Translate

বিবেকানন্দের প্রবন্ধ সাহিত্য: ড. নীলোৎপল জানা

 

বিবেকানন্দের প্রবন্ধ সাহিত্য

ড. নীলোৎপল জানা

  বিবেকানন্দ শুধু সন্ন্যাসী হিসেবে নয়, বাংলা সাহিত্যের একজন বিখ্যাত লেখক হিসাবেও প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছেন। বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত, ফরাসি প্রভৃতি ভাষায় তিনি পন্ডিত ছিলেন। প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দর্শন বেদ- উপনিষদ পুরাণ শাস্ত্রে তাঁর অধিকার ছিল যথেষ্ট। ইংরেজি, বাংলা, সংস্কৃত ভাষায় তিনি অনেকগুলো স্মরণীয় গ্রন্থ রচনা করেছেন। বিবেকানন্দ মনে করেছিলেন সাধুরীতির গদ্য সাধারণ মানুষের বাহন হতে পারে না। মানুষ সর্বত্র যে ভাষায় কথা বলে, সেই ভাষাকেই তিনি বাংলা গদ্যের বাহন করতে চেয়েছিলেন

  মানুষের মুখের ভাষা জীবন্ত ও প্রাণশক্তিতে ভরপুর। সেই ভাষাই চিন্তা এবং পাণ্ডিত্য প্রকাশের পক্ষে উপযোগী বলে তিনি মনে করতেন। 'বাংলা ভাষা প্রবন্ধে বলেছেন -  প্রাকৃতিক নিয়মে যেটি বলবান হচ্ছে এবং ছড়িয়ে পড়ছে, সেইটিই নিতে হবে। অর্থাৎ কলকেতার ভাষা। পূর্ব-পশ্চিম, যেদিক হতেই আসুক না একবার কলকেতার হাওয়া খেলেই দেখছি সেই ভাষাই লোকে কয়। …..চট্টগ্রাম হতে বৈদ্যনাথ পর্যন্ত ওই কলকেতার ভাষাই চলবে। বিবেকানন্দ জানিয়েছেন-- কোনো জাতি তার স্বাভাবিক প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেললে তার চিন্তাভাবনা লুপ্ত হয়। জাতীয় জীবনের পরিচয়কে বলিষ্ট করে তার ভাষা। চলিত ভাষাকেই বিবেকানন্দ বাঙালি জাতির স্বাস্থ্য বলে মনে করেছেন। তিনি প্রশ্ন রেখেছেন-- ‘'চলিত ভাষায় কী আর শিল্প নৈপুণ্য হয় না ? স্বাভাবিক ভাষা ছেড়ে একটা অস্বাভাবিক ভাষা তৈরি করে কী হবে ? স্বাভাবিক যে ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করি, যে ভাষায় ক্রোধ, দুঃখ, ভালোবাসা ইত্যাদি জানাই তার থেকে উপযুক্ত ভাষা আর কী হতে পারে?’’  চলিত বা কথ্য গদ্যই হল বিবেকানন্দের গদ্যের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য।

  বিবেকানন্দের বাংলা গ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম হল-১) 'প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য' (১৯০২), ২)'বর্তমান ভারত' (১৯০৫), ৩)'পরিব্রাজক' (১৯০৫), ৪)'ভাববার কথা' (১৯০৭),এছাড়া অনেক চিঠিপত্র লিখেছেন

  সেইসব চিঠিপত্র 'পত্রাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলায় "উদ্বোধন" এবং ইংরেজিতে 'প্রবন্ধ ভারত' পত্রিকা তিনি বের করেন। বাংলা অপেক্ষা ইংরেজিতে তিনি বেশি রচনা লিখেছেন 


   প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য :- প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য' গ্রন্থে আছে উভয়ের সভ্যতা ও সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্রনাথের 'পূর্ব ও পশ্চিম' প্রবন্ধের বিষয়ের সঙ্গে 'প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য'র বিষয়ের অনেকাংশে মিল লক্ষ্য করা যায়। পরাধীন ভারতবাসীর পরিচয় দিয়েছেন এই

  পরিব্রাজক :- 'পরিব্রাজক ভ্রমণ কাহিনির ছাঁচে লেখা। প্রাচীন ভারতবর্ষের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও সৌন্দর্যকে আধুনিক ভারতবর্ষে বিবেকানন্দ ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন। বাংলার প্রাকৃতিক রূপ যাতে হারিয়ে না যায় সেজন্য সকলকে উদ্যোগী হতে বলেছেন। এক জায়গায় বলেছেন, 'এই সমস্ত শস্য-শ্যামলা সহস্র স্রোতস্বতী মাল্যধারিণী বাংলাদেশের একটি রূপ আছে। সেরূপ কিছু মলয়ালামে, আর কিছু কাশ্মীরে

