বিমল করের’ 'আত্মজা', ড. নীলোৎপল জানা
‘ইডিপাস কমপ্লেক্স’ বিমল করের 'আত্মজা'
ড.নীলোৎপল
জানা
বিশ
শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলা কথাসাহিত্যে যাঁর স্বদর্পে উপস্থিতি তিনি হলেন বিমল কর।
তিনি ছোটগল্প রচনা করেই লেখক জীবন শুরু করেছিলেন। তাঁর
প্রথম ছোটগল্প ‘অম্বিকানাথের
মুক্তি’ (১৯৪৪)। তিনি রচনা করেছেন উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা,
নাটক প্রভৃতি । ‘দ্বন্দ্ব’ পত্রিকায় ছাপা হয় লেখকের দুটি গল্প ‘পিয়ারীলাল
বার্জ’ আর ‘ভয়’। ‘উত্তরসূরী’ পত্রিকায়
ছাপা হয় বিখ্যাত গল্প ‘ইঁদুর’।
পত্রিকা পাঠ করে বিমল কর মহাশয়কে জানার চেষ্টা করেন. সাগরময় ঘোষ। তাঁর সম্পর্কে প্রথম পরিচয়ের কথা জানাতে গিয়ে সাগরময় ঘোষ লিখেছেন—
“অত্যন্ত নিরীহ গোবেচারা
লাজুক প্রকৃতির একটি মানুষ। যাঁকে প্রথম দর্শনে মনে করেছিলাম
নিতান্তই একটি নিরীহ কঞ্চি, কিছুক্ষণ আলাপের পর বোঝা গেল, আসলে ইনি একটি লিকলিকে চাবুক। অথচ
আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেছি সেই চাবুকের আস্ফালন তাঁর লেখায় তিনি কখনো প্রকাশ করেননি, সেখানে শিল্পীর ধর্ম পুরোপুরি বজায় রেখে এসেছেন।”
বিমলকরের গল্পের সংখ্যা
প্রায় দুই শত। বহু উল্লেখ যোগ্য গল্প তিনি রচনা
করেছে। তাঁর উল্লেখ যোগ্য গল্প সংকলনগুলি হলো— ‘বরফসাহেবের মেয়ে’ (১৯৫২), ‘পিঙ্গ লার প্রেম’ (১৯৫৭), ‘আঙুরলতা’ (১৯৫৮),
‘সুধাময়’ (১৯৫৯), ‘মোহনা’ (১৯৭৩) , ‘প্ৰেমশশী’
(১৯৭৬), ‘গুণেন একা’ (১৯৮৪), ‘উপাক্ষানমালা’ (১৯৯২) প্রভৃতি। ‘আত্মজা' গল্পটি স্থান পায় ‘পঞ্চাশটি গল্প’ নামাঙ্কিত গল্প গ্রন্থে। কিন্তু ১৯৫৪ সালে মার্চ মাসে ‘দেশ’ পরিত্রকায় ‘আত্মাজা’
গল্পটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তার খ্যাতি ও অখ্যাতি পাঠক সমাজে
ছড়িয়ে পড়ে।
=====================
'আত্মজা' গল্প সম্পর্কে আলোচনা করা হল। গল্পটির বিশ্লেষণ পড়ে দেখতে পার। ভুল বোঝাবুঝির ফলে একটা জীবন কিভাবে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয় তার পরিচয় তুলে ধরা হল। এমন ধরনের ঘটনা সমাজে লক্ষ্য করা যায় যা বিমল কর সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
‘আত্মজা’ গল্পের উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলো হলো
হিমাংশু, স্ত্রী যূথিকা, ও কন্যা
