Translate

গল্পকার শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় : ড. নীলোৎপল জানা

 





গল্পকার শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

    বাংলা সাহিত্যের ছোটোগল্পের ধারায় শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৯৯-১৯৭০) অনবদ্য রচনাবলীর সরস ভঙ্গী অপরূপ বৈশিষ্ট্যময়। নানা বিষয়, নানা পটভূমি নিয়ে গল্প রচনার তাগিদ শরদিন্দু তাঁর সম্পূর্ণ জীবন ধরে লালন করেছিলেন। তিনি বাস্তবকে কল্পনারসে জারিত করে গল্পবিষয়কে পরিবেশন করেছিলেন। গল্পস্বভাবের প্রতি তীব্রভাবে পাঠককে আকৃষ্ট করার ক্ষমতা ছিল তাঁর। মোহিতলাল মজুমদার তাঁর লেখনী সম্পর্কে বলেছেন, 'আপনি বাস্তবের বাস্তবতা খুঁড়িয়া দেখিতে চান না, জীবনের কোনো ব‍্যাখ্যা বা philosophy আপনার মনকে চাপিয়া ধরে না- সে পিপাসা আপনার নাই.... আপনি passion ও emotion গুলিকে নিজের মতো পাক করিয়া একটু রস তৈয়ার করিয়া দেন এবং ইহার জন্য situation-incident character নিজের মতো করিয়া গড়িয়া লন।... ইহাই আপনার বাহাদুরি। 'ফলত বিষয়-বৈচিত্র্য, প্রকরণ কৌশল, চরিত্র নির্বাচন ও সতেজ সাবলীল ভাষাপ্রবাহের সুনিপুণ সঙ্গমে গঠিত তাঁর গল্পভুবন অন্যান্য শ্রেষ্ঠগল্পের সঙ্গে একই পঙক্তিতে স্থান করে নেয়।

    শরদিন্দুর ইতিহাস আশ্রিত গল্পগুলি সুদূর অতীতকে প্রেক্ষাপট করে লেখা, কখনো বা বর্তমানের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে সৃষ্ট। তাঁর গল্পের মধ্যে বিভিন্ন আকারের গল্প মিশে এক দৃঢ়বদ্ধ রূপ দান করেছে। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃজনী শক্তির অন্তর্লীন বৈভব ছোটোগল্পের পরিসরে সঞ্চারিত হয়ে আছে। তাঁর গল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, তিনি একমুখী কাহিনির মাধ্যমে রুদ্ধশ্বাস আবহে পাঠককে সহজে অন্তিমে পৌঁছে দিতে পারেন। হিংসা-প্রতিহিংসা, যুদ্ধ, হত্যা ষড়যন্ত্রের কাহিনিতে রয়েছে প্রেম-প্রীতির অপূর্ব মায়ালোকের নিবিড়তর সংযোগ। ইতিহাস আশ্রিত গল্পগুলিতে একদিকে যেমন রাজরাজড়ার জীবনকথা আছে তেমনই আছে সমকালীন সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক আবহকে ধরার অনবদ্য প্রয়াস। এর মধ্যেও তিনি জীবনের প্রতি তীব্র সংরাগকে মিশিয়ে দিয়েছেন। ফলত তাঁর গল্পের ধারায় দুই জীবনের প্রবাহ লক্ষ্য করা যায়। মানব জীবনের উপর ইতিহাসের অমোঘ শক্তি নিয়তির মতো প্রভাব ফেলে কীভাবে জীবন নিয়ন্ত্রণ করে তার ছবি তিনি যেমন এঁকেছেন অন্যদিকে ইতিহাসের ক্ষেত্রকে অতিক্রম করে বহমান সাধারণ মানবজীবন কথাকেও লিপিবদ্ধ করেছেন। সুকুমার সেন বলেছেন, 'দূরের দৃশ্যপটকে নিকটে এনে দূরের মানুষকে কাছের মানুষ করতে পেরেছিলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। এইখানেই ঐতিহাসিক গল্প লেখক রূপে তাঁর বিশেষ কৃতিত্ব।'