  বর্তমান ভারত:- স্বামী বিবেকানন্দের 'বর্তমান ভারত (১৯০৫) গ্রন্থের প্রবন্ধগুলো ধারাবাহিকভাবে পাক্ষিক ‘উদ্বোধন' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে 'উদ্বোধন' পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয়। গ্রন্থের মোট ১৪টি রচনার কোনোটিই স্বতন্ত্র প্রবন্ধকারে রচিত হয়নি। একটি রচনার সঙ্গে অন্য রচনার নিবিড় যোগ আছে।

  ভারতবর্ষের ইতিহাসের বিভিন্ন দিক এই গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে। পুরোহিতের শক্তি, রাজা ও প্রজার শক্তি, স্বায়ত্তশাসন, বৌদ্ধ বিপ্লব এবং তার পরিণতি, মুসলমান অধিকার, ইংরেজ অধিকার, পুরোহিত শক্তি, ক্ষত্রিয় শক্তি, বৈশ্য শক্তি, বৈশ্য শক্তির অভ্যুদয়, ব্যক্তি ও সমষ্টি জীবন প্রভৃতি বিষয়ক রচনা এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। এই গ্রন্থের শুদ্রজাগরণ' প্রবন্ধে ভারতবর্ষের শূদ্ররা কেমন পশুর মতো জীবন অতিবাহিত করছেন, সেকথা বলেছেন। ভারতবর্ষের বাইরে লেখক চোখ ফেলে দেখেছেন, কোথাও কোথাও শুদ্ররা জেগে উঠলেও বিদ্যা, দেশপ্রেম ও একতার অভাবে তারা এখনও দুর্বল হয়ে আছে। শুদ্র সমাজে কোনো ব্যক্তিত্বপূর্ণ অসাধারণ গুণসম্পন্ন মানুষের আবির্ভাব ঘটলে অভিজাত সমাজ সঙ্গে-সঙ্গে তাঁকে উপাধি এবং অন্যান্য যাবতীয় সুযোগ সুবিধা দিয়ে নিজেদের দিকে টেনে নেন। ফলে সেই ব্যক্তি নিজের শূদ্র সমাজের কাজে লাগেনা, কাজে লাগে অভিজাত সমাজের। এহেন অবস্থার মধ্যেও শুদ্রসমাজের জয় যে অবশ্যম্ভাবী, একথা বিবেকানন্দ প্রজ্ঞা দৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করেছেন

  ভাববার কথা:- বিবেকানন্দের 'ভাববার কথা' যেন বক্তৃতাধর্মী রচনার সংকলন। স্বদেশ প্রেম, পরিহাস প্রবণতা, দার্শনিকতা গ্রন্থটিকে বিশেষ মূল্য প্রদান করেছে। 'বর্তমান ভারতে' 'ভাবকার কথা' গ্রন্থের অনেক    প্রবন্ধতেই চলিত গদ্যরীতিকে গুরুত্ব দিয়েছেন, এই গ্রন্থের 'বাঙ্গালা ভাষা' প্রবন্ধে, সাধু ও চলিত ভাষার মধ্যে চলিত ভাষাকে কেন সাহিত্যের মাধ্যম করা উচিত, স্বামীজী তা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেছেন। স্বামীজীর চলিত ভাষার সপ্রাণ স্পন্দন কানে বিশেষভাবে বাজে। তিনি বলেছেন 'বাঙ্গালা দেশের স্থানে স্থানে রকমারি ভাষা, কোনটি গ্রহণ করব ? প্রাকৃতিক নিয়মে যেটি বলবান হচ্ছে এবং ছড়িয়ে পড়ছে, সেইটিই নিতে হবে, অর্থাৎ কলকেতার ভাষা


   চলিত গদ্যরীতির বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে আলোকপাত করেছেন বিবেকানন্দ তাঁর 'বাঙ্গালা 'ভাষা' প্রবন্ধে। প্রবন্ধটি 'ভাববার কথা' (১৯০৭) গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। বিবেকানন্দের মনে হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে বাংলার লিখিত গদ্যে যে সাধু রীতির প্রচলন আছে তা একঘেয়েমিতে পূর্ণ। বাংলা ভাষার প্রাণের স্পন্দন আছে চলিত রীতির গদ্যে। রবীন্দ্রনাথের আগে বিবেকানন্দ বাংলা গদ্যে চলিত ভাষার প্রবর্তন করেন। বিবেকানন্দ কলকাতা এবং তৎসংলগ্ন এলাকার মানুষেরা যে ভাষায় কথা বলেন সেই ভাষাতেই সাহিত্যের ভাষা হিসাবে গ্রহণ করার পক্ষপাতী। মানুষের মুখে ব্যবহৃত ভাষা প্রাণশক্তিতে পূর্ণ। সেই ভাষা যেহেতু জীবনের সঙ্গে যুক্ত, তাই সেই ভাষাকেই বিবেকানন্দ সাহিত্যের ভাষা হিসাবে ব্যবহার করতে