পুতুল। দাদুর খামখেয়ালিতে হিমাংশুর বিবাহ হয় কুড়ি বছর বয়সে পনেরো বছরের যূথিকার সঙ্গে। অল্প বয়সে বিবাহ হওয়ায় যৌবনের একটা Romance
হিমাংশুকে ঘিরেছিল ঠিকই কিন্তু জীবনে একটা গভীর ক্ষতি হয়ে গেল।
কারণ ১৬ বছরের যুথিকা মাতৃত্ব লাভ করতে গিয়ে মরতে বসেছিল। বহু অর্থ ব্যয়ে বেঁচে উঠলেও
মাতৃত্ব, লাভের ক্ষমতা চিরদিনের জন্য হারায়। শুধু তাই
নয় যূথিকার মনোমুগ্ধকর চেহারাটিও নষ্ট হয়ে যায়,
সে শুধু অস্থিসার বিবর্ণ। এসব কিছুতে হিমাংশুর তেমন আগ্রহই ছিল
না। তার কাছে পুতুলই ছিল যথেষ্ট। তবুও যুথিকাকে সে আগের মতোই ভালোবাসে। তাইতো
বাইশটাকা খরচ করে আকাশ নীল রঙা পশমের জামা কিনে আনে যূথিকার জন্য হিমাংশু এত কিছুর
পরেও প্রাণবন্ত।
আসলে যূথিকাই হিমাংশুর কাছে অনেকটাই নিস্পৃহ। এমন চঞ্চল স্বামীর কাছে যূথিকার
নিস্পৃহতা সত্যই বেমানান। দেখতে দেখতে পুতুল বড় হয়ে ওঠে, সে এখন কিশোরী। হয়তো
যূথিকা মেয়ের মধ্যে নিজের কিশোরী
বয়সের ছাপ প্রত্যক্ষ করে কিছুটা ঈর্ষান্বিতা। কারণ মেয়েরা নিজেদের সম্পর্কে একটু
বেশি ঈর্ষাপ্রবণ বা সেনসেটিভ। মা হলেও সে মেয়ে। তার এমন
কোনো বয়স হয়নি; তার যৌবনও
আছে, অথচ সব কিছু গোলমাল হয়ে গেল মেয়ে
পুতুল হবার সঙ্গে সঙ্গে। তাই বোধ হয় পরোক্ষে পুতুল অনেকটাই দায়ী। এ কারণে যূথিকা সচেতন ভাবে মাতৃত্বের অধিকার
প্রয়োগ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। অন্যদিকে মেয়েকে কেন্দ্র
করে হিমাংশুর ভালোবাসা স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশি। সব
সময় মেয়েকে নিয়ে তার দিন কাটে। সাইকেলে বসিয়ে মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যায়,
সাঁতারের কস্টিউম পরিয়ে ছবি তোলে,
শীতের সময় গরম জল করে মেয়ের চুল, হাত-পা ধুয়ে দেয়, ছুটির
দিনে মার্কেটিং-এ বেরিয়ে ইচ্ছেমতো জিনিস কিনে দেয়;
যা দেখে যূথিকার খুব অস্বাভাবিক লাগে। তার মনের মধ্যে সব সময় কোনো কিছু খারাপ চিন্তা উঁকি মারতো। এমনই অবস্থায়
তেল ঢেলে দেয় যূথিকার পিসতুতো বোন, অধ্যাপিকা শিপ্রা।
দিনটা ছিল সেদিন শনিবার।
কথাছিল যূথিকা দুপুরে যাবে শিপ্রাদির বাড়ি এবং ফিরবে সন্ধ্যায়। পুতুল সেদিন
স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে একা থাকবে তাই হিমাংশুকেও সেদিন তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বাড়ি
ফিরতে হবে। পুতুল আবার বাবাকে জানায় তার কাটানো জামা
