ছোটো গল্পকার নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় : ড. নীলোৎপল জানা
ছোটো গল্পকার নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
ছোটোগল্পকার নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিচয় নেবার আগে ছোটগল্প সম্বন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা পরিচয় নেওয়া যেতে পারে। 'ছোটগল্পের সীমারেখা'-তে তিনি লিখেছেন, "ছোটগল্প গড়ে উঠেছে দুটি জিনিসের মিশ্রণে। লেখকের নিজস্ব একটি জগৎ-জীবন মানববোধ আছেই-Profound হোক আর না-ই হোক, তা-ই হল তাঁর দর্শন। আর জীবন থেকে নিজস্ব প্রবণতা-অনুযায়ী যেসব উপকরণ তিনি আহরণ করে নিচ্ছেন, তারা সেই দর্শনের দ্বারা বিরঞ্জিত হয়ে শিল্প হয়ে উঠেছে। তাই একালের ভালো গল্প কেবল কৌতূহল-সৃষ্টির জন্যে ঘটনা নির্মাণ করছে না, কোনো বিশেষ বক্তব্য প্রচারের জন্য গল্পকে বাহন করছে না (বক্তব্য তো লেখকের জীবন-দৃষ্টি থেকে স্বয়ং প্রকটিত হবে), আসলে তার একটিমাত্রই প্রবণতা তা বস্তুনির্ভর হয়েও বাস্তবাতীত, তা দূরাচারী, তা প্রতীকী।" অর্থাৎ লেখকের মনোভূমি ও ছোটগল্পের প্রতীকধর্মিতার উপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর গল্পের মধ্যে এ দুটি দিক আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি।
তাঁর প্রকাশিত গল্পগ্রন্থগুলি হল-- 'বীতংস' (১৯৪৫); 'দুঃশাসন' (১৯৪৫), 'ভাঙা
বন্দর' (১৯৪৫), 'জন্মান্তর' (১৯৪৬), 'ভোগবতী' (১৯৪৭); 'কালা বদর' (১৯৪৮); 'শ্বেত কমল'
(১৯৫১), 'গন্ধরাজ' (১৯৫৫), 'উর্বশী' (১৯৫৬), 'চার মূর্তি' (১৯৫৭), 'ভাটিয়ালী' (১৯৫৭);
'রূপমতী' (১৯৫৯); 'সাপের মাথার মণি' (১৯৫৯); 'একজিবিশন' (১৯৬১), 'শুভক্ষণ' (১৯৬১);
'রাতের মুকুল' (১৯৬৪); 'শিলাবতী' (১৯৬৪); 'ছায়াতরী' (১৯৬৬); 'বনজ্যোৎস্না', প্রকাশকাল
জানা যায়নি; 'বনজ্যোৎস্না' (১৯৬৯); (নামগল্প ভিন্ন দুটি সংস্করণ সম্পূর্ণ আলাদা);
'ঘূর্ণি' (১৯৭১); 'লক্ষ্মীর পা' (১৯৭৭); 'অষ্টাদশী' (১৯৭৯); 'আলেয়ার রাত' (১৯৮১)।
কিশোর গল্পঃ (১) 'সপ্তকাণ্ড', ১৯৪৮; (২) 'ছুটির আকাশ', ১৯৫৬: (৩) 'খুশির হাওয়া', ১৯৫৮; (৪) 'গল্প বলি গল্প শোনো', ১৯৬১; (৫) 'রাঘবের জয়যাত্রা', ১৯৬৩; (৬) 'হনোলুলুর মাকুদা', ১৯৬৫; (৭) 'কম্বল নিরুদ্দেশ', ১৯৬৭; (৮) 'পঞ্চাননেরহাতী', ১৯৬৮; (৯) 'টেনিদার গল্প', ১৯৬৮; (১০) 'পটলডাঙ্গার টেনিদা', ১৯৭০; (১১) 'টেনিদা দি গ্রেট', ১৯৭১; (১২) 'ঘন্টাদার কাবলুকাকা', ১৯৭২; (১৩) 'অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ এবং', ১৯৭৪; (১৪) 'টেনিদা ও ভূতুড়ে কামরা', ১৯৮১; (১৫) 'ক্রিকেটার টেনিদা', ১৯৮৬; (১৬) 'টেনিদার কাণ্ডকারখানা', ১৯৯০।