Translate

বাংলা গদ্যের বিকাশের ইতিহাসে প্যারীচাঁদ মিত্র :ড. নীলোৎপল জানা

 

প্যারীচাঁদ মিত্র


বাংলা গদ্যের বিকাশের ইতিহাসে প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-১৮৮৩)

   উনিশ শতকে বাংলা গদ্যকারদের মধ্যে বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন 'বাঙ্গালা সাহিত্যে প্যারীচাঁদ মিত্রের স্থান অতি উচ্চ। তিনি বাঙ্গালা সাহিত্যের এবং বাঙ্গালা গদ্যের একজন প্রধান সংস্কারক'। বাংলা সাহিত্যে প্যারীচাঁদ মিত্র অমর হয়ে আছেন তাঁর 'আলালের ঘরের দুলাল' (১৮৫৮) রচনার জন্য। এছাড়া তিনি লিখেছেন আরও বহু গ্রন্থ। প্যারীচাঁদ মিত্রের অন্যান্য রচনাগুলির মধ্যে উল্লেখ্য হল 'মদ খাওয়া বড় দায়, জাত থাকার কি উপায়' (১৮৫৯), 'রামারঞ্জিকা' (১৮৬০), 'কৃষিপাঠ' (১৮৬১), 'যৎকিঞ্চিৎ' (১৮৬৫), 'অভেদী' (১৮৭১), 'ডেভিড হেয়ারের জীবনচরিত' (১৮৭৮), 'এতদ্দেশীয় স্ত্রী লাকদিগের পূর্বাবস্থা' (১৮৭৯), 'বামাতোষিণী' (১৮৮১)র মত গ্রন্থাবলি।

    নবজাগরণের প্রারম্ভিক লগ্নে প্যারীচাঁদ মিত্রের জন্ম। যে দেশকালে বেড়ে উঠেছিলেন, সেখানে দেখেছেন ব্রাহ্মধর্ম আন্দোলন, রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের দাপট পাশাপাশি মানুষের প্রগতিশীল চিন্তা ও উদার মানবতাবাদী দর্শন। এই যুগস্রোতে বাংলা সমাজ যখন ক্ষতবিক্ষত, গতিচঞ্চল সেই সময় প্যারীচাঁদের আবির্ভাব ও তাঁর মানসলোকে উদারতাবাদী চিন্তা নবজাগরণের সদর্থক হিসেবে ক্রিয়াশীল থেকেছে। তাই সমস্ত রকম সামাজিক নিয়ম নীতির বিরুদ্ধে তাঁর তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়। প্যারীচরণ সরকার প্রতিষ্ঠিত বঙ্গীয় মাদক নিবারণী সভার অন্যতম সদস্য ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। মদ্যপানের শোচনীয় পরিস্থিতির কথা তিনি তুলে ধরেছিলেন 'মদ খাওয়া বড় দায়, জাত রাখার কি উপায়' রচনাটির মধ্য দিয়ে। এই সামাজিক নকশার মধ্য দিয়ে ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে তিনি এদেশের মানুষদের সতর্ক করতে চেয়েছিলেন। 'মদ খাওয়া বড় দায়', জাত থাকার কি উপায়' গ্রন্থের মধ্যে দিয়ে সমকালীন সমাজকে তিনি যেভাবে ধরতে চেয়েছিলেন তা হয়তো সে যুগে দাঁড়িয়ে আর কেউই পারেননি।

প্যারীচাঁদ মিত্রের 'আলালের ঘরের দুলাল'ও বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার। প্যারীচাঁদ মিত্র নিজেই এই বইয়ের ভূমিকায় বলেছিলেন 'original novel in Bengali', বাংলায় যাকে উপন্যাস বলা হয়, তাই। যদিও এ নিয়ে বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিকদের মধ্যে নানা বিতর্ক আছে। কেউ একে নকশা কেউ বা অলীক কল্পনা, কেউ বা গল্প বলতে চান। কিন্তু সেইসব বিতর্কের মধ্যে না গিয়ে একটা কথাই বলতে হবে, আলাল সে যুগের সমাজে বিশেষ ছাপ ফেলে যায় প্রধানত তার ভাষার জন্য। আলালের ঘরের দুলাল আলোচনা প্রসঙ্গে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন- "আলালের প্রতিবেশ পূর্ণাঙ্গ ও তথ্যবহুল, জীবনের নানামুখীনতাকে অবলম্বন করিয়া রচিত। ইহাতে কেবল রাস্তাঘাটের কর্মব্যস্ততা ও সজীব চাঞ্চল্য নাই।

