Translate

নাট্যকার অমৃতলাল বসু : ড. নীলোৎপল জানা





নাট্যকার অমৃতলাল বসু

      গিরিশ যুগের নট, নাট্যকার ও নাট্যপ্রযোজক রূপে অমৃতলাল বসুর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গেই স্মরণীয়। নাট্যপ্রযোজক হিসেবে তিনি নাট্যের ব্যবস্থাপনা, নাট্যসংগঠন, নাট্য পরিচালনা প্রভৃতি সব কিছুই করতেন। এ-বিষয়ে তাঁর কৃতিত্বের পরিচয় বহুক্ষেত্রেই পাওয়া গেছে।‘অমৃতম

দিরা'য় একদা তিনি বলেছিলেন-

                                            ‘মোর হাতে হাতখড়ি              গোড়ায় দিয়াছ গড়ি

                                                       তাই আজি নট নামে মোর পরিচয়।' 

অর্থাৎ বিখ্যাত হাস্যরসের অদ্বিতীয় অভিনেতা অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফী ছিলেন তাঁর নাট্যগুরু। অবশ্য তিনি গিরিশচন্দ্রকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন এবং নাট্যগুরুরূপে তাকেও মনে মনে বরণ করে নিয়েছিলেন। পরে অনুশীলন ও অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তিনি নিজ প্রতিভাকে বিকশিত করে তোলেন। গম্ভীর ভাব, করুণরস ও ভক্তিরসের ভূমিকায় তিনি মাঝে মাঝে অভিনয় করেছেন বটে, কিন্তু তাঁর প্রতিভার পূর্ণদীপ্তি ফুটে উঠতো হাস্যরসের চরিত্রে। তাঁর এক আত্মীয় প্যারীমোহন বসুর প্রেরণাতেই তিনি নিজেই বলেছেন, তবে এ বিষয়ে অভিনয় জগতে তাঁর সার্থকতার মূলে আছেন অর্ধেন্দুশেখর।

                             এ অমৃতলাল বসুর বিখ্যাত নাটকগুলিকে বেশ কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যথা---

    (ক) সামাজিক নাটক: 'হীরকচূর্ণ' (১৮৭৫), 'তরুবালা' (১৮৯১), বিমাতা' (১৮৯৩), 'আদর্শবন্ধু' (১৯০০), খাসদখল' (১৯০২), নবযৌবন' (১৯২৪) প্রভৃতি।

    (খ) পৌরাণিক নাটক: হরিশচন্দ্র (১৮৯৯), যাজ্ঞসেনী (১৯২৮) প্রভৃতি।

    (গ) ব্যঙ্গরসাত্মক বিদ্রূপ মূলক প্রহসন: "বিবাহ বিভ্রাট', (১৮৮৪), 'বাবু' (১৮৯৪), "বৌমা' (১৮৯৭), 'গ্রাম্যবিভ্রাট' (১৮৯৮), সাবাশ আটাশ (১৯০০) ইত্যাদি।

    (ঘ) প্রহসনমূলক: চোরের ওপর বাটপাড়ি (২৮৭৬), চাটুজো বাড়ুজো' (১৮৮৬), 'তাজ্জব ব্যাপার' (১৮৯০), 'কূপনের ধন' (১৯০০), অবতার' (১৯০৬), ব্যাপিকা বিদায় (১৯২৬)।