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোটগল্পের বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য যেমন তেমনি রয়েছে আঙ্গিকের অভিনবত্ব। সমকালীন সময় ও জীবন, রাজনীতি, আঞ্চলিকতা, প্রকৃতি-প্রেম- রোমান্স, একাল ও সেকালের দ্বন্দু, সমাজবাস্তবতা, মনস্তাত্ত্বিকতা, মূল্যবোধ ও তার সংকট, অতিপ্রাকৃত ও পুরাণ প্রসঙ্গ, ঐতিহ্য ও আদর্শবোধ, নানাশ্রেণির মানুষ, মানুষের ইতিহাস, শ্রেণিবৈষম্য ও শোষণ প্রভৃতি তাঁর ছোটগল্পে জীবন্ত হয়ে রয়েছে।
বিংশ শতকের চল্লিশের দশক রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সময়। এই সময় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর, দেশবিভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, স্বাধীনতা লাভ প্রভৃতি যুগান্তকারী ঘটনায় উথাল পাথাল। লেখকও জানিয়েছেন, "সেদিনের সেই অসহ্য আত্মগ্লানি আর যন্ত্রণার মধ্যে সমস্ত বাঙালী লেখকের সঙ্গে আমিও গর্জন করে উঠেছি, 'যুগান্তরে' লিখেছি 'নক্রচরিত', 'আনন্দবাজারে' লিখেছি 'দুঃশাসন', 'দেশে' লিখেছি 'পুষ্করা' আর 'ভাঙা চশমা'।"
চল্লিশের দশকের দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর, মজুতদারি, কালোবাজারি প্রভৃতির প্রেক্ষাপটে 'নক্রচরিত'-এর নিশিকান্ত কর্মকারকে উপস্থাপিত করেছেন সমাজসচেতন গল্পকার- যার বৃত্তি হল সাধারণ মানুষের অসহায়তার সুযোগে শোষণ করা এবং নারীসম্ভোগের আকাঙ্ক্ষা। নক্র অর্থাৎ কুমীর যেমন শিকারের জন্য সুযোগের অপেক্ষায় থাকে গল্পের নিশিকান্তও তাই। গল্পে নিশিকান্তকে তাই দেখা যায় বিশাখাকে তুলসীর মালা পরিয়ে 'বৃন্দাবন লীলার লীলাসঙ্গিনী'-তে পরিণত করেছে এবং নিজের কুকর্মকে চাপা দেবার জন্য সে ইব্রাহিম দারোগাকেও শিকারে পরিণত করেছে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় 'শিল্পী' গল্পে যেমন সুতোর কালোবাজারির চিত্র এঁকেছেন,
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ও 'দুঃশাসন' গল্পে আড়তদারির চিত্র এঁকেছেন দেবীদাসের মাধ্যমে যে
কাপড় আড়তের মধ্যে রেখে অভাবগ্রস্ত মেয়েকে বিবস্ত্র রাখতে বাধ্য করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর
পরিস্থিতিতে আড়তদারের মুনাফালোভ ও হৃদয়হীনতার ছবি এঁকেছেন 'দুঃশাসন' গল্পে।
বিশ্বযুদ্ধ ও মন্বন্তরের বিভীষিকাময় জীবনের আর এক আলেখ্য 'পুষ্করা' গল্পটি।
লেখক দেখিয়েছেন সামাজিক অবক্ষয়, অন্ধ কুসংস্কার তর্করত্নের মতো মানুষদের কীভাবে নির্মম
ও লোভী হতে শেখায়। শুধু তাই নয়, সম্পদশালী মানুষের অন্ধ দেবতাপ্রীতি ও তথাকথিত পুরোহিততন্ত্রের
মিথ্যাচারী কপটতার প্রতি লেখকের বিদ্রূপবাণী বর্ষিত হয়েছে এই গল্পে।