দেওয়ার ডেট সেদিন। কথা মতো সেদিন হিমাংশু একটু দেরিতেই
বাড়ি ফেরে জামার
প্যাকেট হাতে নিয়ে। তার পর চা খেতে খেতে পুতুলকে বলে জামাটা পরে আসার জন্য। কথা মতো
পুতুল ক্রিমসন রঙের জামাটা গায়ে দিয়ে হিমাংশুর সামনে আসে। তখন হিমাংশুর মনে হয়—“আশ্চর্য, আশ্চর্য সুন্দর এই পুতুল। কি নিখুঁত অঙ্গ।” এরপর জামার
খুঁত গুলো দেখতে দেখতে হিমাংশুর মনে হয়েছে ‘কি সরু সুন্দর কোমর পুতুলের’। এরপর
হিমাংশু ,মেয়ে পুতুলকে কোমর জড়িয়ে শূন্যে তুলে
ধরে।পুতুলও কিছুটা ভয় পেয়ে বাবার মাথা জড়িয়ে ধরে। আর লুজ ফ্রকের আড়ালে
হিমাংশুর চোখ, নাক, মুখ সব ঢাকা
পড়ে যায়। এমনই অবস্থায় যূথিকা ও শিপ্রা চলে আসে ঘরের
সামনে। পুতুলকে ছেড়ে দিয়ে হিমাংশু সহজ সরল সুরে শিপ্রাদিকে
ঘরে আসার আহ্বান জানায়। কিন্তু যূথিকা শিপ্রাদিকে নিয়ে চলে যায় পাশের ঘরে। শিপ্রাদি যূথিকাকে জানায় এই ধরনের
রুচি, খুবই খারাপ, নোংরা।
সেই রাতে ঘুমন্ত মেয়েকে দেখে হিমাংশু নিজের ঘরে ফেরার পর যূথিকার উপস্থিতি ঘটে। “..যেন খুব জ্বর থেকে ও উঠে
এসেছে, তেমনি শুকনো টকটকে ওর চোখ
মুখ, তেমনি বিশ্রীঝাঁজ আর
তিক্ততা তার গলায়।”
ঝাঁজালো গলায় বলতে থাকে—'তোমরা
দুজনে মেয়ে আর বাপে মিলে আমায় শেষ করে ফেলছো’।
‘তুমি কী বলত
মানুষ না পশু ? পুতুল না তোমার
মেয়ে ?’
‘তুমি বাপ হতে পার, কিন্তু সে মেয়ে,
তার রূপ আছে, বয়স আছে। তার কী নেই?
কী হয়নি। জাননা তুমি,..কোন আক্কেলে
তুমি ওর বুকে মুখ গুঁজে থাক, কোমর জড়িয়ে ধরো’।
এই
প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধা হয় না হিমাংশুর। গভীর রাত্রে হিমাংশু চিৎকার করে
ওঠে এক অসহনীয় অপ্রত্যাশিত যন্ত্রণায়। ঐ কয়েক মুহূর্তের মধ্যে দেখতে পেল জীবনের গভীর অন্ধকার সময়। এতদিন যা যা ভাবেনি আজ তাকে তা ভাবায়।
নিজেকে গলিত কুষ্ঠের মতো মনে হয়। আলো জ্বালাতেও সে ভয় পায়। কারণ নিজের রূপ নিজে দেখার ক্ষমতা আজ আর তার
নেই। বাথরুমের আয়নায় নিজের অস্পষ্ট ছবি দেখে তার মনে হয় ছায়াকৃতি লোকটা অন্য কেউ, সে আর যেই হোক হিমাংশু নয়। কারণ হিমাংশু হলো পিতা,
আর এ হলো পশু । নিজের মধ্যে সে খুঁজে
পায় পঙ্কিল গন্ধ। তাই শরীরের দূষিত রক্ত বের করতে মরিয়া হয়ে পড়ে। তুলে নেয়
হাতে ক্ষুর, বাম হাতের মণিবন্ধের উপর চেপে ধরে, তারপর ডান হাতের শিরায়, সব শেষে গলায়।। , যে কালো রক্তের খোঁজে হিমাংশু গলায় ক্ষুর বসিয়েছিল; সে কালো রক্ত খুঁজে পায়নি। বরং জীবনের অন্তিম