    (ঙ) চিত্রনাট্য: 'বিলাপ' (১৮৯৬), 'বৈজয়ন্ত বাস' (১৯০০)।

    (চ) গীতিনাট্য: 'ব্রজলীলা' (১৮৮২), যাদুকরী (১৯০০)।

      সাধারণ নাট্যশালায় 'নীলদর্পণ' নাটকে স্ত্রী চরিত্র সৈরেন্ধ্রীর ভূমিকায় অমৃতলালের প্রথম অভিনয়-জগতে আর্বিভাব। উনিশ বছরের অত্যন্ত সুদর্শন যুবক ছিলেন তখন তিনি, তাই হয়তো এ চরিত্রের অভিনয়ের জন্যে তাঁকে আহ্বান করা হয়। তার এই প্রথম অভিনয় সকলের প্রশংসা অর্জন করতে পারে নি। সে-সময় অমৃতবাজার পত্রিকায় লেখা হয়, 'সৈরেন্ধ্রী তত ভালো হয় নাই। কিন্তু তাঁহার রোদনস্বর অপূর্ব বলিতে হইবে'। মধুসূদনের 'কৃষ্ণকুমারী' নাটকে বাকনিপুণা রঙ্গরসিকা 'মদনিকা'র অভিনয় অবশ্য খুবই প্রশংসিত হয় বিশেষ করে নাট্যকার কর্তৃক। এ অভিনয় দেখে মুগ্ধ নাটোরের মহারাজা চন্দ্রনাথ গ্রীনরুমে এসে অভিনেতার পায়ের মোজা খুলে দেন একথা 'স্মৃতিকথা'য় অমৃতলাল জানিয়েছেন। প্রথম দিকে বিজয় (সরোজিনী) চরিত্রে সুযোগ পান এবং কৃতিত্ব দেখান। গিরিশচন্দ্রের ধ্রুবচরিত্র নাটকে বিদূষক, তাঁরই লেখা 'নলদময়ন্তী'তে বিদূষক চরিত্রে তিনি অত্যন্ত নৈপুণ্য দেখান। সরলার 'নীলকমল' তরুবালার বিহারী খুড়ো, 'খাসদখল'-এ নিতাই প্রভৃতি হাস্যরসাত্মক চরিত্রে তাঁর অভিনয় অতুলনীয় হতো বলে হেমেন্দ্রকুমার রায় জানিয়েছেন (যাঁদের দেখছি)। সাহেব চরিত্রগুলির অভিনয়ে তিনি তাদের স্বাভাবিক ও জীবন্ত করে তুলতে পারতেন। 'হীরকচূর্ণ' নাটকে অ্যাডভোকেট জেনারেল মাস্টার স্কোবল, 'সুরেন্দ্রবিনোদিনী'র অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট মাক্রেন্ডেল, চন্দ্রশেখর-এ লরেন্স ফস্টর ইত্যাদি চরিত্রে তাঁর স্মরণীয় অভিনয় উল্লেখযোগ্য। 'প্রফুল্ল' নাটকে রমেশের চরিত্রেও তিনি অত্যন্ত সাফল্য লাভ করেছিলেন। এ চরিত্রের অভিনয়াদর্শ নটসূর্য অহীন্দ্র চৌধুরীকে অমৃতলাল ৫০/৫৫ টি নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করিয়েছেন। হাস্যরসের অভিব্যক্তিত্বেই তিনি স্বচ্ছন্দ ও সফল, তবুও 'সিরিও-কমিক' চরিত্রেও তিনি সুনাম অর্জন করেছিলেন।

       নাট্য-পরিচালকরূপেও তিনি কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তাঁর সুষ্ঠু পরিচালনায় 'স্টার' থিয়েটার এর প্রভূত উন্নতি হয়েছিল। অর্ধেন্দুশেখরের আদর্শ মনে রেখে তিনি নাট্য শিক্ষা দিতেন এবং ছোট-খাটো সব বিষয়েই নজর দিতেন। আলোকসম্পাত, দৃশ্যসজ্জা, অঙ্গ-প্রসাধন ব্যাপারে তার থাকতো বিশেষ দৃষ্টি এদিক থেকে প্রয়োগকর্তীর যে গুরুদায়িত্ব তা তিনি স্মরণে রাখতেন ১৯২৯ এর ২ জুলাই তিনি পরলোক গমন করেন।

  অমৃতলাল বসুর নাট্য বৈশিষ্ট্য:

     ১) অমৃতলাল বসুর নাটকগুলি ছিল ব্যঙ্গ-কৌতুক-রসঘন।

     ২) প্রহসন জাতীয় লঘু রসাত্মক নাটক রচনাতেই ছিলেন সিদ্ধহস্ত।

     ৩) অমৃতলালের প্রহসনের বিষয়ভাবনা ছিল রুচিশীল সম্পূর্ন।

      ৪) হাস্যরসের ক্ষেত্রে তিনি বিশেষভাবে স্যাটায়ার'-কে গ্রহণ করেছেন।

      ৫) সমকালীন পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভোগবাদী বাবু সম্প্রদায়কে তিনি ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করেছেন।

     ৬) বাল্যবিবাহ, বিধবা বিবাহকে তিনি নিন্দা ও বিদ্রুপ করেছেন।

     ৭) স্বদেশপ্রীতি ও জাতীয়তাবোধের উন্মেষ অমৃতলাল বসুর নাটকে ধরা পড়ে।


                                     ==============================================


কোন মন্তব্য নেই

ok

4x6 থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.