অধ্যাপক মনোজ মিত্র ও তাঁর নাট্যচর্চা : ড. নীলোৎপল জানা
কাছ থেকে দেখা অধ্যাপক মনোজ মিত্র ও তাঁর
নাট্যচর্চা
ড.নীলোৎপল জানা
(১)
একান্নবর্তী,
মধ্যবিত্ত, প্রত্যন্ত গ্রাম্য পরিবেশে
আমার বড় হয়ে ওঠা। ফলে শহরের রংচঙে সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যোগাযোগ গড়ে উঠতে অনেকটা সময় লেগে গেছিল । গ্রাম্য পরিবেশে আনন্দ উৎসবে যাত্রাগান (যেমন কৃষ্ণ যাত্রা,
মঙ্গল যাত্রা, কবিগান ইত্যাদি) ছিল
আনন্দদানের প্রধান উপকরণ । আর সিনেমা, থিয়েটার ছিল আমাদের কাছে স্বপ্ন, তবে সে
সময় দূরদর্শন বড়লোকেদের বাড়িতে থাকলেও ততটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি । কিন্তু
সিনেমার বিকল্প হিসাবে ভিডিও থাকলেও বিয়ে বাড়ি,
উৎসব বাড়িতে কদাচিৎ অনুষ্ঠিত হতো । ভিডিও
হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে গ্রামের কচি-কাঁচারা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা নতুন ধরনের আনন্দ উপভোগের আশায় রবাহুত হয়ে উপস্থিত
হতেন সেই অনুষ্ঠানে । আমার বয়স যখন দশ বছর ,আমি প্রথম লুকিয়ে
ভিডিও দেখতে যাই পাড়ার এক বিবাহ অনুষ্ঠানে । বরযাত্রীদের
আনন্দদানের উদ্দেশ্যে ভিডিও চালান হতো । তখনও বোঝার মতো
সেই ক্ষমতা তৈরি হয়নি ঠিক কিন্তু মনের মধ্যে একটা আলাদা আনন্দ কাজ করতো । এখন বেশ
মনে পড়ছে সেখানেই দেখেছিলাম মনোজ মিত্রের অভিনীত ছবি ‘আতঙ্ক’। এখনো মনে আছে সেই ভয়ঙ্কর বক্তব্য- ‘মাস্টারমশাই আপনি কিছুই দেখেননি’ ওই সিনেমায় মাস্টারমশাইয়ের ভূমিকায় ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়,
পোস্টমাস্টার সুরেশবাবু হলেন মনোজ মিত্র । ওই সময় থেকেই নাট্যকার মনোজ মিত্রের নামের সঙ্গে পরিচয় ঘটে । বড় হয়ে ‘আতঙ্ক’
ছবিটা প্রায় দশবার দেখেছি । তপন সিংহের পরিকল্পনা সে সময়ের
সমাজব্যবস্থাকে আমাদের সামনে উন্মুক্ত করে দেয় । পরবর্তী সময়ে বহু সিনেমায় মনোজ
মিত্রকে দেখেছি বিভিন্ন ভূমিকায় । আমার দেখা মনোজ মিত্রের উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলি
হল কিডন্যাপ, নয়নমনি, আবিষ্কার, গণশত্রু ,অন্তরের
ভালোবাসা ,বৌরাণী, প্রেম পূজারী,
সন্ধ্যাতারা, হুইল চেয়ার, সংঘর্ষ, লাঠি, বকুল
প্রিয়া, ভালোবাসা, সমাধান,
আলো, তিন-মূর্তি
ইত্যাদি ।
আমি তখন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে এম.এ পড়ার
জন্য রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি বিটি রোড ক্যাম্পাসে । সে সময়
নাট্য সাহিত্য যাঁরা পড়াতেন,তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- দর্শন চৌধুরী
ও মনোজ মিত্র মহাশয় । তবে মনোজবাবুর ক্লাস করার জন্য আমরা জোড়াসাঁকোয় মাঝে মাঝে