মুহূর্তে গভীর আচ্ছন্নতার মধ্যে দেখতে পায় তার মেয়েকে-‘যার বয়স পনেরো
বছর নয়,পনেরো দিন। অসহায়,উলঙ্গ,নির্বোধ এক রক্তপিন্ড’। এর পর চোখ বন্ধ করেছে হিমাংশু চিরতরে।
উনিশ-বিশ শতকের জটিল মনের প্রকাশ এই ছোটগল্প। বিমল কর
আত্মজা' গল্পে মনস্তত্ত্বের প্রকাশ ঘটিয়েছেন অসাধারণ
দক্ষতায়। মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্ব প্রকাশিত হয়েছে দুই চরিত্রকে কেন্দ্র করে—এক।। হিমাংশু
দুই।। যূথিকা। কর্মব্যস্ত হিমাংশু বাড়ি ফিরে মেয়েকে নিয়ে সময় কাটাতে চায়।
মেয়ে পুতুলও বাবাকে পেয়ে একাকীত্বের জীবন থেকে মুক্তির পথ পায়। পিতা ও সন্তানের
এই পারস্পরিক সুখ সম্পর্কের মধ্যে কোনো complex আছে বলে মনে হয় না। কোনো জটিলতা বা মলিনতার কথা না ভেবে যদি জীবন কাটানো যায়, তাতে কোনো সমস্যা আসার কথা নয়। কিন্তু এমন
অপত্য স্নেহের মাঝখানে নেমে আসে অন্ধকারময় রাত্রি। . একুশ বছর বয়সে কলেজে পড়ার
সময় হিমাংশুর সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল যূথিকার। কিন্তু
জীবনকে উপভোগ করতে না করতে যূথিকা এক বছরের মধ্যে হয়ে
যায় পুতুলের মা। মৃত্যুর পথ থেকে যূথিকাকে ফিরিয়ে আনে
হিমাংশু | শারীরিক গঠন সম্পূর্ণ হওয়ার আগে যূথিকার মা হওয়ার
কারণে এমন বিপত্তি ঘটে যায়। যাই হোক যূথিকা সম্পর্কে হিমাংশুর ভালোবাসা একটুও কমে নি।
কিন্তু মেয়ে পুতুল সম্পর্কে পিতার অতিরিক্ত স্নেহ ভালোবাসা
মেয়ে হিসাবে যূথিকা ভালোভাবে নিতে পারেনি। কারণ পুতুলও
মেয়ে যূথিকাও মেয়ে। মেয়ে পুতুলের দিকে তাকিয়ে
হিমাংশুর ভালোবাসার গভীরতা দেখে যূথিকা মনে মনে ঈর্ষান্বিতা হয়। সে মনে মনে ভাবে এই বয়সে তারও এমন ভালোবাসা পাওয়ার কথা ছিল কিন্তু পাওয়া হলোনা। এই
মনোবিকলন যেন বেশি বেশি দানা বাঁধতে থাকে যূথিকার মধ্যে। আরো গভীরে গেলে বলতে হয়,
যূথিকার বারবারই মনে হয়েছে তার প্রতি হিমাংশুর ভালোবাসা অনেকই কমে গেছে মেয়ে পুতুল আসার পর। প্রসঙ্গত বলতে পারি
ফ্রয়েডের তত্ত্বের প্রভাব এই গল্পে দূরলক্ষ্য নয়। একজন পুরুষ সব সময় অপজিট সেক্সের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করবে। তবে যূথিকাও মেয়ে পুতুলও মেয়ে।
তাহলে যূথিকার এমন মনে হচ্ছে কেন? যূথিকার মনের মধ্যে
