গদ্যকার ও প্রাবন্ধিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় :ড. নীলোৎপল জানা
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় |
গদ্যকার ও প্রাবন্ধিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রধান পরিচয় তিনি
ঔপন্যাসিক। পাশাপাশি উনিশ শতকের একজন অগ্রণী চিন্তাবিদ হিসেবে তিনি বহু প্রবন্ধ লিখেছেন
লঘুভঙ্গিতে এবং অবশ্যই প্রবন্ধের প্রথাগত গাম্ভীর্যে। শুধু সংখ্যাগত বিচারে নয়, বিষয়বৈচিত্র্যে
এবং মননশীলতায় বঙ্কিম-প্রবন্ধ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত 'সংবাদ প্রভাকর'
ও 'সংবাদ সাধুরঞ্জনে' পদ্য ও গদ্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র সাহিত্যজগতে প্রবেশ
করেন। উপন্যাস এবং প্রবন্ধ দুক্ষেত্রেই শুরুটা করেছিলেন ইংরেজিতে। বেশ কতকগুলি প্রবন্ধ
লেখেন ইংরেজিতে। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় 'বঙ্গদর্শন'
পত্রিকা। মূলত এই পত্রিকা সম্পাদনা সূত্রে বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা ভাষায় প্রবন্ধ লেখা শুরু
করেন এবং অচিরে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলার প্রধান প্রাবন্ধিক।
বঙ্কিমচন্দ্রের বাংলা প্রবন্ধ গ্রন্থের তালিকায়
রয়েছে-
'লোকরহস্য'
(১৮৭৪), 'বিজ্ঞান রহস্য' (১৮৭৫),
'কমলাকান্তের
দপ্তর' (১৮৭৫), 'বিবিধ সমালোচনা'
(১৮৭৬),
'রায় দীনবন্ধু মিত্র বাহাদুরের জীবনী' (১৮৭৭),
'কবিতা পুস্তক'
(১৮৭৮), 'সাম্য' (১৮৭৯), 'প্রবন্ধ-পুস্তক'
(১৮৭৯),
'দেশীয় নব্য সমাজের স্থিতি ও গতি' (১৮৮৫),
'কৃষ্ণচরিত্র'-
প্রথম ভাগ (১৮৮৭), 'ধর্মতত্ত্ব'- প্রথম ভাগ (১৮৮৮),
'বিবিধ প্রবন্ধ-দ্বিতীয়
ভাগ (১৮৯২), 'শ্রীমদ্ভাগবদগীতা' (১৯০২) প্রভৃতি।
'সহজ রচনা শিক্ষা' এবং 'সহজ ইংরাজী শিক্ষা' নামে পাঠ্যপুস্তক রচনা করেছিলেন। বাংলা ভাষার সাহিত্যিকদের নিয়ে লিখেছিলেন কয়েকটি প্রবন্ধ। যেমন- 'রায় দীনবন্ধু মিত্র বাহাদুরের জীবনী', 'বাংলা সাহিত্যে প্যারীচাঁদ মিত্রের স্থান', 'সঞ্জীবচন্দ্রের সংক্ষিপ্ত জীবনী' ইত্যাদি।
বঙ্কিমচন্দ্রের
প্রবন্ধগুলিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-তন্ময় প্রবন্ধ আর মন্ময় প্রবন্ধ।
তন্ময় প্রবন্ধের মধ্যে
পড়ে 'বিজ্ঞান রহস্য'
(১৮৭৫), 'বিবিধ সমালোচনা' (১৮৭৬), 'সাম্য' (১৮৭৯), 'প্রবন্ধ-পুস্তক' (১৮৭৯), 'কৃষ্ণচরিত্র',
'ধর্মতত্ত্ব' ইত্যাদি।
আর 'লোকরহস্য', 'কমলাকান্তের দপ্তর' পড়ে মন্ময় প্রবন্ধের পর্যায়ে। বঙ্কিমের প্রায় সমস্ত প্রবন্ধ প্রকাশিত তিনটি পত্রিকাতে।
পত্রিকাগুলি হল 'বঙ্গদর্শন', 'প্রচার' এবং 'ভ্রমর'। বঙ্কিমের শ্রেষ্ঠ
প্রবন্ধগুলি রচিত হয় ১৮৭২ থেকে ১৮৯২ এর মধ্যে। বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব,
সাহিত্য-সমালোচনা, মনস্তত্ত্ব ইতিহাস ভাষাতত্ত্ব জ্ঞানের প্রায় প্রতি শাখা অবলম্বনেই
রচিত হয় বঙ্কিমের প্রবন্ধগুলি।
বঙ্কিমের প্রথম বিষয়মুখী প্রবন্ধ সংকলন 'বিজ্ঞান
রহস্য'। 'বিজ্ঞান রহস্য'র মাধ্যমে তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন 'mystery of science' অর্থাৎ
বিজ্ঞানের প্রাথমিক কথা। এটি তাঁর কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা গ্রন্থ নয়, ইংরেজি লেখকদের
থেকে তথ্য উপাদান সংগ্রহ করে তিনি জটিল বিজ্ঞানের তত্ত্বকে বাঙালি পাঠক-পাঠিকা এবং
স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য সহজ সরল ভাষায় উপস্থাপিত করেছেন। উনিশ শতকের বাংলায় নব্য
হিন্দুত্বের যে জোয়ার এসেছিল তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। কিন্তু সেই জোয়ারে
তিনি ভেসে যাননি। মুক্তবুদ্ধির আলোয় তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন হিন্দুধর্ম এবং তার অন্যতম