যেতাম । সিনেমায় যে মনোজ মিত্রকে দেখে অভ্যস্ত ছিলাম, অধ্যাপক হিসাবে মনোজ মিত্র অন্য ধরনের মানুষ । তাঁর অঙ্গ-ভঙ্গি , কথা বলার কৌশল ,বক্তব্য আমরা শুনতে শুনতে মোহিত হয়ে যেতাম ।
এতদিন পরেও তাঁর বক্তব্য কানে বাজে । এমন ধরনের শিক্ষক পরবর্তী সময়ে আর দেখা যাবে কি’না সন্দেহ।
(2)
এবার আসা যাক তাঁর জীবন ও নাট্যচর্চায় । নাট্যকার মনোজ মিত্রের জন্ম অধুনা বাংলাদেশের খুলনা জেলায় ১৯৩৮ সালে ২২ ডিসেম্বর । বিচারক পিতার চার ছেলে-মেয়ের মধ্যে বড় হলেন মনোজ মিত্র । ছেলেবেলার ডাক নাম বুদ্ধদেব । ১৯৪৬ সালে খুলনা ছেড়ে পাবনায় যান বাবা-মায়ের সঙ্গে । বাবার বদলির চাকরির কারণে ১২ বছর পর্যন্ত প্রথাগত পাঠ তাঁর গ্রহণ করা হয়নি । দেশভাগের পর ১৯৫০ সালের এদেশে এসে টেংরা ভূতনাথ ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন মনোজ মিত্র মহাশয় । তিন মাস পর উত্তর ২৪ পরগনার দন্ডির হাট নগেন্দ্রনাথ উচ্চ শিক্ষা নিকেতনের ভর্তি হন সপ্তম শ্রেণিতে । শিক্ষকদের সান্নিধ্যে শিল্প-সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী হয়ে ওঠেন । কয়েকটি গল্প বসুমতি, যুগান্তর, মন্দিরা প্রভৃতি
পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । পরবর্তী সময়ে ‘অনশ্বর’ নামে একটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয় । গল্প লেখার সঙ্গে সঙ্গে
অভিনয়েও নেশা ছিল তাঁর । ওই স্কুলে পড়ার সময়ই তিনি প্রথম মঞ্চে পা রাখেন । ডাকঘর, বৈকুন্ঠের খাতা ইত্যাদি ছোটোদের নাটকে অভিনয় করতে থাকেন । মনোজ মিত্র এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন—“আমাদের পরিবারে আমি প্রথম শিশুশিল্পী হিসেবে মঞ্চে অভিনয় করি । তবে সিরিয়াসলি নাটকের কাজ করি কলকাতায় আসার পর” । ( আজকাল পত্রিকা ৯আগস্ট ১৯৮৮ )
১৯৫৪ সালে স্বপরিবারে দন্ডির হাট ছেড়ে চলে আসেন কলকাতার বেলগাছিয়ার ভাড়া বাড়িতে ।
মনোজ মিত্র ভর্তি হন স্কটিশচার্চ কলেজে দর্শনে অনার্স নিয়ে
প্রথমবর্ষে । প্রথমবর্ষে পড়ার সময় ‘শেকড়’ ও ‘নেশা’ গল্প দুটি
পত্রিকায় প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে লেখকের পরিচয় ঘটে । এক
সাক্ষাৎকারে নাট্যকার বলেন--"ভাবতাম আমি
গল্পকারই হব কিন্তু হঠাৎ ঘুরে যায় জীবনের মোড়’’। (আনন্দবাজার
পত্রিকা ৩০ মে ২০০৯)
১৯৫৪ সালে প্রথম কলেজ সোশ্যালে
বিধায়ক ভট্টাচার্যের নাটক ‘তাইতো’তে অভিনয় করেন মনোজ । এরপর ১৯৫৭ সালের ১৫ আগস্ট গড়ে তোলেন নাট্যদল ‘সুন্দরম’। এই নাট্যদল ১৯৫৮ সালে প্রথম মঞ্চস্থ করেন
‘পথের পাঁচালী’র কাহিনি নিয়ে নাটক ।
এরপরে এই নাট্যদল অভিনয় করে অতনু সর্বাধিকারীর ‘সিঁড়ি’
নাটক ;এরপরই নাট্যকার হিসেবে মনোজ মিত্র