কোথাও মেয়ের প্রতি ঈর্ষা ও হিংসা দানা বেঁধে ছিল। যখন সে মেয়ে পুতুলের সাজগোজ দেখে; যূথিকা তার পনেরো বছরের মেয়ের সঙ্গে নিজের বয়সের তুলনা করে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে ওঠে।
ছাইচাপা আগুনের মতো অন্তরে যন্ত্রণা নিয়ে যখন দিন কাটছে ,এমনই সময়ে এই আগুনকে প্রজ্বলিত করতে সাহায্য
করে কলেজের অধ্যাপিকা শিপ্রাদি। তিনি মনে করেন পিতাও
পুত্রীর এই সম্পর্ক সঠিক নয়। তিনি খুঁজে পান ‘ইডিপাস
কমপ্লেক্স’। শিপ্রাদির
বক্তব্য থেকে যূথিকা সাহস সঞ্চয় করে হিমাংশুকে আঘাত করতে
সাহস পায়।
মানসিক
ভাবে বিমর্ষ যূথিকা হৃদয়বৃত্তিকে কাজে না লাগিয়ে, বুদ্ধিবৃত্তির-চর্চায় সক্রিয় হয়ে পড়ে। Truth
এবং Fact এর মধ্যে তফাৎ উপলব্ধি করতে
পারে না যূথিকা। দীর্ঘদিনের চেপে রাখা রাগ এক লহমায় প্রকাশ করে যূথিকা। হিমাংশু
বুঝতে পারে না সহজে ,যূথিকা কি বলছে। যূথিকার এমন কুরুচিকর মন্তব্য—
“তুমি
বাপ হতে পার, কিন্তু সে মেয়ে; তার
রূপ আছে, বয়স আছে। তার কী নেই, কী
হয়নি। জাননা তুমি? তবু, এই
মেয়ে নিয়ে তোমার বেহায়াপনা, রোজ রোজ আমি দেখে যাচ্ছি। বাইরের লোক এসেও আজ দেখে গেল৷ ছি, ছি, ছি৷ কোন আক্কেলে তুমি ওর বুকে মুখ গুঁজে থাক, কোমর জড়িয়ে ধরো।”
এহ বক্তব্য সোনার পর হিমাংশুর জীবনে নতুন এক অধ্যায় শুরু হলো। যে কথা সে কোনো দিন ভাবেননি, ভাবতে চাননি; সে
সব কথা যূথিকা ভেবেছে? আমরা জানি সন্তান যত বড়ই হোক বাবা মায়ের কাছে সে ছোটই। কিন্তু কেন
যূথিকা এমন ভাবলো? আগেও বলেছি নারীতে নারীতে একটা হিংসা
কাজ করেছে। পুতুল, যুথিকার মেয়ে হলেও সে এক নারী।
যূথিকার ইঙ্গিত আর বুঝতে বাকি থাকে না হিমাংশুর। সে নিজেকে অপরাধী ভাবতে শুরু করে।
গভীর রাত্রে আলো জ্বালাতে গিয়েও তার কিন্তু মনে হয়,
এ মুখ সে যূথিকাকে দেখাবে কি করে? হিমাংশুর
দ্বিতীয় সত্ত্বা বারবার তাকে মুক্তির ও মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যায়। যেন বারবার
বলে-‘হায় হিমাংশু যাদের জন্য, যার জন্য এত কিছু করলি তারা তোকে চিনলো না। তুই এই সংসার ছেড়ে, পৃথিবী ছেড়ে চলে
যা।’ তাই হিমাংশু এই অপমানের গ্রন্থি মোচনের অভিপ্রায়ে বাথরুমে আত্মহননে নিমগ্ন হয়। হিমাংশুর এই পরিণামে পাঠক হিসাবে ব্যথিত হই। এছাড়া আর অন্য কোনো উপায়ও ছিল না নিজেকে গোপন করার। মৃত্যুর অতল
গহ্বরে যেতে যেতে হিমাংশু ভাবে তার পুতুলের কথা, সেই ছোট্ট মেয়ে পুতুল। প্রার্থনা করে
নিঃশব্দে-
“পুতুল,