    আছে পারিবারিক জীবনের শান্ত ও দৃঢ়মূল কেন্দ্রিকতা।" 'আলালের ঘরের দুলাল' রচনাটির মধ্য দিয়ে গ্রন্থকার নায়ক মতিলালকে যেভাবে উপস্থাপিত করেছেন তার মধ্য দিয়ে সমকালীন জীবনের বহুমাত্রিক সমস্যা শিল্পরূপ পেয়েছে। বাবুরাম বাবুর বড়ো ছেলে মতিলালের চারিত্রিক ভ্রষ্টতা দেখিয়ে দেয় উনিশ শতকের কলকাতা কীভাবে বড়োলোকের সন্তানদের কুসঙ্গে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। মানবধর্ম থেকে বিচ্যুত হলে মানব জীবন কীভাবে বিপন্ন হয় আলালের ঘরের দুলাল তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। প্যারীচাঁদ মিত্র মানুষকে নয় মানুষের ধর্মকে খুঁজে বার করতে চেয়েছিলেন আর এখানেই তাঁর সাফল্য। মধ্যযুগীয় মূল্যবোধ কীভাবে সে সময় মানুষকে গ্রাস করে ফেলেছিল আলালের মধ্যে দিয়ে প্যারীচাঁদ সেই ধনী গৃহস্থ সন্তানদের চারিত্রিক অধঃপতন দেখিয়েছেন বাস্তবোচিত যুক্তি পরম্পরায়। আর এখানেই তাঁর কৃতিত্ব। এছাড়াও এই রচনাটির বিশেষ প্রশংসার দাবিদার কারণ সে যুগে গদ্যে মৌখিক রচনার চেষ্টা তখনো তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি। চলছিল বিদেশি বা সংস্কৃত সাহিত্য থেকে অনুবাদ। সে যুগে দাঁড়িয়ে প্যারীচাঁদ এমন এক সাহিত্য সৃষ্টি করেছিলেন যা ভাষার ভঙ্গিতে মাইলস্টোন হয়ে রয়েছে। প্যারীচাঁদের এই গদ্য সেইসময় বিশেষ ছাপ রেখে যায়, বলা যায় একটা ঘরানার জন্ম দেয়। প্যারীচাঁদ পূর্ববর্তী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত মূলত সংস্কৃত অনুসারী বাংলা গদ্যকে তাঁদের লেখার বাহন করে নিয়েছিলেন। তাঁরা নিজেদের মতো করে একে সহজবোধ্য করেছিলেন কিন্তু তাঁদের নিজেদের রচনায় কখনোই লোকজীবনের কথ্যভাষা ব্যবহৃত হয়নি। প্যারীচাঁদ মিত্রই প্রথম ভাষাকে শৃঙ্খল মুক্ত করেন। বাংলা ভাষাকে সহজবোধ্য করেন পাঠকের দরবারে। এই কারণেই 'আলালের ঘরের দুলাল' বাংলা ভাষায় চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছে। এখানে ব্যবহৃত প্যারীচাঁদের নতুন ভাষা 'আলালী ভাষা' রূপে সমাদৃত থেকেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বঙ্কিমচন্দ্রও এই ভাষাকেই সাহিত্য রচনায় উপযুক্ত ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই স্বীকার করেছেন সেই ভাষার মধ্যে হয়তো গাম্ভীর্য ও বিশুদ্ধতার অভাব আছে, কিন্তু সর্বজনমধ্যে কথিত ও প্রচলিত থাকার জন্য এই ভাষা স্বীকৃত। আর তাই এই ভাষা আলালী ভাষা নামে পরিচিত পায়।

