গল্পকার সুবোধ ঘোষ : ড. নীলোৎপল জানা
সুবোধ ঘোষ (১৯০৯-১৯৮০)
গল্পকারের বিষয়-বৈচিত্র্যের মধ্যে আমরা লক্ষ
করি জগত ও জীবনের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁর অনায়াস যাতায়াত। সহানুভূতিশীল হৃদয়, পর্যবেক্ষণ
শক্তি, নিখুঁত বাস্তবদৃষ্টি, ব্যক্তি ও সমাজ সম্পর্কে তীক্ষ্ণ অভিজ্ঞতা, জীবন সম্পর্কে
নিরাসক্ত মন- নানান বৈশিষ্ট্যে জারিত হয়েছে সুবোধ ঘোষের গল্পভুবন। তাঁর গল্প অনুযায়ী
যে সমস্ত বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় তা হল--
১. সুবোধ ঘোষ
উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানসিকতার কৃত্রিম মুখোশকে তীব্র কটাক্ষের মধ্য দিয়ে উন্মোচিত
করেছেন।
২. তিনি রিয়ালিজমের
নতুন রূপ নিয়ে এসেছেন গল্প ক্ষেত্রে।
৩. তাঁর গল্পে
ফ্রয়েডীয় মনোবিকলন তত্ত্বের নিখুঁত শিল্পরূপ প্রত্যক্ষ করা যায়।
৪. ভারতবর্ষীয়
নীতিতন্ত্রের শিল্পরূপ সুবোধ ঘোষের বিভিন্ন গল্পে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে।
৫. প্রাদেশিক
বিভিন্ন শব্দ ও পরিভাষার প্রয়োগ লক্ষিত হয় গল্প-অবয়বে।
৬. সুবোধ ঘোষ
ছিলেন জীবন রসরসিক শিল্পী। তাই কৃত্রিমতার অন্তরালে তিনি অন্বেষণ করেছেন জীবনবোধকে,
যা গল্পের মধ্যে পরিবেশিত হয়েছে।
সমাজ ও জীবনচিত্র অঙ্কনের তাগিদে সুবোধ ঘোষের
ছোটোগল্পের জগৎ হয়েছে বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। যার বীজ নিহিত ছিল গল্পকারের নিজস্ব জীবনচর্যায়।
তাঁর নিজের জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা- বাসের কণ্ডাক্টারি, ট্রাকের চালক হিসাবে কাজ করা, কুলি-বস্তিতে ইঞ্জেকশান দেওয়ার
চাকরি, কুলিগিরি কিংবা মহানগরের রাস্তায় ফেরিওয়ালা বৃত্তি, ছায়াপথ তাঁর সাহিত্যে প্রতিস্থাপিত
হয়েছে। তাঁর গল্পগ্রন্থগুলি হল-- নিম্নলিখিত ফসিল (১৯৪০), পরশুরামের কুঠার (১৯৪০), কুসুমেষু
(১৯৫৬), পলাশের নেশা (১৯৫৭), মনোবাসিত (১৯৫৭), নিত্যসুন্দর (১৯৫৮), জতুগৃহ (১৯৬২),
নিকষিত হেম (১৯৬৩), শ্রেষ্ঠগল্প (১৯৪৯), রূপনগর (১৯৬৪) ইত্যাদি।
মধ্যবিত্ত মানসিকতার অবনমন, মূল্যবোধের ভাঙন
ও পুনর্বাসনের তাৎপর্য নির্মাণে সুবোধ ঘোষ নিরলস কথাশিল্পী। 'গোত্রান্তর', 'তিন অধ্যায়',
'সুন্দরম, 'হৃদ ঘনশ্যাম', 'স্নানযাত্রা', 'পরশুরামের কুঠার' প্রভৃতি গল্পে আত্মপ্রতারক
মধ্যবিত্তের স্বরূপ উন্মোচিত করেছেন। তীব্র তিক্ততা ও নির্মমতায় তিনি উচ্চবিত্ত মানসিকতার
ব্যবচ্ছেদ ঘটিয়েছেন। 'সুন্দরম' গল্পের মধ্য দিয়ে উচ্চবিত্ত সমাজে সৌন্দর্যবোধ, দেহলালসা,
অর্থলোভ তীক্ষ্মতর বিদ্রূপে প্রকাশিত করেছেন। 'পরশুরামের কুঠার' গল্পেও উচ্চবিত্ত মানুষের
হাতে মানুষের অসম্মানের শোভনীয় পরিণাম কতটা অমানুষিক হতে পারে তার চিত্র বিদ্রূপে জর্জরিত
করে এঁকেছেন। মধ্যবিত্তের কপটতাকে নির্মমভাবে তুলে ধরেছেন 'গোত্রান্তর' গল্পে। 'তিন
অধ্যায়' গল্পতেও উচ্চমধ্যবিত্তের ক্রমাবনতি এবং তাদের ভাবভঙ্গির কৃত্রিমতাকে গভীর শিল্পরসে
জারিত করে প্রকাশ করেছেন। 'বারবধূ' গল্পেও মধ্যবিত্ত মানসিকতাকে, তার স্ববিরোধিতাকে
নিপুণ হাতে এঁকেছেন।
১৯৪০এ রচিত সুবোধ ঘোষের 'ফসিল' গল্পে পরাধীন
ভারতবর্ষের উপর ঔপনিবেশিক শাসন ও তার ফলে সৃষ্ট তিনটি শ্রেণির সংঘর্ষের আখ্যান রচিত
হয়েছে। 'শক্তিমান কলমের অধিকারী' সুবোধ ঘোষ এই গল্পের মাধ্যমে মানব ইতিহাসের রাজনৈতিক
বিবর্তনের প্রেক্ষাপট ও সেই সঙ্গে তার পরিণামকে সাংকেতিক ভাষায় চিহ্নিত করেছেন। তাঁর
অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গল্প 'চতুর্থ পানিপথের যুদ্ধ' বিশেষ রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রেক্ষাপটে
রচিত হয়েছে। আদিবাসী সমাজের এক শিক্ষার্থীর প্রতিবাদ সত্তার প্রকাশ এই গল্প, এক ব্যক্তির
আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার গল্পও। এছাড়াও সুবোধ ঘোষ দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, মন্বন্তর দেশ বিভাজনের
প্রেক্ষাপটে বাঙালি মধ্যবিত্তের সামাজিক ইতিহাসকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন।
'স্বর্গ হতে বিদায়', 'কৌন্তেয়' প্রভৃতি গল্প তার প্রমাণ। আবার 'অযান্ত্রিক' গল্পে যন্ত্রের
(জগদ্দল) সঙ্গে মানুষের (বিমল) অযান্ত্রিক সম্পর্কের বন্ধন রচিত হয়েছে। এক অন্যতম মৌলিক
প্রত্যয়ে 'অযান্ত্রিক'এর কথাবস্তু নির্মিত হয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই
ok