বাঙালি জাতির উদ্ভব : ড. নীলোৎপল জানা
বাঙালি
জাতির উদ্ভব
----------------------------------
অনুমান করা হয় বাঙালি জাতির উৎপত্তি বা উদ্ভব ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় ৬ কিংবা ৭ হাজার বছর আগে। বাঙালি জাতির ইতিহাস সম্পর্কে নৃবিজ্ঞানীদের ধারণা, এটি একটি মিশ্রিত বা সংকর জাতি। পৃথিবীর বহু জাতি বিভিন্ন সময়ে বাংলায় অনুপ্রবেশ করেছিল, অনেকে বেরিয়ে গেছে, কিন্তু অনেকে আবার রেখে গেছে তাদের আগমনের উল্লেখযোগ্য প্রমাণ। পৃথিবীর চারটি প্রধান নরগোষ্ঠী তথা- ‘নিগ্রীটো, মঙ্গোলীয়, ককেশীয় ও অস্ট্রেলীয়’- এই চারটি নরগোষ্ঠির প্রতিটির কোনো না কোনো শাখার আগমন বাংলায় ঘটেছিল। এরা ছিল আর্য পূর্ব জনগোষ্ঠি অর্থাৎ অনার্য।
বাংলায় আগমনকারী আদিম যুগের এসব জনগোষ্ঠিকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যায়। ১)নেগ্রিটো ২)অস্ট্রিক ৩)দ্রাবিড় ৪)ভোটচীনীয় বা মঙ্গোলীয় ৫)আলপাইন
নেগ্রিটো
নেগ্রিটোরা মূলত আফ্রিকান জনগোষ্ঠি। প্রায় ৭৫ থেকে ৬০ হাজার বৎসর আগে এরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করে এবং খ্রিষ্টপূর্ব ২০ থেকে ৪০ হাজার বৎসরের মধ্যে এরা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ধারণা করা হয়, এই জনগোষ্ঠির দ্বারাই ভারতবর্ষে প্রস্তর যুগের সৃষ্টি হয়। এরা কৃষিকাজ জানত না এবং আগুনের ব্যবহারও জানত না। এরা প্রধানত গুহাবাসী ছিল এবং বড় বড় গাছের নিচে দলবদ্ধভাবে বসবাস করত।
শারীরিকভাবে এরা ছিল খর্বাকায়, কৃষ্ণ কালো, কোঁকড়া চুল এবং চ্যাপ্টা নাকের অধিকারী। আফ্রিকার নিগ্রোজাতি থেকে উদ্ভুত নেগ্রিটো মানুষের অস্তিত্ব ভারতবর্ষে আজ প্রায় বিরল। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, কোচিন, ত্রিবাঙ্কুর ও বিহারের রাজমহল পার্বত্য অঞ্চলে এবং আসামের কোনো কোনো অঞ্চলে এই গোষ্ঠীর কিছু মানুষ এখনো দেখা যায়। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠিদের মধ্যে সাঁওতাল ও মুন্ডা জনগোষ্ঠির পূর্বপুরুষ হিসেবে নেগ্রিটোদেরকে বিবেচনা করা হয়। এরাই মূলত বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রথম স্তর।
অস্ট্রিক
প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার বছর পূর্বে ইন্দোচীন থেকে অস্ট্রিক জাতি বাংলায় প্রবেশ করে এবং নেগ্রিটোদেরকে পরাজিত করে। যে সকল জাতি অস্ট্রেলিয়া বা তার আশেপাশে থেকে এসেছে তাদেরকে অস্ট্রিক জাতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এদেরকে নিষাদ জাতিও বলা হয়। এরা প্রায় ৫০০০ বছর পূর্বে ইন্দোচীন থেকে আসাম হয়ে বাংলায় আসে। ইন্দোচীন অঞ্চল বর্তমানে ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়া নিয়ে গঠিত। তাদের ভাষা ছিল অস্ট্রিক এবং অস্ট্রিক ভাষার আদি রূপ ছিল মুন্ডা বা মুন্ডারী। বর্তমানে সাঁওতাল, ভীম, জুয়াং নৃগোষ্ঠি এ ভাষায় কথা বলে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক অস্ট্রিকদেরকে এ অঞ্চলের প্রাচীনতম বাসিন্দা বলে অভিহিত করেন।
দ্রাবিড়
