতেই হবে কাঁচা পেঁয়াজ, লঙ্কা ও গন্ধ লেবু। অবিভক্ত বাংলার কোনো কোনো অঞ্চলে পাতে
পান্তার বন্ধু শুঁটকি মাছের ভাজা। শৌখিন টেবিলে নয়, মাটিতে বসে স্বাদ নিতে হয় পান্তার।
এই পান্তা এখনো শিক্ষিত জনের মধ্যেও সমান জনপ্রিয়। বিশেষ করে শ্রমিক-কৃষকের মধ্যে পান্তা-ভাত
বেশি প্রচলিত। কারণ এটি খেলে দীর্ঘক্ষণ ক্ষুধা লাগে না এবং তেমন বেশি তরি-তরকরির প্রয়োজন
পড়ে না।
ফেনা ভাত
ভাতের ফেন না ঝরিয়ে গরম ভাতে
ঘি সহযোগে খাওয়া মেদিনীপুরের লোকখাদ্যের আরেক উদাহরণ। সারা বছর খেলেও বিশেষ করে শীতকালে
নতুন আলু সেদ্ধ দিয়ে এটি খাওয়া হয় গ্রামাঞ্চলে। এতে যেমন বিশি ভিটামিন থাকে তেমনি খেতে
সুস্বাদু। আলুমাখা আর ভাজা লঙ্কা হলেই আনন্দে খাওয়া সাঙ্গ হয়। কম খরচে পেট ভরে।
আচার
আচার পছন্দ করে না এমন মানুষ নেই বললে চলে। আচার শব্দটি শুনলে আমাদের
জিভে জল চলে আসে। আম, লঙ্কা, রসুন , তেঁতুল ও আদার আচার বাংলার বাইরেও মেলে। কিন্তু
কুল, চালতা, আমড়া ,জলপাই, কামরাঙা, আমলকির আচার বা আমতেল, কাসুন্দি এগুলো নিতান্তই
মেদিনীপুরের লোকখাদ্য। অত্যন্ত যত্ন সহকারে
মেদিনীপুরের ঘরে ঘরে মা, বোনেরা এগুলো তৈরি করে। ঘরোয়া উপাদানে এগুলো সমৃদ্ধ।
নিজের হাতে বানিয়ে রোদে রেখে সারা বছরের জন্য সংরক্ষিত হয় এই জিনিস। স্বাদ উচ্চ মানের।
ঘুরতে ফিরতে বাড়ির লোক এর ব্যবহার করেন। ভাত-ডালের সাথে একটু আচার বা আমতেলে মাখা
বা শাকের সঙ্গে কাসুন্দি যেন অমৃত। যত যাই হোক, আজও বাংলার ঘরে আচার তৈরি হয়। বাংলায়
ছাড়া এর স্বাদ আর কোথাও এমন মিলবে না।
আমতেল
কাঁচা আম টুকরো টুকরো করে
খোসা সহ কেটে বিভিন্ন ধরনের উপাদেয় মশলা মিশিয়ে সর্ষের তেলে দিয়ে রোদে রেখে তৈরি আমতেল
মেদিনীপুরের লোকজ খাদ্যের এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
আমসত্ত্ব
মেদিনীপুরের বাইরে যে আমসত্ত্ব
পাওয়া যায় যাকে আম পাঁপড় বলে তার সাথে আমাদের জেলার আমসত্ত্ব আকাশ পাতাল তফাত। পাকা
আম দিয়ে হরেক উপায়ে আমসত্ত্ব বানানোর কাজ মেদিনীপুরের মানুষ করে। এখন মিষ্টির দোকানে
নানা রকম মিষ্টান্ন তৈরিতে আমসত্ত্বের ব্যবহার হচ্ছে।
বড়ি
মেদিনীপুরের লোকজ খাদ্য সম্ভারের এক বিশেষ উদাহরণ
হল বড়ি। গ্রামাঞ্চলের ঘরে ঘরে আজকের দিনেও তৈরি হয় বড়ি। এই বড়ি কিন্তু বাংলার বাইরে
খাওয়ার প্রচলন তেমন নেই। মূলত শীতকালে বড়ি দেওয়া হয়। বড়ির মূল উপাদান হল বিভিন্ন
ধরনের ডাল যেমন মুগ, মুসুর, বিউলি ইত্যাদি। খুব মিহি করে শিলে বাটতে হবে ডাল। তারপর
এর মধ্যে স্বাদ মতো চালকুমড়োর শাঁস, নুন, লঙ্কা, জিরে-ধনে গুঁড়া ও অন্যান্য দরকারি
মশলা মিশিয়ে খুব ভালো করে ফেটাতে হবে। প্রথম দুটো বড়ো মাপের বড়ি দেওয়া হয় যাদের
বলে বুড়ো বুড়ি। এদের তেল হলুদ, সিঁদূর, ফুল, ধান, দুর্বা সহযোগে পুজো করে বাকি বড়ি