  অনুবাদমূলক রচনা : বিবেকানন্দর বেশির ভাগ রচনা ইংরেজিতে লেখা। পরবর্তীকালে সেইসব রচনা অনূদিত হয়। তাঁর অনুবাদমূলক রচনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল 'কর্মযোগ', 'রাজযোগ', 'জ্ঞানযোগ', 'জ্ঞানযোগ প্রসঙ্গে', 'ভক্তিযোগ', 'ভক্তিপ্রসঙ্গে', 'গীতাপ্রসঙ্গ', ‘চিকাগো বক্তৃতা', 'কর্মযোগ প্রসঙ্গ', 'পাতঞ্জল যোগসূত্র', 'ধর্ম দর্শণ', 'ধর্মবিজ্ঞান', 'যোগ ও মনোবিজ্ঞান', 'ভক্তিরহস্য', 'মহাপুরুষ প্রসঙ্গ', 'ভারতপ্রসঙ্গে, “বেদাস্তের আলোকো ইত্যাদি। ‘বীরবাণী' তাঁর কবিতাগ্রন্থ 

রচনা বৈশিষ্ট্য :

  স্বামী বিবেকানন্দের রচনার গদ্যশৈলীর বৈশিষ্ট্যগুলো হল-

১। বিবেকানন্দ মুখের ভাষাকে সাহিত্যের গদ্যে মর্যাদার সঙ্গে বসাতে চেয়েছেন। 'বর্তমান ভারত সাধু গদ্যে রচিত হলেও, বিবেকানন্দ চলিত গদ্যকেই আদর্শ গদ্য বলে মনে করেছেন

২। অধ্যাপক অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, 'বিবেকানন্দের ভাষায় হুতোমের মতোই দুঃসাহস ছিল, কিন্তু অশালীনতার নামগন্ধও ছিল না; প্রমথ চৌধুরীর মতো রসিকতা ছিল, কিন্তু বুদ্ধির মার প্যাচ ছিল না। আবার কোথাও কোথাও তাঁর চলিত ভাষায় অপূর্ব ধ্বনিগম্ভীর ক্লাসিক ঝঙ্কার সঞ্চারিত হয়েছে

৩। ড. শশিভূষণ দাশগুপ্ত বলেছেন, 'সাহিত্যে তিনি সর্বদাই কথ্যভাষা ও কথ্যরীতির পক্ষপাতী ছিলেন, কায়ক্লেশে ভাষাকে 'সাধু' করিয়া সাজাইবার তিনি মোটেই পক্ষপাতী ছিলেন না, কথ্যভাষা ও রীতিকেই তিনি এমন করিয়া ভাঙিয়া টিপিয়া গড়িয়া যাইতে চাহিয়াছিলেন যেন সে সবজাতীয় মনোভাব প্রকাশেরই উপযোগী হয়। এই বিশিষ্ট ভঙ্গি গ্রহণ করার ফলে বিবেকানন্দের লেখার ভিতর দিয়া তাঁহাকে স্থানে স্থানে স্পষ্ট কথা বলিতে শোনা যায়। ভাষার ওপরে অসাধারণ দখল না থাকিলে এই রীতিটিকে এইভাবে জমাইয়া তোলা সহজ হইত না।

৪। বিবেকানন্দের বাঙ্গালা গদ্যের শব্দ, ভাষা, বিষয় দ্রুত ছুটেছে। প্রমথনাথ বিশী বলেছেন, “এ হচ্ছে'A young man in a hurry'-র ভাষা

৫। বিবেকানন্দের গদ্য তাঁর ব্যক্তি স্বভাবেরই প্রতিরূপ হয়েছে। সাধু কিম্বা চলিত, উভয় শ্রেণির রচনাতেই এই বিষয়টা প্রত্যক্ষ করা যায়। অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসু বলেছেন, 'স্বামীজীর রচনারীতির মধ্যে আশ্চর্য সরস গভীরতা ছিল, যা তাঁর ব্যক্তিত্বেরই রূপ

৬। বিবেকানন্দের রচনার মধ্যে বক্তৃতা ভঙ্গিটার স্বভাব লক্ষ্য করা যায়। ভাষার শক্তি বৃদ্ধি করার ওপর বিবেকানন্দ বিশেষভাবে দৃষ্টি দিয়েছিলেন

৭। বিবেকানন্দের গদ্য ভাষা তেজোদীপ্ত কর্মনিষ্ঠতার ভাষা। যে ভাষা প্রাঞ্জল এবং গতিময়।

  "স্বামীজীর বাংলা রচনা পরিমাণে স্বপ্ন হলেও গুণগত উৎকর্ষে তা ঋজু, কঠিন ও সংযত এবং প্রসন্ন মনের সহাস্য রসোত্তীর্ণতায় বাংলা গদ্যের ইতিহাসে একটি বিস্ময়।" 

"স্বামীজীর বাংলা রচনা পরিমাণে স্বপ্ন হলেও গুণগত উৎকর্ষে তা ঋজু, কঠিন ও সংযত এবং প্রসন্ন মনের সহাস্য রসোত্তীর্ণতায় বাংলা গদ্যের ইতিহাসে একটি বিস্ময়।" —(ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় : স্বামী বিবেকানন্দ ও বাংলা গদ্য)

        

                       Vivekananda Rock Memorial


 











 


কোন মন্তব্য নেই

ok

4x6 থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.