দুর্ভিক্ষ ও মন্বন্তরক্লিষ্ট জীবনের চরমতম অবমাননার ছবি অঙ্কিত হয়েছে 'ভাঙা চশমা' গল্পে। 'ভাঙা চশমা' একদিকে অবক্ষয় ও অন্যদিকে অস্তিবাদী সত্তার স্বরূপে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। গল্পের হেডমাস্টারমশাই ও অন্যান্য চরিত্রগুলি তাই সমকালীন জটিলতা থেকে উত্তরণের স্বপ্ন দেখান, রিক্ততা বা জটিলতার মধ্যে হারিয়ে যান না।
দেশবিভাগের বেদনার ছবি প্রকাশিত হয়েছে 'তিতির' ও 'সীমান্ত' গল্পগুলিতে। 'তিতির'
গল্পে দেশবিভাগের যন্ত্রণাকে দেখানো হয়েছে জুলফিকার ও শুকলালের মাধ্যমে। সমরেশ বসুর
'আদাব'ও তাই। আবার 'সীমান্ত' গল্পে ফজলে রবিব ও দয়ালের মধ্য দিয়ে দেশবিভাগের বেদনাকে
লেখক রূপায়িত করেছেন। এরা দুজন কৃষক বন্ধু আগস্ট আন্দোলনের সহযোদ্ধা। পুলিশ মিলিটারির
গুলিতে দয়াল প্রাণ হারালে তার শিশুকন্যা ফুলমণির দায়িত্ব নেয় ফজলে রবিব। কিন্তু ফুলমণির
বিয়ে নিয়ে সমস্যা ও শেষে ওপার বাংলার হিন্দু কান্তারামের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ফুলমণির সর্বনাশ
ডেকে আনে ও নিজে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করে।
উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে রচিত গল্পগুলির মধ্যে 'বাইশে শ্রাবণ', 'শ্বেতকমল' এবং
'শুভক্ষণ' উল্লেখযোগ্য। 'শ্বেতকমল' গল্পে সিদ্ধার্থের মাধ্যমে উদ্বাস্তু সমস্যার তীব্র
সংকটে মানুষের মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়কে লেখক উপস্থাপিত করেছেন। 'মধুবন্তী' গল্পে উদ্বাস্তু
এক ছেলে প্রতিষ্ঠা লাভ করে কীভাবে তার নিজের স্ত্রীকেও আপন করে নিতে পারে না, তার স্বরূপ
অঙ্কন করেছেন।
বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে রচনা করেছেন
'নতুন গান'। ফেব্রুয়ারির রক্তে মাখা নতুন বাংলায় নতুন জীবনের নতুন গান-'ও আমার বাংলা
ভাষা গো-তুমিই আমার মনের আলো, তুমিই আমার প্রাণের আশা গো'।
তেভাগা-তেলেঙ্গানার কৃষক আন্দোলনের পটভূমিতে
রচিত হয়েছে 'বন্দুক' গল্প। এই গল্পে দেখি হিন্দু-মুসলিম কৃষকরা সমবেতভাবে শপথ নিয়েছে-
'জান দেব, ধান দেব না।' ফসলের তিনভাগের একভাগ তারা জমিদারকে দেবে।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষিত ফুটে উঠেছে
'ইজ্জৎ' গল্পে। সামান্য কারণে ফাঁকা মাঠে পাশাপাশি থাকা ফকিরের সমাধিস্থান ও কালী মন্দির
নিয়ে গ্রামের হিন্দু-মুসলিমের বিরোধ এবং মৌলবী ও পুরোহিতের উস্কানি-র স্বরূপ গল্পে
স্থান পেয়েছে।
গল্পকারের সমাজসমস্যামূলক গল্পগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'হাড়'। সামাজিক শ্রেণিবৈষম্যের
স্বরূপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গল্পে তাই দেখি-একদিকে রায়বাহাদুরের দল, অন্যদিকে নিরন্ন,