    প্যারীচাঁদের পরবর্তী রচনাগুলোর মধ্য দিয়ে তাঁর আধ্যাত্ম চেতনা ও প্রেততাত্ত্বিক জ্ঞানের প্রকাশ ঘটেছে। অনেকে বলে থাকেন ১৮৬০ সালে প্যারীচাঁদ মিত্রের স্ত্রীর মৃত্যুই তাঁর এই মানস পরিবর্তনের কারণ। এই পর্যায়ে তিনি 'গীতাঙ্কুর' (১৮৬১) 'আধ্যাত্মিক' (১৮৮১) 'অভেদী' (১৮৭১) 'যৎকিঞ্চিৎ' (১৮৬৫) প্রভৃতি রচনাগুলি লেখেন। 'গীতাঙ্কুর' এর গানগুলি আধ্যাত্মিক চেতনার পরিস্ফুরণ। 'যৎকিঞ্চিৎ', 'অভেদী', 'আধ্যাত্মিকা' এই রচনাগুলো ঈশ্বরিক চেতনায় মুখরিত হয়েছে। ঔপনিবেশিক আগ্রাসন উনিশ শতকের সমাজ ব্যবস্থাকে কীভাবে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল, তা যেমন প্যারীচাঁদের ব্যাঙ্গাত্মক লেখাগুলির মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তেমনই নারীসমাজের উন্নতির জন্য তিনি নানাভাবে সহায়তা করেছিলেন। বাঙালি নারী সমাজের পারিবারিক, নৈতিক উৎকর্ষের জন্য তাঁর সম্পাদিত 'মাসিক পত্রিকা' (১৮৫৪) ঐতিহাসিক ভূমিকা নিয়েছিল। উনিশ শতকের ঐতিহাসিক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এই পত্রিকার কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন: 'মাসিক পত্রিকা' প্রকাশে প্যারীচাঁদ এবং তাঁহার সহযোগী রাধানাথ সিকদারের দুঃসাহসিকতা আজও আমাদের বিস্ময়ের বিষয়।... সংস্কৃতের কঠিন শৃঙ্খল হইতে প্যারীচাঁদ বাংলা ভাষাকে মুক্ত করিবার প্রয়াস করিয়াছিলেন বলিয়াই সাধু ও চলিত, এই দুই রীতির সংমিশ্রণে বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা সাহিত্যের বাহনস্বরূপ এই গতিশীল ভাষার সৃষ্টি করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন।"

    বাল্যবিবাহের বিরোধী হয়ে ও বহুবিবাহের বিপক্ষে থেকে প্যারীচাঁদ মিত্র মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন। নারী সমাজের সামগ্রিক উন্নতি। এই কারণে নারী বিষয়ে গ্রন্থ রচনার পথিকৃৎ থেকে তিনি নারী সমাজের উন্নতিকল্পে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। নারী সমাজের প্রতি বিশেষ আগ্রহ জন্যই প্যারীচাঁদ মিত্র 'রামারঞ্জিকা', 'এতদ্দেশীয় স্ত্রীলোকদিগের পূর্বাবস্থা', 'বামাতোষিণী' ইত্যাদি গ্রন্থাবলী লেখেন। স্ত্রীশিক্ষা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে প্যারীচাঁদ মিত্র বলেছিলেন একজন সুশিক্ষিত মা-ই হলেন সন্তানের প্রকৃত শিক্ষক। 'মাসিক পত্রিকা' ছাড়াও মাত্র পনেরো বছর বয়সে দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত সাপ্তাহিক পত্রিকা 'জ্ঞানান্বেষণ'-এর অন্যতম সাংবাদিক ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। সেই অল্প বয়স থেকেই তিনি জ্ঞানান্বেষণ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে লিখতেন। এভাবে প্যারীচাঁদ মিত্র তাঁর নিজের কর্মকাণ্ড বলে বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাসে এক নিজস্ব আসন অধিকার করে গেছেন।

=====================
যারা পেজটি দেখছেন বা ফলো করছেন অবশ্যই কমেন্ট দিন লাইক দিন

কোন মন্তব্য নেই

ok

4x6 থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.