পপুলার হয়ে ওঠেন । নাট্য রচনাকার হিসবে মনোজ মিত্রকে প্রথম দেখা গেল স্নাতকোত্তর ছাত্রাবস্থায় ১৯৫৮
সালে । ওই সময় রচনা করেন ‘মৃত্যুর চোখে জল’। এটি একাঙ্ক নাটক হিসেবে যেমন প্রথম পুরস্কার পায়
তেমনি ২১ বছর বয়সের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে নির্বাচিত হন । বেতার নাটক প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পায় ‘মৃত্যুর
চোখে জল’।
নীতিগত কারণে ১৯৬০ সালে হাতে গড়া ‘সুন্দরম’ নাট্যগোষ্ঠী ভেঙে
যায় ।ঐ সালে যোগ দেন শ্যামল ঘোষ এর ‘গন্ধর্ব’ নাট্যগোষ্ঠীতে । মনোজ মিত্র নাট্যকার
ও অভিনেতা হোক, পিতা অশোক মিত্র কখনই চাইতেন না । কলেজে
চাকরি পেলেও বারবার তিনি চাকরি ছেড়েছেন । ১৯৬৪ সালে নিউ আলিপুর
কলেজে যোগ দিয়ে গড়ে তোলেন নতুন নাট্যদল ‘ঋতায়ন’। কিছুদিনের মধ্যে ‘ঋতায়ন’ নাট্যদলের সমাধি ঘটে । কিন্তু ১৯৭০ সালের মধ্যে বেশ কয়েকটি
উল্লেখযোগ্য নাটক তিনি রচনা করে ফেলেন ; যেমন অশ্বত্থামা-১৯৬৩, অবসন্ন , প্রজাপতি- ১৯৬৪, রক্তগোলাপ - ১৯৬৪, জন্ম-মৃত্যু ভবিষ্যৎ- ১৯৬৬, টাপুর টুপুর ,কাল বিহঙ্গ, চাকভাঙা মধু ইত্যাদি নাটক রচনায় ঝাঁপিয়ে
পড়েন । ইতমধ্যে পূর্বের নাট্যদল ‘সুন্দরম’এর ভাঙ্গা অবস্থা সহ্য করতে না পেরে পুনরায় ‘সুন্দরম’
নাট্যদলের হাল ধরেন মনোজ মিত্র মহাশয় । ১৯৭৫ সালে নিজের লেখা
‘পরবাস’ নাটক দিয়ে দ্বিতীয় পর্বের
যাত্রা শুরু হয়।
ওই নাটকের
গজমাধব চরিত্রে অভিনয় করে খ্যাতি লাভ করেন মনোজ মিত্র । ওই নাটকের অভিনয় দেখে
‘বেতাব’ পত্রিকার বিমল কর মহাশয়
প্রশংসা করেন মনোজ মিত্রের । এরপর থেকেই মনোজ মিত্র অভিনয় করে দর্শকদের মন জয় করে চলেছেন ।
অধ্যাপক পবিত্র সরকার ,মনোজ মিত্র সম্পর্কে মন্তব্য করে
বলেছেন-- ‘মনোজ মিত্র এ সময়ে সবচেয়ে
জনপ্রিয় বাঙালি নাট্যকার’। (মনোজ মিত্র
নাট্য সংগ্রহ ( ১) ভূমিকা, দ্বিতীয় সংস্করণ।
‘সুন্দরম’ প্রযোজিত মনোজ মিত্রের নাটক---
নাটক মঞ্চ নির্দেশক প্রথম অভিনয়কাল
মৃত্যুর চোখে জল সুন্দরম পার্থপ্রতিম
চৌধুরী ১৯৫৯
নীলকন্ঠের বিষ সুন্দরম পার্থপ্রতিম
চৌধুরী ১৯৬৪
পরবাস একাডেমি অফ ফাইন আর্টস মনোজ মিত্র ৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৫
সাজানো বাগান একাডেমি অফ ফাইন আর্টস মনোজ মিত্র ৫ এপ্রিল, ১৯৭৭
মেষ ও রাক্ষস একাডেমি অফ ফাইন
আর্টস মনোজ মিত্র ৯ জুন, ১৯৮০
কাক চরিত্র নৈহাটি নরেন্দ্র বিদ্যানিকেতন দুলাল লাহিড়ি ৩১ ডিসেম্বর,
১৯৮২
নৈশভোজ রবীন্দ্রসদন মনোজ মিত্র ৮ জানুয়ারি, ১৯৮৬
অলকানন্দার পুত্রকন্যা একাডেমি অফ ফাইন আর্টস মনোজ মিত্র ৩ নভেম্বর, ১৯৮৯
শোভাযাত্রা একাডেমি অফ
ফাইন আর্টস। মনোজ মিত্র ৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৮১