সর্বহারাদের দল এবং গল্প-কথকের মতো অসহায় মধ্যবিত্তশ্রেণি। লেখক গল্পে দেখিয়েছেন, যে
সমাজ ধনতান্ত্রিক বুর্জোয়া সমাজ-তার কাঠামোতে রয়েছে ধনী, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত। সেজন্য
এই গল্পের মৌল সমস্যা ও সমাধান বর্তমান সামাজিক কাঠামোকে ভেঙে নতুন করে গড়ে তোলার মধ্যেই
নিহিত।
সাঁওতালদের সঙ্গে জমিদারের দ্বন্দ্ব নিয়ে রচিত 'সৈনিক' গল্পটি। দেবীকোট রাজবংশের জমিদার ইন্দ্র চৌধুরী এবং কৃষক সাঁওতাল প্রজাদের মধ্যে শ্রেণি সংঘর্ষকে গল্পে রূপায়িত করা হয়েছে।
মালিক ও শ্রমিকের সম্পর্ক ও শোষণের চিত্র চিত্রিত হয়েছে 'কালনেমি' ও 'নীলা'
গল্পগুলিতে। 'কালনেমি' গল্পে চা মালিক ব্রিটিশ শিল্পপতি অ্যাঞ্জেল ও জনস্টন সাহেবের
সঙ্গে চা বাগানের কুলিদের সম্পর্ক ও শোষণ এবং মধ্যবিত্তের অসহায়তা উদ্ঘাটিত হয়েছে।
আবার 'নীলা' গল্পে চিনি কলের মালিকের শ্রমিক শোষণের রূপটি প্রত্যক্ষ করা যায়।
শোষণ ও শ্রেণিবৈষম্যের রূপ ধরা পড়েছে 'তৃণ', 'তীর্থযাত্রা', 'ভোগবতী', 'ডিম', 'বীতংস' প্রভৃতি গল্পে। 'বীতংস' গল্পে মধ্যস্বত্ত্বভোগী দালালদের আড়কাঠিবৃত্তি, 'তৃণ' গল্পে দারিদ্র্যের সুযোগে জমিদার ও মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের শোষণ, 'ভোগবতী' গল্পে সাম্রাজবাদী শোষণে সাঁওতালদের ট্র্যাজিক পরিণতি, 'কালো মোটর' গল্পে আধুনিক বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার শ্রেণিবৈষম্য ও শ্রেণিসচেতনতার সূক্ষ্ম দিকগুলি চিত্রিত হয়েছে নিপুণ তুলিতে।
মানবমনের জটিলতা, কুটিলতা তথা মানব মনস্তত্ত্বের রূপায়ণ ঘটেছে 'একজিবিশন',
'হরিণের রঙ', 'দুর্ঘটনা', 'আত্মহত্যা', 'বনতুলসী' প্রভৃতি গল্পে। 'একজিবিশন' গল্পের
নায়ক বসন্ত একজিবিশন দেখতে গিয়ে এক মেয়ের লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত জীবনের কাহিনি শুনে তাকে
বিয়ে করতে চায়। ঠিক সেই সময় একজিবিশনে আগুন লাগে। মেয়েটি হারিয়ে যায় ও নায়ক বিচ্ছিন্ন
হয়ে যায়, তার অবচেতনের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসে স্বস্তির নিঃশ্বাস।
মানবমনের অবচেতন থেকে উঠে আসা হিংস্রতা ও চাপা আক্রোশ কীভাবে এক নির্দোষ সুখী
দাম্পত্য জীবনে করুণ পরিণতি ডেকে আনতে পারে, সেদিকটি চিত্রিত হয়েছে 'দুর্ঘটনা' গল্পে।
'ফলশ্রুতি' গল্পে অঙ্কিত হয়েছে আধুনিক মধ্যবিত্তের মানসিকতা। 'বনতুলসী' গল্পে বয়ঃসন্ধি
পর্বের এক কিশোরের মনস্তত্ত্ব উদ্ঘাটিত হয়েছে। 'ছলনাময়ী' গল্পে লেখক দেখিয়েছেন, দুটি
পুরুষের প্রথম জীবনে নারীর আকর্ষণে সর্বস্ব হারিয়ে যাওয়ায় তাদের মানসিক অবস্থার রূপ।