প্রধান পুরুষ কৃষ্ণচরিত্রকে। 'ধর্মতত্ত্ব' গ্রন্থে তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন প্রকৃত মানব
ধর্মের স্বরূপ।
সমালোচক হিসেবেও বঙ্কিমের কৃতিত্ব অবিসংবাদিত।
'বিদ্যাপতি ও জয়দেব', 'শকুন্তলা মিরন্দা এবং দেসদিমোনা', 'উত্তরচরিত' প্রভৃতির মধ্য
দিয়ে অন্য বঙ্কিমকে খুঁজে পাওয়া যায়। 'শকুন্তলা, মিরন্দা
এবং দেসদিমোনা' প্রবন্ধটি বঙ্কিমের মননশীলতার প্রতীক। শকুন্তলা, মিরন্দা ও দেসদিমোনা
প্রত্যেকেই তাদের আপন গুণাবলীতে পরিপূর্ণ 'দেশভেদ বা কালভেদে কেবল বাহ্যভেদ হয় মাত্র;
মনুষ্য হৃদয় সরল দেশেই সকল কালেই ভিতরে মনুষ্য হৃদয়ই থাকে। শকুন্তলা, মিরন্দা ও দেসদিমোনা
নির্দিষ্ট গণ্ডি ও কালের ঊর্ধ্বে। তারা সর্বযুগের সর্বকালের। এই তিন নারীর অনুভব-অভিজ্ঞতা
বিবরণের মধ্য দিয়ে বঙ্কিম সমাজের এক বিশেষ অধ্যায়কে সমকাল এবং উত্তরকালের পাঠকের সামনে
হাজির করতে চেয়েছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে সমালোচনা ও তুলনামূলক
বিচার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যে ছিল দেশ ও দেশবাসীর প্রতি
গভীর প্রীতি। ফরাসি বিপ্লবের বাণী এবং নিজের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন
দেশ ও দেশবাসীকে। লেখেন 'সাম্য'-এর মতো বৈপ্লবিক পুস্তিকা। সম্ভবত বঙ্কিমচন্দ্রই বাংলা
সাহিত্যে সাম্যবাদের প্রথম প্রচারক। সর্ব মানবের কল্যাণকারী রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার
যেরূপ বঙ্কিমের কাম্য ছিল, 'সাম্য' তারই ভাষারূপ। বাঙালি তিনি করতে চেয়েছিলেন
ইতিহাসসচেতন ও দেশপ্রেমিক করতে। তিনি লিখেছিলেন, "বাঙ্গালীর ইতিহাস চাই। নহিলে
বাঙ্গালী কখন মানুষ হইবে না।" লিখেছিলেন 'বাঙ্গালীর উৎপত্তি' এর মতো নৃতত্ত্বভিত্তিক
প্রবন্ধ। 'জ্ঞান', 'সাংখ্যদর্শন', 'মনুষ্যত্ব কি' ইত্যাদি প্রবন্ধে করেছেন দর্শনশাস্ত্রের
সহজ উপস্থাপনা।
মন্ময় প্রবন্ধে রচয়িতার মনোভঙ্গি ও আবেগ প্রাধান্য
পায়। অনেক সময় এধরনের প্রবন্ধে কাহিনির আভাস থাকে। 'লোকরহস্য' এবং 'কমলাকান্তের দপ্তর'
এই জাতের রচনা। 'লোকরহস্য' সংকলনের প্রবন্ধগুলিতে মার্জিত ব্যঙ্গ আর হাল্কা হাসির আবরণে
বঙ্কিমচন্দ্রের সমাজভাবনা ও দেশভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। বাঙালি চরিত্রের ত্রুটি দূর করার
বাসনাই অপরূপ হয়ে উঠেছে 'কমলাকান্তের দপ্তর'-এর রচনাগুলিতে।
এবার আলোচনায় আসা যেতে পারে বঙ্কিমী ভাষা প্রসঙ্গে।
আদর্শ বাংলা গদ্য ভাষা কীরকম হওয়া উচিত তা নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র ভেবেছিলেন। ভাষার প্রতি
তিনি ছিলেন উদার, শব্দের বাহুল্য বাংলা ভাষার সরলতাকে কীভাবে হরণ করছে তা তিনি স্বীকার
করেছিলেন। তিনি বাংলা গদ্য ভাষাকে যে স্তর থেকে পেয়েছিলেন তার উন্নতি সাধন করার আপ্রাণ
প্রচেষ্টা চালান। পণ্ডিতি ভাষা ও ইংরেজি তর্জমা করা বাংলার সমস্যাগুলোকে তিনি তুলে
ধরার চেষ্টা করেন। 'বাঙ্গালা ভাষা' প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের স্পষ্ট নিদান- "বিষয়
অনুসারেই রচনার ভাষার উচ্চতা বা সামান্যতা নির্ধারিত হওয়া উচিত। রচনার প্রধান গুণ এবং
প্রথম প্রয়োজন সরলতা এবং পড়িবামাত্র যাহার অর্থ বুঝা যায়, অর্থগৌরব থাকিলে তাহাই সর্বোকৃষ্ট
রচনা। তাহার পর ভাষার সৌন্দর্য, সরলতা এবং স্পষ্টতার সহিত সৌন্দর্য মিশাইতে হইবে।"
বস্তুত বাংলা প্রবন্ধ-সাহিত্যের যে সমুন্নত আদর্শ বঙ্কিমচন্দ্র স্থাপন করেছিলেন, তা
এই সাহিত্যশাখার ভবিষ্যৎ উন্নতির প্রধান সোপান হয়ে দাঁড়ায়।
-----------------------
যারা পেজটি দেখছেন বা ফলো করছেন অবশ্যই নাম লিখে কমেন্ট দিন।
কোন মন্তব্য নেই
ok