গল্প হেকিম সাহেব একাডেমি অফ ফাইন আর্টস মনোজ মিত্র ২৮ মার্চ, ১৯৯৪।
ছায়ার প্রাসাদ একাডেমি অফ ফাইন
আর্টস মনোজ মিত্র ২৩ জুন, ১৯৯৮
অন্তরঙ্গ গিরিশ মঞ্চ দীপক
দাস ২৭ আগষ্ট, ২০০০
মুন্নি ও সাত চৌকিদার রঙ্গনা মনোজ
মিত্র ২৫ অক্টোবর,
২০০১
চমচমকুমার নিরঞ্জন
সদন দীপক দাস ২৯ মার্চ,
২০০৩
অপারেশন ভোমরাগড়। মধুসূদন মঞ্চ মনোজ মিত্র ৩ অক্টোবর,
২০০৪
রঙের হাট পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র। মনোজ মিত্র ১২
ডিসেম্বর, ২০০৬
যা নেই ভারতে আকাদেমি। বিভাস চক্রবর্তী ১৫ আগস্ট, ২০০৭।
( অসম্পূর্ণ তালিকা )
(৩)
মনোজ মিত্রের প্রথম নাট্য ফসল হলো ‘মৃত্যুর চোখে জল’ ২১ বছর বয়স থেকেই নাট্য রচনা
শুরু করেন । মনোজ মিত্রের অভিনেতা হিসেবে পরিচিতি ঘটে ‘সুন্দরম’
নাট্যগোষ্ঠীর মধ্য দিয়ে । ১৯৫৯ সালে একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতায়
অংশগ্রহণের জন্য এক রাত্রিতে লিখে ফেলেন ‘মৃত্যুর চোখে জল’
।নাটকটির কেন্দ্রীয় বিষয় হল মৃত্যু । নাটকটিতে দেখানো হয়েছে--
জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধের জীবন তৃষ্ণা কতটা প্রবল হতে পারে । লেখক
এক জায়গায় বলেছেন ‘ মৃত্যুর চোখে জল এর বৃদ্ধটি
আমার খুব চেনা । আমার ঠাকুরদা দুরারোগ্য ব্যধিতে ২৫ বছর ছিলেন …শয্যাবন্দী।…কি
দুর্গম ছিল তাঁর বাঁচার আকাঙ্ক্ষা’। নাটকটিতে
বৃদ্ধের ভূমিকায় অভিনয় করেন ২১ বছরের মনোজ মিত্র । তাঁর অভিনয়ে নাটকটির জনপ্রিয়তা এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যে হিন্দি, অসমীয়া ,তামিল ,পাঞ্জাবি
ভাষায় নাটকটি অনুদিত হয়েছিল।
তাঁর দ্বিতীয় একাঙ্ক ‘পাখির চোখ’ পরে ‘পাখি’ নামে প্রকাশিত হয় । এই নাটকের বিষয় শ্যামা ও নিখিলের সুখ দুঃখের সংসার । অনেক ঘটনার ঘনঘটায় তাঁরা শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারে বিবাহবার্ষিকীটা মিথ্যা নয় । নাট্যকার দেখাতে চেয়েছেন সর্বগ্রাসী অভাব-অনটন প্রেমকে কেড়ে নিতে পারে না । এই নাটকে প্রথম অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র বসু ও শাঁওলি মিত্র ।
‘নীলকণ্ঠের বিষ’ ১৯৬০ সালে মনোজ মিত্রের প্রথম পূর্ণাঙ্গ নাটক ।মাত্র ২২ বছর বয়সে নাট্যকারের লেখায় ধরা পড়ল ইতিহাসের অমোঘ সত্য । মানুষকে যাঁরা ভালোবেসেছে তারাই হয়েছে নিঃসঙ্গ ,ভালোবাসা বঞ্চিত । নাট্যকার রচনা করেছেন জীবনকে ভালোবাসার এক অন্য গল্প।
১৯৬৩সালে রচিত হয় ‘অশ্বত্থামা’ পুরাণ আশ্রিত পূর্ণাঙ্গ নাটক । কাব্যময়তার আড়ালে মনোজ মিত্র তুলে ধরেন সমকালীন
যৌবনের হাহাকারকে ট্র্যাজেডির মোড়কে । এই নাটকের মধ্য