প্রেম ও রোমান্স-এর উপাদান দিয়ে রচিত 'বনজ্যোৎস্না', 'ঘাসবন' প্রভৃতি গল্প। রোমান্টিক প্রাকৃতিক পটভূমিতে 'বনজ্যোৎস্না' গল্পটি রচিত। গল্পে দেখানো হয়েছে লোভ লালসা ও বাস্তবের নিষ্ঠুরতায় কীভাবে রোমান্স ও প্রেমের স্বপ্ন কল্পনা নস্যাৎ হয়ে যায়। 'ঘাসবন' গল্পেও এক ছলনাময়ী যুবতীর সঙ্গে বন্ধনহীন প্রেমের মাদকতার বিনষ্টির রূপ অঙ্কিত হয়েছে।
প্রভাতকুমার
মুখোপাধ্যায়ের 'আদরিণী' গল্পের মতো তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় মুক পশুকে নিয়ে 'কালাপাহাড়'
গল্প রচনা করেছেন। এই গল্পে কালাপাহাড় মহিষের সঙ্গে সম্পন্ন চাষী রংলালের আন্তরিক সম্পর্কের
বন্ধন চিত্রিত হয়েছে। আবার 'দোসর' গল্পে প্রকাশিত হয়েছে এক বন্য পশু শুয়োরের সঙ্গে
মানুষের সাহচর্য। উপন্যাসে যেমন ইতিহাসকে তিনি বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন, গল্পেও ইতিহাসের
পদধ্বনি শোনা যায় 'একটি অমর রাত্রি' গল্পে। 'একটি অমর রাত্রি' গল্পে নাট্যকার দীনবন্ধু
মিত্রের 'নীলদর্পণে'র পাণ্ডুলিপি নৌকা ডুবে যাওয়ার সঙ্গে হারিয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে
রচিত। অতিপ্রাকৃত উপাদানের সংযোগে রচিত 'হাত' গল্পটি। গল্পটিতে রয়েছে রোমাঞ্চ ও মৃত্যুর
আতঙ্ক-যা অতিপ্রাকৃত আবহ নির্মাণ করেছে।
তারাশঙ্করের মতো নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ও একাল ও সেকালের দ্বন্দুকে ফুটিয়ে তুলেছেন
তাঁর কথাসাহিত্যে। 'উস্তাদ মেহের খাঁ' গল্পে পুরানো দিনের সংগীত চর্চা ও বৃদ্ধ শিল্পীরা
যে বর্তমান দিনে অবহেলিত হচ্ছে, সেই দিকটি প্রকাশিত হয়েছে। আবার 'ইতিহাস' গল্পে দেখি
পিতা-পুত্রের বিশ্বাসগত দ্বন্দু। পিতা অমরেশ শেষ পর্যন্ত বর্তমানকে নির্লিপ্তভাবে গ্রহণ
করতে বাধ্য হন। 'মমি' গল্পে বর্তমানের দ্বন্দুে ক্ষতবিক্ষত পিতার হাতখানি তুলে ধরে
পুত্র যে তাঁরই সঙ্গে রয়েছে, সেই আশ্বাসবাণী শোনায়।
তাঁর গল্পের চরিত্রচিত্রণ বিশেষত স্ত্রী চরিত্রাঙ্কনে বৈচিত্র্য যথেষ্ট। নারীমনের বিচিত্র গতির রূপ প্রকটিত হয়েছে 'গিলটি', 'কাণ্ডারী', 'ট্যাক্সি ড্রাইভার', 'একটি চিঠি', 'লজ্জা' প্রভৃতি গল্পে। 'গিলটি' গল্পে কৃত্রিম ভালবাসার ছবি, 'কাণ্ডারী' গল্পে হীনমন্য অখিলের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়ে অলকা কাণ্ডারী হয়ে ওঠে।
'দোলনচাঁপার বৃত্ত' গল্পটি লেখক জীবনের বেদনা নিয়ে রচিত। বক্তার কৈশোরের প্রিয় কবি আজ বিত্তহীন, অসুস্থ, সরকারি সাহায্য ছাড়া তার উপায় নেই। সাহিত্যিকের এই দুর্দশা কথককে ব্যথিত করেছে। তাঁর কিশোর গল্পগুলিতে দিনযাপনের গ্লানি বা সমকালীন যন্ত্রণা, হতাশা নেই, আছে নির্মল কৌতুকরস। পটলডাঙ্গার টেনিদা আর তার তিন সাগরেদ পেটরোগা প্যালা, ঢাকাই বাঙ্গালি হাবুল আর বুদ্ধিদীপ্ত ক্যাবলা এরা জীবন্ত হয়ে আছে তাঁর গল্পে। 