ছোট ছোট করে তৈরি করে পরিষ্কার সাদা কাপড়ে বা চাটাইতে তেল ঘসে দিয়ে চড়া রোদে রাখতে
হয় শুকনো হবার জন্য। তারপর সেই বড়ি খাওয়া হবে সারা বছর ধরে ভাজা, শাকে, তেতোতে,মাছের
ঝোলের মধ্যে দিয়ে। গহনাবড়ি দিতে কুমড়ো লাগে না, লাগে পোস্তো। এই গহনা বড়ি এখন বিদেশেও
পঠানো হচ্ছে। আজ লোকখাদ্য বাবু-ভায়াদের পাতে স্থান পেয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরে
দেওয়া হয় এই গয়না বড়ি যেখানে বড়ির আকার বিভিন্ন অলংকারের মত। এগুলো পোস্ত দানার
ওপর রেখে আকার দিয়ে শুকানো হয়। এখন পোস্তর দাম বাড়ায় তিল বীজ ও সুজির ব্যবহার করা হচ্ছে।
এই বড়ি ভাজা খেতে মজা বেশি।
মাছের টক
এইবঙ্গের সমুদ্র তীরবর্তী
অঞ্চল ও খরা প্রধান অঞ্চলের প্রধান লোকখাদ্য মাছের টক। প্রধানত পূর্ব মেদিনীপুর ও সুন্দরবন,
বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও বর্ধমান জেলার মানুষ এই ধরনের খাবার খেতে অভ্যস্ত। রুই
বা কাতলা জাতীয় বড়ো মাছ, মৌরলা, কাঁচা আমের
টুকরো দিয়ে রান্না হয়, ফোড়ন দিয়ে। আবার কোথাও মাছের ডিমটাও এভাবে রান্না হয়। পূর্ব
মেদিনীপুরের সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষ সমুদ্রের মাছের তেঁতুলের টক পছন্দ করে বেশি।
এই টক রান্নার খরচ খুবই কম। টক খাবার প্রচন্ড গরমে শরীর শীতল রাখে।
তাল
‘তাল খাও রসের পিঠায়
নইলে হবো তালকানা;
ভাদ্দর মাসের তালের পিঠার
সুঘ্রাণে হই আটখানা!’
কথায় আছে ভাদ্রের তাল পাকা গরম। ভাদ্র মাসে যখন তাল পাকে তখন ঘরে ঘরে মা-মাসিরা তালথেকে কাথ্ বের করে তাতে চাল গুড়ো , আটা, চিনি, নারকেল, কলা ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করে তাল ফুলুরি, তালের লুচি, মালপোয়া ও আরোও কত কিছু। ভাদ্রের জন্মাষ্টমীর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল তাল। তালের ফুলুরি বা বড়ায় চিনি, নারকোলের টুকরো, চিনেবাদাম, এলাচগাঁড়ো, মৌরি দিয়ে ভাজলে অসাধারণ স্বাদ আসে। তবে এগুলো না দিয়েই মানুষ বেশি খায়।
পিঠে
মূলত শীতকালে বাংলা জুড়ে নতুন ধানের চাল আর গুড়ের রমরমা। যদিও পৌষে নবান্ন দিয়ে পিঠে উৎসবের সূচনা কিন্তু সারা শীত ধরেই এই বাংলার ঘরে ঘরে তৈরি হয় নানান রকম পিঠে। চাল গুঁড়ো, দুধ ও নারকেল হল পিঠের প্রধান উপকরণ। এর সাথে আরও অনেক উপকরণ মিশিয়ে বাংলা লোকখাদ্যে স্থান পেয়েছে পাটিসাপটা, ভাজা / ভাপা/ দুধ পুলি, আসকে পিঠে, গোকুল পিঠে, গোলাপ পিঠে, চিতই পিঠে পুর-পিঠে ইত্যাদি। খেত যেমন সুস্বাদু তেমনি মজাদার।
পায়েস
পিঠের যমজ ভাই যেন পায়েস।
দুধে সুগন্ধি চাল ফুটিয়ে তৈরি করা এই পায়েস, অনুষঙ্গ হিসেবে থাকে এলাচ, তেজপাতা, কাজু-কিশমিশ।
শীতকালে ঘরে ঘরে বানানো হয় নতুন গুড়ের পায়েস। রুটি, লুচি, পরোটা বা মুড়ি দিয়ে খাওয়া
হয়। পূজো পার্বণে বা জন্মদিনে মেদিনীপুরে মানুষ সবার আগে তৈরি করে পায়েস।