অস্টিকদের থাকা অবস্থায় অথবা তাদের পরবর্তীতে ৪০০০ কিংবা ৫০০০ বছর পূর্বে অন্য একটি জাতি বাংলায় এসেছে যাদেরকে দ্রাবিড় জাতি বলা হয়। দ্রাবিড় জাতি কোথা থেকে এসেছে-এ নিয়ে দুটো মত রয়েছে। একদল পন্ডিত মনে করেন- দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে ভারতবর্ষে এসেছে। আরেক দল পন্ডিত মনে করেন- দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী ভারতবর্ষের আদি অধিবাসী। তবে প্রথম মতটি বেশি গ্রহণযোগ্য। কারণ- দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর বর্তমান বাসস্থান দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন সমাধিক্ষেত্রে যে কঙ্কাল পাওয়া গেছে তার সঙ্গে ভূমধ্যসাগরীয় নরগোষ্ঠীর ডিএনএর মিল রয়েছে
সভ্যতায় তারা উন্নত ছিল বলে অস্ট্রিক জাতির উপর তারা প্রভাব বিস্তার করেছিল। দ্রাবিড় জাতিকে সিন্ধু সভ্যতা তথা মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার মূল স্রষ্টা বলেও মনে করা হয়। অস্ট্রিক, দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রণে বাঙালি জাতির আবির্ভাব ঘটে। বর্তমানে তেলেগু, তামিল, কর্ণাটক, ও মালায়ালাম ভাষাগোষ্ঠীর মানুষদেরকে মূল দ্রাবিড় গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভারতের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কা ও নেপালে এই দ্রাবিড় জনগোষ্ঠির মানুষ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের দ্রাবিড়রা অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সাথে মিশে যাওয়ায় বিশুদ্ধ দ্রাবিড় বাংলাদেশে খুব একটা দেখা যায় না। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়াতেও দ্রাবিড়দের একটি বড় অংশ বসবাস করে।
মঙ্গোলীয়
দ্রাবিড়দের কিছুকাল পরে চীনের উত্তরাঞ্চল ও মঙ্গোলিয়া থেকে বাংলায় আগমন ঘটে মঙ্গোলীয়দের। এদের মাথার আকৃতি প্রধানত চওড়া এবং গোল। মুখের আকৃতি চওড়া ও খর্ব, নাক মোটা এবং চ্যাপটা। এদের গায়ের রং বাদামি বা হলুদ ধরনের, ঠোঁট মাঝারি ধরনের, চোখ কালো বাদামি। মঙ্গোলীয়দের চোখের পাতায় একটি ভাঁজ থাকে যাকে এপিক্যানথিক ফোল্ড বা নৃতাত্বিক ভাঁজ বলে। মঙ্গোলীয়রা উচ্চতায় মাঝারি এবং তাদের শারীরিক গঠন খুব সুঠাম ও শক্তিশালী। বর্তমানে চাকমা, মারমা এবং মনিপুরীরা মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর বংশধর।
ভোটচীনীয়দের পরে বাংলায় আগমন ঘটে আলপাইন নামের আরেকটি জনগোষ্ঠির। এদেরকে মূলত আর্য জনগোষ্ঠীর একটি শাখা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এরা এসেছিল আলপস পর্বতমালা এবং পামীর মালভূমি থেকে। জাতিগতভাবে এরা বৈদিক আর্য না হলেও আর্য ভাষায় কথা বলত। আর্যদের আগমনের পূর্বে এরা বাংলায় বসতি স্থাপন করে। যেহেতু এরা আর্যদের আগে এসেছে তাই এদেরকে আর্য জনগোষ্ঠীর একটি অগ্রগামী শাখা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