'ঢাউস' গল্পে টেনিদা কাকেদের প্রশংসা করে। কারণ তারাই টেনিদাকে পিসিমার ভয়ংকর তিলের নাড়ু থেকে রক্ষা করেছিল পিসেমশাইয়ের টাঁকে ঐ নাড়ু ফেলে দিয়ে। 'ঘোড়ামামার পাল্লায়' গল্পটিতে রয়েছে ঘোড়ামামার চান করার ইতিবৃত্ত। ঘোড়ামামা রোজ চান করেন না। কারণ, যেমন গামছা সাতদিন জলে ভিজলে পচে যায় তেমন রোজ চান করলে শরীরও পচে যায়। শুধু তাই নয়, ব্রহ্মাবিকাশ, রামগিদ্ধড়, গজগোবিন্দ, হনলুলুর মাকুদা প্রভৃতি বিচিত্র নামধারী চরিত্রগুলি তাদের স্বভাব বৈশিষ্ট্যে পাঠকের ঔৎসুক্য সঞ্চার করে। কৌতুক ও কৌতূহলের সমন্বয়ে তাঁর হাসির গল্পগুলি নির্মল কৌতুকরসের উৎসার ঘটায়। গল্পের বুনুনি, ভাষার স্বাভাবিকতা, চরিত্রের অসঙ্গত আচরণ পাঠককে মোহাবিষ্ট করে রাখে।
গল্পের আঙ্গিকেও তিনি এনেছেন বৈচিত্র্য। উত্তমপুরুষে কথন, অন্যের কাছে শোনা গল্পকথন, প্রথম পুরুষে উল্লেখ করা বিবরণ বা বিশ্লেষণ,
ফ্ল্যাশব্যাক পদ্ধতি, নাট্যকৌতূহল সৃষ্টি, আকস্মিক নাট্যসিচুয়েশন সৃষ্টি, কথোপকথন ভঙ্গিমা,
চিঠির আঙ্গিক ব্যবহার প্রভৃতি তাঁর গল্পের শিল্পরূপের অন্যতম স্তম্ভ। সেইসঙ্গে গল্পের
ব্যঞ্জনা, প্রতীকধর্মিতা, নামকরণ, চরিত্রচিত্রণ, কাব্যিক সংলাপ ব্যবহার, আঞ্চলিক শব্দের
ব্যবহার, কথ্যরীতির প্রয়োগ গল্পগুলির রসাস্বাদনকে বাড়িয়ে দিয়েছে। কয়েকটি দৃষ্টান্ত
গ্রহণ করা যেতে পারে।
'রেকর্ড' গল্পে কাহিনি সামান্য কিন্তু ঘটনা, চরিত্র ও ব্যঞ্জনার মধ্যে রয়েছে
বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন। গল্পটি উত্তমপুরুষে বর্ণিত। গল্পের মৌল বক্তব্যটি কথক-নায়কের
হাত ধরে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন লেখক। কথকের স্ত্রী করুণা যথার্থ সহধর্মিণীর মতো
রেকর্ডটির অন্তর্নিহিত বিপ্লব সংগীতের গতিময়তাকে পাঠকের মনের গভীরে পৌঁছে দিয়েছেন।
গল্পের কাহিনি, চরিত্র, বলার ভঙ্গি ও ভাষা অনবদ্য। গল্পের প্রথমে পরিবেশ সৃষ্টির জন্য
দুটি অনুচ্ছেদে কলকাতার বউবাজার-শিয়ালদা অঞ্চলের এক চোরাবাজারের বাহির ও ভিতরের স্বরূপ
তুলে ধরেছেন। গল্পের ক্লাইম্যাক্স একেবারে গল্পের শেষে বিপ্লবী ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল
কলকাতার বুকে কথকের-আত্মোপলব্ধি সূচক বাক্যটিতে: 'দেশে দেশে, কালে কালে এ সুর এক। জানতুম,
আমরাও এ সুরকে জানতুম।' এরপর ক্লাইম্যাক্স শেষ হয়েছে এই বাক্যে 'দু-চোখে অসহ্য ঘৃণা
জ্বলছে ওর'।
এই গল্পের গদ্যরীতিতে রয়েছে চলিত রীতির গতিময়তা- 'যেমন অদ্ভুত বাজনা- তেমনি অদ্ভুত সুর। কেন জানি না-কোথায় রক্তের মধ্যে দোলা লেগে গেল।' গল্পের নামকরণ ও ভাবব্যঞ্জনা শিল্পসম্মত।