দিয়ে নাট্যকার সমাজের কাছে একটি বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন যে - ধ্বংসের মধ্য দিয়ে
কোনো মহৎ উদ্দেশ্য সাধন সম্ভব নয় তাই অশ্বত্থামাকে বলতে শোনা গেছে -- “বল মহারাজ, আর হিংসা নয়-
ধ্বংস নয়- এবার সৃজন । যতো প্রাণনাশ করেছি আমরা, ততপ্রাণ সৃজন করব আমরা। এই ধরিত্রীর তৃণমূলে জল দেব ।
তাকে লালন করব । অনাবৃত ধরণীর উলঙ্গ বুক ঢেকে দেব পল্লবিত বিকাশে ।”
১৯৬৩ তে প্রকাশিত হয় কমেডি নাটক ‘অবসন্ন প্রজাপতি’ । এরপর ১৯৬৫ সালে ‘নীলা নামে একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক মনোজ মিত্রের দ্বারা রচিত ও নির্দেশিত হয় । ১৯৬৭ সালে রচনা করেন ‘তক্ষক’ ও ‘টাপুর টুপুর’ নামে দুটি একাঙ্ক নাটক। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে মনোজ মিত্র রচনা করেন প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের নাটক ‘চাকভাঙা মধু’। এতে দেখানো হয়েছে শোষিতের মনুষ্যত্ব ও শোষকের কুৎসিত লোভের জল-জ্যান্ত ছবি। শ্রেণিগত সমস্যাই এখানে মুখ্য বিষয় । এই নাটক প্রসঙ্গে লেখক জানিয়েছেন--- “কোথায় যেন সংবাদ বেরিয়েছিল ওঝার বাড়িতে বিষ ঝাড়াতে এসে সর্পদংশনে মৃত্যু । তারপরেই চাক ভাঙা মধু লিখি।”( মনোজ মিত্র: বাংল নাট্য-হরানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ,বইমেলা-২০০১ )
১৯৭০ গ্রুপ থিয়েটার এর জন্য লিখেন ‘কেনারাম বেচারাম’। ১৯৭৬ সালে লেখেন ‘চোখে আঙুল দাদা’ প্রমথনাথ বিশীর ছোটগল্পের অনুপ্রেরণায়। এটি মূলত হাসির নাটক। এছাড়া একই সালে মনোজ মিত্র রচনা করেন ‘সাজানো বাগান’।
‘সাজানো বাগান’( ১৯৭৬ ) নাটকটি লেখককে জনপ্রিয়তার চূড়ায় পৌঁছে দেয় । এই নাটকের জন্ম কথা বলতে গিয়ে লেখক বলেন-- “....সহকর্মীর বলা লোককথা থেকে মরতে মরতে না মরা বুড়োর গল্পটা পাই এখানে, কোনো একটা কথা কাহিনির মধ্যে।” (নৃপেন সাহা সম্পাদিত মনোজ মিত্রের সাজানো বাগান এক সর্বজনীন বিশ্বজনীন নাটক,পৃ.-৯) এর কাহিনি গড়ে উঠেছে বাঞ্ছারামকে নিয়ে । তার একটি সাজানো বাগান আছে । বাগানকে নিয়েই তার স্বপ্ন , বেঁচে থাকা । বাঞ্ছারামের সঙ্গে থাকে তার ছোট মেয়ের ছেলে গুপি । বাগানে চোরের উৎপাতে মাঝে মধ্যে নারিকেল ,কলা ইত্যাদি চুরি হয়ে যায় । একদিন শোনা যায় জমিদার ন’কড়ি দত্ত বাগান কিনে নেবে । কিন্তু চোরেরাও তা চায় না । এদিকে বাঞ্ছারামকে তার নাতি বাগান বেচে দিতে বলে, তাতে বাঞ্ছারাম রাজি হয় না । ন’কড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করে বাঞ্ছারামের টিপসই নিতে চায় । কিন্তু তাতেও বাঞ্ছা রাজি নয় ; শেষে ছাপান্ন হাজার টাকায় বিক্রি করতে রাজি হয় । কিন্তু একটি শর্ত রাখে যতদিন বাঁচবে বাগান তার এবং প্রতি মাসে ২০০ টাকা করে দিতে হবে । ন’কড়ি ভেবেছিল বেশিদিন বাঁচবে না কিন্তু নাতবৌয়ের আদর যত্নে হাঁটাচলা করতে থাকে । নাতবৌয়ের বাচ্চা হলে বাঞ্ছারাম ন’কড়িকে জানায় সে মরতে পারবে না কারণ, বাচ্চাটার প্রতি তার মায়া পড়ে গেছে । নাটকের শেষে ন’কড়ি মারা যায় এবং বাঞ্ছা সোজা হয়ে হেঁটে চলে । নাটকটি একইসঙ্গে হয়ে ওঠে জীবন-সংগ্রাম, শ্রেণিসংগ্রামের নাটক ।