খ্রিষ্টপূর্ব ১৮০০ অব্দের দিকে ইরানের পশ্চিমাঞ্চল থেকে আর্যরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করা গুরু করে। আর্যরা আমাদের দেশে এসেছিল আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে বা যীশু খ্রীষ্টের জন্মেরও দেড় থেকে দুহাজার বছর আগে। এরা দেখতে ছিল গৌরবর্ণ এবং দীর্ঘদেহী। তারা ধাতব অস্ত্রের ব্যবহার জানত এবং ঘোড়ায় টানা দ্রুতগামী রথে চেপে দূর দূরান্তে যেতে পারত। শুধু তাই নয় শত্রুর আক্রমণ থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য এরা ধাতব বর্ম পরিধান করত এবং মাথায় শিরোস্ত্রানও পরত। আর্যরা তাদের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করেছিল মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সেনদের শাসন আমলের মাধ্যমে। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলে আর্যদের শাসন আমল।
বাঙালি জাতিসত্ত্বা গঠনের ঐতিহাসিক যুগ শুরু হয় মূলত গুপ্তযুগে এবং এ যুগেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলিকে নিয়ে গঠিত হয় বিশাল রাজ্য। যেমন পূর্ব ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের বঙ্গরাজ্য ও উত্তরাঞ্চলের গৌড় রাজ্য। এ সময়ে রাজা শশাঙ্ক তাঁর দক্ষ বাসনের মাধ্যমে বাংলা ও বাঙালিকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। তখন থেকেই বাঙালি জাতিসত্ত্বার যাত্রা শুরু এবং পাল ও সেন আমলে এসে সে জাতিসত্ত্বা আরো বিকশিত হয়ে বাঙালি জাতির শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি হয়।
১২০৪ সালে তুর্কি আফগান সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির মাধ্যমে ভারতবর্ষে শুরু হয় মুসলিম শাসন। প্রতিষ্ঠিত হয় সুলতানি শাসনব্যবস্থা। শতকের পর শতক ব্যাপী বিকশিত হয়ে সুলতানি আমলে এসে আমরা পাই বাঙালা, বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষা। এ পর্বে বাঙালি জাতি ও সংস্কৃতিতে যুক্ত হয় নতুন নৃগোষ্ঠী তুর্কি-আফগান এবং মধ্য এশীয় নৃগোষ্ঠির উপাদান।
সরকারি পর্যায়ে বাংলা ভাষার পাশাপাশি প্রবর্তিত হয় ফার্সি ভাষা। এরপর মুঘল আমলে বাঙালির উপাদানগুলো আরো সমৃদ্ধি লাভ করে। বাঙালি সংস্কৃতিতে যুক্ত হয় বাংলা সাল, বাংলা মাসের নাম, পহেলা বৈশাখ ও নববর্ষের বিভিন্ন আয়োজন। সুফিবাদ, বৈষ্ণববাদ ও বিভিন্ন লোকাচার বাঙালিকে অসাম্প্রদায়িক করার পাশাপশি বাঙালি জীবনকে বর্ণাঢ্য করে তোলে।
এরপর হাজার
বছর ধরে পর্তুগিজ, ডাচ, ব্রিটিশসহ নানা জাতির মিলনমেলা ঘটেছিল এই বাংলায়। কেউ এসেছিল
বাংলা দখল করতে আবার কেউ এসেছিল বাণিজ্য করতে, কেউ এসেছিল ধর্ম প্রচার করতে, কেউ চাকরি
করতে। স্থানীয় অনেক মানুষের সঙ্গে এদের বৈবাহিক সম্পর্ক হয়। এভাবে নানা রক্তের মিশ্রণ
ঘটে বাঙালির মধ্যে। এই দীর্ঘ মিশ্রণের মধ্য দিয়েই সংকর জাতির গর্বিত বাঙালি নিজের পরিচয়
স্পষ্ট করে।
বাঙালি জাতির ইতিহাস আজ নানা কারণে সমাদৃত। সাহিত্য,
চিন্তা-ভাবনা, সংস্কৃতি ও সমৃদ্ধির বিভিন্ন দিক বিবেচনায় বাঙালি জাতি ইউরোপের যে কোনো
জাতির সমকক্ষ। বাঙালির অগ্রগতি অব্যাহত থাকুক চিরকাল।
মোবাইল নং- ৯৯৩২৩১২২৩৫
কোন মন্তব্য নেই
ok