তাঁর ইতিহাস আশ্রিত গল্পগুলিকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়-

. ইতিহাসাশ্রিত গল্পধারা

২. জাতিস্মর-বিষয়াশ্রিত গল্পধারা।

    'শঙ্খ-কঙ্কণ', 'বেরা রোধসি', 'বাঘের বাচ্চা', 'ইন্দ্রতুলক', 'প্রাগ জ্যোতিষ', 'আদিম', 'অষ্টম সর্গ', 'মরু ও শঙ্খ', 'তক্ত মোবারক', 'চন্দন মূর্তি' প্রভৃতি গল্পে ইতিহাসের অনুষঙ্গ ব্যবহার করে বর্তমান ও অতীতের সম্মিলিত আলেখ্য রচনা করেছিলেন। বাঙালির ইতিহাস রচনার জন্য তিনি প্রাচীন ভারতীয় সমাজের সঙ্গে বাঙালির জাতীয় জীবনের ঐতিহ্যকে রূপ দিয়েছিলেন। তাঁকে অতীতের জীবন নানা ভাবে আকৃষ্ট করতো। রোমান্সের প্রতি তীব্র আকর্ষণের কারণে তিনি অতীতকে বর্তমান জীবনের আবিলতা থেকে মুক্ত করে কল্পলোকের সামগ্রীতে পরিণত করতে পেরেছিলেন। তাঁর ইতিহাসাশ্রিত গল্প রচনার মূল অন্বিষ্ট ছিল স্বাজাত্যবোধের স্ফুরণ নয়, বরং কল্পনামূলক অতীতের পুনর্নির্মাণ।

    জন্মান্তরের স্মৃতিসূত্রে প্রাগৈতিহাসিক যুগের পটভূমিতে ইতিহাসকে বিনির্মাণে তাঁর মৌলিকত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। 'জাতিস্মর' (১৩৩৯) প্রথম গল্পগ্রন্থ তাঁর। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে পূর্বজন্মের কাহিনি নিয়ে তিনি লিখেছেন 'অমিতাভ', 'মৃৎ প্রদীপ' ও 'রুমাহরণ' গল্প। 'চুয়াচন্দন' (১৩৪২) 'রক্ত-সন্ধ্যা', 'বিষকন্যা' (১৩৪৭) গ্রন্থের সেতু ও বিষকন্যায় ধূসর অতীতের মোহময় ইতিবৃত্ত রচিত হয়েছে। কোনো কোনো গল্প আত্মকথন রীতিতে রচিত, আবার কোনো কোনো গল্পের নেপথ্যে রয়েছে হিন্দু ও বৌদ্ধ যুগের প্রাচীন ইতিহাস। তাঁর প্রায় প্রত্যেকটি গল্প পাঠকের অনন্ত বিস্ময়কে জাগিয়ে তোলে। আসলে শরদিন্দুর কল্পনাশক্তি মানবেতিহাসের অতীত খনন করে চরিত্রকে উদ্ধার করেন। কল্পনার ইন্দ্রজাল প্রসারিত করে অতীতকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য তিনি ভাষাকে সৌন্দর্যের বাহক করে তোলেন। ভাষা সম্পর্কে তাঁর অভিমত ছিল, 'ভাষা হবে আরবি ঘোড়ার মতন- বেতো ঘোড়ার মতন নয়। শুধু গতিবেগ নয়- ছোটার মধ্যেও সৌন্দর্য যেন ছুটে বেরোয়-মন যেন ভরে যায়।' তাঁর গল্পে আকর্ষণকারী ও গতিশীল শব্দের ব্যবহার অতীতের যবনিকা উন্মোচনের অনবদ্য তাৎপর্যে মণ্ডিত।