৫ এপ্রিল ১৯৭৭ সালে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে মনোজ মিত্রের
নির্দেশনায় এই নাটকটি অনুষ্ঠিত হয় ।
১৯৮০ সালে তপন সিংহ পরিচালিত ‘সাজানা বাগানে’র চলচ্চিত্রায়নে বাঞ্ছারামের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য পেলেন শ্রেষ্ঠ
অভিনেতা পুরষ্কার - ‘ফিল্ম ফেয়ার’। নাটকটি পরে ইংরেজি, অসমীয়া, মারাঠি, মনিপুরী
,উড়িয়া প্রভৃতি ভাষাতে অনুদিত
হয়েছে । পরবর্তী সময়ে হিন্দি ছবি নির্মিত হয় ‘ইয়ে
জো হ্যা জিন্দেগী’ নামে ।
অসাধারণ নাটক রচনার জন্য ১৯৭৮ পান গিরিশচন্দ্র পুরস্কার । ভালো নাটক রচনার জন্য তিনি পেলেন ‘সংগীত নাটক একাডেমী’ পুরস্কার । দর্শনের শাস্ত্র এর ছাত্র হয়েও তিনি নাটকে সাফল্যলাভ করায় তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্য বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন । পেয়েছেন ‘অলকানন্দা পুরস্কার’ (১৯৯১), ‘বেস্ট টিভি অ্যাক্টর পুরস্কার’ ‘শিশির ভাদুড়ী স্মৃতি পুরস্কার’(২০০৫) ,এশিয়াটিক সোসাইটি গোল্ড মেডেল । বাংলাদেশ থেকে পেয়েছেন ‘সৈয়দ মুনীর চৌধুরী পুরস্কার’, ২০১২ সালে পেয়েছেন রবীন্দ্রভারতী কর্তৃক ‘ডি লিট’ , ২০১৩ তে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক ‘বঙ্গভূষণ’ পুরস্কার । এইভাবে একাধিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন মনোজ মিত্র। তিনি এখনো নাটক রচনা এবং অভিনয় করে চলেছেন । আমি এই অভিনেতার দীর্ঘায়ু কামনা করি । আমার শিক্ষক হিসাবে আমি তাকে শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানাই ।
তথ্যসূত্র-
১.মনোজ মিত্র :সাক্ষাৎকার, অনির্বাণ কর,আনন্দবাজার পত্রিকা ৩০ মে, ২০০৯
২. মনোজ মিত্র :সাক্ষাৎকার,
সঞ্জয় সিংহ,আজকাল পত্রিকা ৯ আগস্ট ১৯৮৮
৩.বেতার জগৎ পত্রিকা:১৫-৩০
নভেম্বর ১৯৭৫
৪.মনোজ মিত্র নাটক সমগ্র
১-মিত্র ও ঘোষ ,ভূমিকা -পবিত্র সরকার,তৃতীয় মুদ্রণ
৫.মনোজ মিত্রের দশ একাঙ্ক
: অপেরা,২০১০
৬.অমলেন্দু সেনগুপ্ত :
থিয়েটার,প্রথম খন্ড, ২০০১
৭.পবিত্র সরকার : নাট্যমঞ্চ
নাট্যরূপ, ১৯৯৯
৮মনোজ মিত্র : বাঞ্ছরাম,থিয়েটার
সিনেমায়, ২০০০
৯.সন্ধ্যা দে : বাংলা
নাট্যকোষ, ২০১০
১০.মনোজ
মিত্রের নাট্য সমগ্র, ( ১ম-৫ম খন্ড ) মিত্র ও ঘোষ, ১৪০৯-১৪১৩
কোন মন্তব্য নেই
ok