'ওহে গিরিরাজ, গৌরী অভিমান করেছে।'- এটি কোন পর্যায়ের পদ? পদকর্তা কে?
'ওহে গিরিরাজ, গৌরী অভিমান করেছে।'- এটি কোন পর্যায়ের পদ? পদকর্তা কে? পদটির কাব্যসৌন্দর্য বিচার করো।
আলোচ্য পদটি শাক্ত পদাবলির অন্যতম পর্যায় 'আগমনী'র অন্তর্গত।
আলোচ্য 'ওহে গিরিরাজ, গৌরী অভিমান করেছে।' পদটির রচয়িতা হলেন শাক্ত পদাবলির অন্যতম পদকর্তা কমলাকান্ত ভট্টাচার্য।
আলোচ্য পদটিতে উমাকে কেন্দ্র করে মাতৃহৃদয়ের অমঙ্গল আশঙ্কা ব্যক্ত হয়েছে। আমরা আগমনীর বিভিন্ন পদে দেখেছি উমাকে স্বামী গৃহে পাঠিয়ে দীর্ঘ অদর্শনে মা মেনকার হৃদয়-ব্যাকুলতা। দৃষ্টান্ত হিসেবে 'বল গিরি, এ দেহে কি প্রাণ রহে আর, / মঙ্গলার না পেয়ে মঙ্গল সমাচার।' কিংবা 'গিরি হে তোমায় বিনয় করি আনিতে গৌরী/যাও হে একবার কৈলাসপুরে।' প্রভৃতি পদের কথা তুলে ধরা যায়। আর আমাদের আলোচ্য 'ওহে গিরিরাজ, গৌরী অভিমান করেছে।' পদটিতে মেনকা জানতে পারে যে উমা তার দুঃখ কষ্টের কথা নারদকে জানিয়েছে। কেবল নিজের দুঃখ নয় তার মধ্যে ছিল মায়ের প্রতি অভিমান। উমার উক্তিতে যা ফুটে উঠেছে এভাবে- 'মা বুঝি নিতান্ত পাসরেছে। সম্পূর্ণ 'আগমনী' জুড়ে রয়েছে যে মায়ের হৃদয়যন্ত্রনা, পাঠক মাত্রই জানে সে মা উমাকে ভুলতে পারে না। বরং দেখা যায় নারদের উপস্থিতিতে আগুনে আরো ঘি পড়েছে। আর এভাবেই পদটি বিভিন্ন মাত্রায় স্বাতন্ত্র্যের দাবী রাখে।
যথা- (ক) নারদের প্রতি উমার দুঃখ বর্ণনা
(খ) নারদের উপস্থাপনে মেনকার অভিব্যক্তি
ও (গ) পদকর্তার অভিপ্রায় বনাম সামাজিক প্রেক্ষিত
আমরা জানি 'গৌরীদান' প্রথায় তথা বাল্যকালেই উমার বিয়ে হয়েছে। এও জানা যায়- বার বার গিরিরাজকে অনুরোধ করার পরও তিনি উমাকে আনতে অবহেলা করেছেন। অথচ মেনকার এই উদ্বেগ উমার কাছে পৌঁছায়নি। অন্যদিকে উমা ভেবেছে তাকে না আনা আসলে তাকে ভুলে যাওয়া। যে মায়ের নাড়ী কেটে সন্তানের জন্ম হয় সে কি করে পারে ভুলে যেতে। যদিও উমার মনে হওয়া স্বাভাবিক -
'দেব দিগম্বরে সঁপিয়ে আমারে, মা বুঝি নিতান্ত পাসরেছে।'
-এর মধ্যে পরিস্ফুট হয়েছে প্রচ্ছন্ন দুঃখবোধ। এ কথা সত্য যে- সবাই যাকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখে, এমনকি দেবতারাও, সেই মহাদেব হচ্ছে উমার স্বামী। কিন্তু এই পরিচয় উল্লেখ করে উমা যখন মায়ের প্রতি অভিমান দেখিয়েছে, তখন তার মধ্যে অন্য এক সত্য বেরিয়ে আসে।