মুড়ি
কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর 'হাইওয়ে' কবিতায় লিখেছেন--
"নদী পেরুলে কোলাঘাট, কোলাঘাট ছাড়ালে দেউলিয়াবাজার।
সেখানে বাস
থেকে নেমেউইকএন্ডের শৌখিন বাবুরা
গোবিন্দ সামন্তের
মালিকের দোকান থেকে একঠোঙা মুড়ি,
বিটনুন-ছেটানো দু-দুটো আলুর চপ, আর এক ভাঁড় চা খেয়ে ফের বাসে ওঠে।
তারপর কেউ ঝাড়গ্রাম, কেউ টাটানগর,
কেউ জুনপুট কি দিঘার দিকে চলে যায়।"
মুড়ি হল মেদিনীপুর তথা বাংলার
লোকখাদ্যের এক উৎকৃষ্ট নিদর্শন। চাল থেকে মুড়ি তৈরি করে তা বিভিন্ন ভাবে খাওয়া হয়।
এদেশে ভাতের পরেই মুড়ির স্থান। শুধু মুড়ি না, মুড়ি থেকে তৈরি মোয়াও যথেষ্ট জনপ্রিয়।
মেদিনীপুরের মানুষ পৃথিবীর যে প্রান্তে যাক সঙ্গে মুড়ি থাকবেই। অনেই বলেন- মুড়ি দিয়ে
যায় মেদিনীপুরের মানুষ চেনা।
মুড়কি
মেদিনীপুর তথা বাংলার লোকজ খাদ্য মুড়িক। খৈ, মুড়ি, চিঁড়ে, বাদাম, তিল ইত্যাদি গুড় বা চিনির রসে মিশিয়ে তৈরি হয় মুড়কি যা বাংলায় এখনো জনপ্রিয়। লোকছড়ায় পাই-
‘চার মাগী দাসী দেব পায়ে তেল দিতে।
উড়কি ধানের মুড়কি দেব শাশুড়ি ভুলাতে।’
প্রাচীন কাল থেকেই মুড়কির জনপ্রিয়তা আছে। এখন যে জয়নগরের মোয়া পাওয়া যায় তা মুড়কির স্পেশাল সংস্করণ।
বাটা
বাংলার বাইরেও পাতা বেটে খাওয়ার চল আছে কিন্তু সেটা রুটি, পুরির সাথে চাটনি হিসেবে। মেদিনীপুরের লোকখাদ্যে যে বাটা স্থান পেয়েছে তা গরম ভাতে প্রযোজ্য। ধনেপাতা, থানকুনি, পটল খোসা, কাঁচকলা খোসা, লাউপাতা, পোস্ত, ঝিঙে ইত্যাদি বেটে গরম তেলে কালো জিরে ফোড়ন দিয়ে সেটা নেড়ে খাওয়া হয়। এতে শীর ঠাণ্ডা যেমন হয় তেমনি রোগ-প্রতিরোধও বাড়ে।
পোড়া
আলু, বেগুন, টমেটো এসব আগুনে পুড়িয়ে কাঁচা সর্ষের তেল ও লঙ্কা সহ গরম ভাতের সাথে খাওয়া মেদিনীপুরের আর এক লোকখাদ্যের উদাহরণ।
লাবড়া/ছ্যাঁচড়া :
হরেক সব্জির মেলবন্ধন হল এটি। নিরামিষ হলে লাবড়া, আর তাতে মাছের মাথা দিলে ছ্যাঁচড়া মেদিনীপুরের লোকখাদ্যের জনপ্রিয়। বাড়ির নানান শুভকাজে লাবড়া/ছ্যাঁচড়া হবেই হবে।
মেদিনীপুরের লোকখাদ্যের ভান্ডার সমৃদ্ধ। কত যুগ ধরে চলে
আসছে এবং আগামীতেও চলবে। তবে বর্তমানে গ্লোবালাইজেশনের যুগে মানুষ বড্ড বেশি বহির্মুখী
হয়ে পড়েছে। বাজার থেকে কেনা জিনিস বেশি পছন্দ করছে। কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামে এই ট্রেন্ট
এলেও তেমন থাবা ফেলত পারেনি। লোকখাদ্যে দুটো জিনিস হয়- ১)পয়সার অপচয় বন্ধ হয়। ২) নির্ভেজাল
খাদ্য পাওয়া যায়।
=================
তথ্যসূত্র
১) ক্ষেত্রসমীক্ষা
২) দেবাশিস প্রধান
৩) পরিতোষ মান্না
৪) চন্দন করণ
৫) গুগুল চিত্র
.jpeg)

.jpeg)
.jpeg)
.jpeg)
.jpeg)
.jpeg)
.jpeg)
.jpeg)
.jpeg)
.jpeg)
.jpeg)
.jpeg)
.jpeg)
.jpeg)

কোন মন্তব্য নেই
ok