    ইতিহাস আশ্রয়ী গল্প ছাড়াও তার বেশ কিছু অলৌকিক অতিপ্রাকৃত গল্প আছে। এই গল্প সৃষ্টিতে তিনি একধরনের গা ছমছমে ভয়াবহ অসম্ভব পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। এই ধরনের গল্প যোগান দিতে পারে অতিপ্রাকৃত আস্বাদ, অলৌকিত্বের সুরমাধুর্য, জীবনের গতি ও জীবন অভিজ্ঞতার নিবিড়তা। শরদিন্দুর ভৌতিক গল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য হল পাঠককে ভিন্ন স্বাদের অলৌকিকতার বিন্যাসে পৌঁছে দেওয়া। সহজ স্বাভাবিক অনায়াস গতির মধ্যে রোমাঞ্চকর শব্দের সংযোজন তাঁর গল্পগুলিকে অন্য মাত্রা দান করেছে। অলৌকিকতার সঙ্গে জীবনের নিবিড়তর সংযোগে নতুন ধরন প্রয়োগ তাঁর গল্পকে নতুন করে তুলেছে।


    সামাজিক ও রোমান্টিক গল্পগুলির ক্ষেত্রে তিনি অতি সাধারণ জীবনযাত্রাকে বিষয় হিসাবে গ্রহণ করেছেন। তবে সেখানেও মনস্তত্ত্ব বড় কথা হয়ে উঠেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি সামান্য ইঙ্গিতে গূঢ়তর বিষয়কে উপস্থাপন করেছেন আবার কোনো সময় তাঁর গল্পে গভীর জীবনবোধকে উপলব্ধি করার দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাববোধ করেছেন পাঠক। তবু যুগজীবনের চাহিদাকে স্বীকরণ করে অতি সাধারণ ভাষায় লিখে গল্পগুলির শিল্পস্বরূপ প্রকাশের অনিবার্য উপাদান হয়ে উঠেছে। রাজশেখর বসু মন্তব্য করেছেন, 'সংস্কৃত শব্দ, বিশেষত সেকেলে শব্দ দেখলে আধুনিক পাঠক ভড়কে যায়। আশ্চর্য এই- আপনার লেখায় এ রকম শব্দ প্রচুর থাকলেও পাঠক ভড়কায় না। বোধহয় তাঁর কারণ আপনার প্লটের বা বর্ণনার দুনির্বার আকর্ষণ।' তাঁর গল্পের প্রাণকেন্দ্রই  সুললিত ভাব ও ভাষা।

     শরদিন্দুর হাস্যরসের গল্পগুলিতে হাসি কখনও মৌন, কখনও মুখর। এই ধরনের গল্পের প্রধান গুণ হল - সরসতা। শরদিন্দুর ব্যক্তমনের প্রসন্নতা তাঁর গল্পের প্রাণশক্তি। হাসির গল্পে এক মিষ্টি মধুর আমেজ পাঠকের মনকে মায়াময়তায় আবিষ্ট করে রাখে। এইসব গল্প পড়ে পাঠক খুব সহজেই তাঁর মনের প্রগাঢ় অনুভূতিকে উপলব্ধি করতে পারেন। গল্পবিষয়ের ঐতিহ্য ও রচনাশৈলীর স্বতস্ফূর্ত অভিনবত্ব আমাদের বিস্ময়ে অভিভূত করে। গল্পগুলিকে আলোচনার সুবিধার জন্য আমরা যেভাবেই ভাগ করি না কেন শরদিন্দুর স্বকীয়প্রতিভা ও চিন্তাদর্শন প্রত্যেকটি গল্পের মধ্যে মিলেমিশে গেছে। ফলত তাঁর গল্পগুলি যেমন সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে অন্যদিকে তেমনই সময়ের-সমাজের জীবনের দর্পণরূপে প্রকাশিত হয়েছে।

 

==================================

Dr.Nilotpal Jana
MGC

কোন মন্তব্য নেই

ok

4x6 থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.