যে মা কন্যাপ্রাণা তার মধ্যে কন্যার জন্য আশঙ্কা করা স্বাভাবিক। আশঙ্কা থেকেই বেরিয়ে এসেছে সম্ভাব্য কারণ সমূহ। কারণ হিসেবে মেনকা বলেছেন- বাঘছাল, হাড়মালা ও মাথায় সাপ নিয়ে শিবের জীবন অতিবাহিত হয়। পৃথিবীর সমস্ত মা আকাঙ্ক্ষা করে মেয়ের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য। আকাঙ্ক্ষা করে জামাই-এর বিষয়-সম্পত্তিবোধ। অথচ অর্থ অর্থহীন হয়ে গিয়েছে মহাদেবের কাছে। ধুতুরা ফল ছাড়া যার অবশিষ্ট কিছু নেই। এমন জামাই-এর পরিস্থিতিকে গিরিরাজ যখন উপলব্ধি করতে পারছেন না, তখন মেনকাও অভিমান প্রকাশ করেছে। 'কেবল তোমারই মন ভুলেছে।।' ধরনের উক্তি গিরিরাজের শিব-ভক্তির উদাহরণ হিসেবে পরিস্ফুট। কিন্তু মা এর মন দেব রূপী শিবকে দেখেনি। সে বাস্তবের মাটিতে পা রাখার জায়গা খুঁজেছে। তাই স্বামী সোহাগিনী, সুরধুনীকে সতীন-যন্ত্রনার কণ্টকিত অধ্যায় হিসেবে দেখা হয়েছে। কারণ মেনকা পৌরাণিক চরিত্র হলেও পদকর্তা তাঁকে সাধারণ মা হিসেবে এঁকেছেন। মানুষ স্বাভাবিক প্রবৃত্তিতেই নেতিবাচক আশঙ্কা করতে অভ্যস্ত।
কারণ ভালো হলে তো ভালো, কিন্তু যদি খারাপ হয়? আর এভাবেই জৈবিক রক্ত মাংসে সজ্জিত চরিত্রের নির্মাণ পদকর্তার প্রজ্ঞাশীল জীবনবোধকেই ফুটিয়ে তোলে।
পদের শেষে দেখা যায় পদকর্তা কমলাকান্তের নিবেদন। তিনি মেনকার ভাবনার সঙ্গী হয়েছেন। তাই বলতে পেরেছেন-'একথা মোর মনে লৈয়েছে।' পদকর্তা এখানে শিবের পৌরাণিক ঐশ্বর্যে আপ্লুত হননি। বরং তিনি যখন গিরিরাজকে 'তুমি শিখরমণি' হিসেবে সম্বোধন করেন তখন যেন দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সচেতন করার একটা অভিপ্রায় লক্ষ্য করা যায়। পরক্ষণেই আবার মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন এই বলে যে-
'তোমার নন্দিনী, ভিখারীর ভিখারিণী হয়েছে।'
-এ উক্তির মধ্যে তিনি সমাজভাবনাকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। সেইসঙ্গে একই চরণে একদিকে শিখরমণি' পরক্ষণেই 'ভিখারিণী' -এই বৈপরীত্য শব্দ প্রয়োগে যে বৈচিত্র সৃষ্টি করেছেন তা শব্দকুশলী কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের কৃতিত্বই তুলে ধরে।
==============ছোটো প্রশ্ন-উত্তর
১. 'মা বুঝি নিতান্ত পাসরেছে'- এখানে মা কাকে বলা হয়েছে? পাসরেছে শব্দের অর্থ কি?
আলোচ্য অংশে মা বলতে মেনকাকে বোঝানো হয়েছে। 'পাসরেছে' শব্দের শব্দের অর্থ হল ভুলে যাওয়া।
২. 'একে সতীনের জ্বালা'- ব - কার সতীন? সতীনের পরিচয় দাও।
এখানে উমার সতীনের কথা বলা হয়েছে। সতীন বলতে শিবের জটা থেকে উৎপত্তি গঙ্গাকে বোঝানো হয়েছে। অবশ্য আলোচ্য পদটিতে তাকে 'সুরধুনী' বলা হয়েছে।
৩. 'নারদে কত না কয়েছে-' নারদের পরিচয় দাও।
নারদ হলেন ব্রহ্মার মানসপুত্র। । ইনি ত্রিকালদর্শী, বেদজ্ঞ এবং হরিভক্ত তপস্বী। তর্পণের জন্য ইনি সর্বদা জল ( (নীর) দান করতেন বলে বা অনাবৃষ্টির পর জন্ম বলে নাম নারদ।
৪. 'এ কথা মোর মনে লৈয়েছে।' 'এ কথা' বলতে কোন কথা বলা হয়েছে? 'মোর' বলতে কার কথা বলা হয়েছে? এখানে 'এ কথা' বলতে মেনকার উমা সম্পর্কে দুঃখবোধের কথা বলা হয়েছে। 'মোর' বলতে পদকর্তা কমলাকান্তের কথা বলা হয়েছে।


কোন মন্তব্য নেই
ok