আমার পুতুল, আমার কাছে ছোটটি থাক চিরকাল-ঈশ্বর,তুমি ওকে যৌবন দিয়ো না, প্রজাপতির রঙ ছুঁড়ো না ওর মনে।”
নিষ্পাপ হিমাংশুকে যে ভাবে মরতে হলো; এমন হাজার হাজার হিমাংশুকে প্রতিনিয়ত মরতে হয়। তবে এমন ঘটনাও যে অমিল
তা নয়। পিতা ও কন্যার মধ্যে অবৈধ সম্পর্ক চিরকাল ছিল আগামীদিনেও থাকবে। কারণ
মানুষ হল পশুর উন্নত সংস্করণ। যখনই তার মনের মধ্যে পশুত্ব
প্রকট হয়ে পড়ে তখনই সে সম্পর্ককে দূরে সরিয়ে খারাপ কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে।
‘আত্মজা’ গল্পের প্রধান চরিত্র হিমাংশু, সরল
সাদাসিধে মধ্যবিত্ত বাঙালি। দাদুর ধরা-ধরিতে একুশ বছরের
তরতাজা যুবক হিমাংশু, বিবাহ করে পনেরো বছরের যূথিকাকে। এই ঘটনা বাঙালি পরিবারে প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়। অল্প বয়সের
উত্তেজনায় সামান্য শিরশিরানী ছিলই, ফলে বছর ঘুরতে না
ঘুরতে যূথিকা মা হতে চললো।
যৌবনকে বুঝে উঠতে না উঠতে, শরীর-মন পরিপুষ্ট হতে না হতে
যূথিকার জীবনে নেমে এলো এক চরম ক্ষণ। ফলে অপরিণত যূথিকা
মা হতে গিয়ে প্রায় মৃত্যু মুখে পতিত হলো। কিন্তু স্বল্প
আয়ী হিমাংশু কোনোরকম কার্পণ্য না করে মা ও মেয়েকে সুস্থ
করে বাড়ি নিয়ে আসে। এরপর নানান কাজের মাঝেও হিমাংশু মা ও মেয়ে পুতুলকে ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখে। কম বয়সে মা হওয়ার কারণে যূথিকা সামান্য রুগ্ন
হয়ে পড়ে এবং তার মেজাজ খিট খিটে হয়ে যায়, কিন্তু হিমাংশু এসবের তোয়াক্কা না করে ভালোবাসায় খামতি রাখে না। দিনে দিনে মেয়ে পুতুল বড় হতে থাকে এবং বাবা
হিমাংশু দিনের বেশির ভাগ সময় মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সাইকেলে করে মেয়েকে
স্কুলে নিয়ে যাওয়া, সুইমিং কস্টিউম পরিয়ে ছবি তোলে, হাত-পা পরিষ্কার করে দেয় ইত্যাদি;
যা যূথিকার পছন্দ নয়। কারণ দিন দিন মেয়ে বড় হচ্ছে, তার শরীর, মন অন্য রকম হচ্ছে অথচ বাবা হিমাংশু
যেন তা বুঝতে পারছে না। যূথিকা মুখে না বললেও মেয়ে পুতুলকে দেখে তার সেই বয়সের
কথা বারবার মনে করে আর ভাবে তারও এমন উচ্ছল যৌবন, হতে পারতো কিন্তু হলো না শুধু পুতুল এসে যাওয়ায়। মা
হলেও মনে মনে নারী হিংসা কাজ করেছিল। রাগ যতই হোক না কেন
তার বহিঃপ্রকাশ ছিল না তেমন। একদিন মেয়ের কাটাতে দেওয়া জামা এনে হিমাংশু,
মেয়ে পুতুলকে পরতে বলে এবং তাকে জড়িয়ে ধরে যখন আদর করতে থাকে
তখন তার অপত্য স্নেহের প্রতি হিংসাত্মক হয়ে পড়ে যূথিকা। এখান থেকেই হিমাংশুর
জীবনের প্রথম অধ্যায়ের শেষ এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনা হয়।
সংসারে
নানান সমস্যা থাকলেও হিমাংশু বুঝতে দেয়নি মা ও মেয়েকে। সব সময় ভালোবাসায় ভরিয়ে রেখেছে হিমাংশু। এমন সুখী পরিবারে এক লহমায় নেমে এলো এক
অনভিপ্রেত ঘটনা। অধ্যাপিকা শিপ্রাদির আগমনে সব কিছু ভেঙে
চুরমার হয়ে গেল হিমাংশুর জীবনে। বাবাও মেয়ের মধ্যে অপত্য ভালোবাসাকে শিপ্রাদি ভালো
মনে না নিয়ে বলে ফেলে-এ এক ধরনের কমপ্লেক্স। এই ‘কমপ্লেক্স’
শব্দটির অর্থ যে যুথিকা ভালোভাবেই বুঝতে
পেরেছিল এর পরিচয় গল্পের অন্যত্র লক্ষ্য করা যায়। শুধু লক্ষ্য নয় হিমাংশুর
জীবনে মুহূর্তের মধ্যে নেমে আসে এক অন্ধকারময় রাত্রি। যে কথা কোনো দিন ভাবেনি হিমাংশু, তাকেই যেন উসকে দিল
শিপ্রাদি। তখন থেকেই হিমাংশু নিজেকে নিজে ঘৃণা করতে শুরু করলো। সেই ঘৃণা এতটাই নখ বের করে তাড়া। করল যে, সেখান থেকে মুক্তির একমাত্র পথ মৃত্যু।
গভীর রাত্রিতে আলো পর্যন্ত জ্বালতে পারলো না হিমাংশু; কারণ এমুখ সে আর কোনো দিন দেখবে না। তাই হাতে
তুলে নেয় ক্ষুর, শরীর থেকে সে বের করে দেবে কালো,
কুৎসিৎ রক্ত। কিন্তু তা তো হল না। হাতে, গলায় ক্ষুর বসিয়ে ধীরে ধীরে
মৃত্যু মুখে পতিত হল হিমাংশু। একটি সরল জীবনের এমন পরিণতি
পাঠককে না ভাবিয়ে পারে না।
গল্পের
কাহিনি আবর্তীত হয়েছে একটি পরিবারকে ঘিরে। ‘আত্মজা’
শব্দটি স্ত্রী বাচক। এর অর্থ হল ‘আত্মা
থেকে জন্মেছে যে কন্যা’। মানুষ তার সন্তানের মধ্য দিয়ে
নিজের জীবনে হারিয়ে যাওয়া সময়কে ফিরে পেতে চায়। তাই সে সন্তান কামনা করে,
নারী অথবা পুরুষ। সন্তান যত বড়ই হোক,
পিতা-মাতার কাছে তারা ছোট্ট। বিমল করের
‘আত্মজা’ গল্পটি এই জটিল মনস্তত্ত্বের
এক উজ্জ্বল সাক্ষর।
গ্রন্থসূত্র—
দত্ত বীরেন্দ্র- বাংলা ছোটগল্প:প্রসঙ্গ ও প্রকরণ,দুইখণ্ড, ২০০৯, কলকাতা
চক্রবর্তী
ইন্দ্রাণী- বাংলা ছোটগল্প রীতি-প্রকরণ ও নিবিড়
পাঠ,১৯৯৯, কলকাতা
নাথ রণবীর- আধুনিক বাংলা ছোটগল্প, ২০১১,কলকাতা
পাল শ্রাবণী- বাংলা ছোটগল্প পর্যালোচনা বিশ শতক,২০০৮, কলকাতা
চৌধুরী শীতল- বাংলা ছোটগল্প মননে দর্পণে,২০০৫, কলকাতা
জানা নীলোৎপল- একালের নির্বাচিত বাংলা ছোটগল্প ভাবে ও বিশ্লেষণে
,২০১৬,কলকাতা
রায় অনিলকুমার- ছোটগল্প সমীক্ষা,২০০৯
সাহিত্য অকাদেমি- বাংলা গল্প সংকলন,২০০৯,কলকাতা


কোন মন্তব্য নেই
ok