'বনতুলসী' গল্পটি কার্যকারণের সূত্রে গ্রথিত কল্পনাধর্মী যৌনতৃষ্ণার গল্প। গল্পটি উত্তমপুরুষে বর্ণিত। গল্পের প্রধান চরিত্র গল্পকথক নিজেই। নায়কের মনের অবদমিত কামনার অকস্মাৎ আত্মপ্রকাশ গল্পটিকে আস্বাদনীয় করে তুলেছে বর্ণনাভঙ্গি ও চরিত্রের স্বরূপকে মেলে ধরে। যেমন, "... কেমন করে যেন মনে হল সেই হারিয়ে যাওয়া নায়িকা আজ পরিপূর্ণ যৌবনে ওই বন-তুলসীর কুঞ্জে আমারি জন্যে অপেক্ষা করছে।" শারীরিক ক্রিয়া ও সাঁওতাল রমণীর আসঙ্গলিপ্সায় বনতুলসীর ঝোপকে সঙ্কেত কুঞ্জ হিসেবে অনুমান করার মধ্যে নায়কের যৌনবাসনা স্পষ্ট হয়ে পড়েছে।
গল্পে ক্লাইম্যাক্স নেই বরং মূল সম্পাতন বিন্দুতে পৌঁছানোর জন্য গল্পকার সংযোগ সূত্র রচনা করেছেন। মানুষ ও প্রকৃতি গল্পে একাকার হয়ে গিয়েছে। প্রকৃতির রাক্ষুসে ক্ষুধা নায়কের মধ্যে জাগ্রত হয়েছে। গল্পের সমাপ্তিতে এসেছে বাস্তবতা ও চৈতন্যের আলোক। উদ্ভিদের স্বভাব শান্ত প্রকৃতির মধ্যে এক সর্বগ্রাসী শরীরী আসঙ্গের দাহ তৈরি করে গল্পটির কথাবস্তুতে গল্পকার অভিনবত্ব এনেছেন। বনতুলসী যে সাঁওতাল মেয়ের প্রতীক-সেই ব্যঞ্জনাও গল্পের সম্পদ।
'ইতিহাস' গল্পে রয়েছে বিয়াল্লিশের আগস্ট আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের কাহিনি। গল্পটিতে আদ্যন্ত রয়েছে নাটকীয়তার সুর। পরিবেশ সৃষ্টিও অনবদ্য। যেমন, প্রণতি লোকেশের আন্দোলনের রক্তাক্ত পথকে মেনে না নিয়ে প্রশ্ন করেছে, "কিন্তু দাদা, সত্যাগ্রহের দীক্ষা কি আমরা এইভাবেই নিয়েছিলাম?" প্রণতির মানসিকতার রূপায়ণে দুর্যোগময় প্রকৃতিচিত্র এসেছে-যা প্রণতির মানবিকতার প্রকাশক। গল্পের ক্লাইম্যাক্স এসেছে সাইক্লোনের দুর্যোগপূর্ণ সময়ে। বাস্তব ও আদর্শের মেলবন্ধন সম্পাদিত হয়েছে প্রণতির মধ্যে শোকের চেয়েও মানবিকতার উন্মোচনে। গল্পের চরম মুহূর্তে দারোগাকে সপরিবার আশ্রয় দিয়ে প্রণতি প্রমাণ করে দিয়েছে অহিংসার বাণী তার কাছে কথার কথা মাত্র নয়।
‘ছোটগল্পের সীমারেখা'-তে গল্পকার লিখেছিলেন, "কবিতাকে ছাড়িয়ে যেমন করে
ভাবের মুক্তি ঘটে যায় সংগীতের অসীমে, গল্পও সেইভাবে তার বস্তুভার থেকে নিষ্ক্রান্ত
হয়ে যায় কবিতার প্রমুক্ত অঙ্গনে। গল্প মাটিতে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি মেলে দেয় আকাশের নক্ষত্রলোকে,
কবিতা সেই আকাশেই উদ্বারিত হয়ে যায়।" লেখকের গল্প সম্পর্কেও এই উক্তি প্রযোজ্য।
তাঁর কোনো কোনো গল্প যেন গদ্যকাব্য, ব্যঞ্জনা হৃদয়- গ্রাহী, প্রতীকধর্মিতাও তীক্ষ্ণ,
ভাষাশৈলী শাণিত, উজ্জ্বল ও স্নিগ্ধ। আঙ্গিক রীতিতে তিনি চেকভ ও মোপাসাঁ-এই দুয়ের সমন্বয়
ঘটিয়েছেন। তাঁর গল্পের সমাপ্তিও Whipcrack ending বা চাবুক মারা সমাপ্তি। তাঁর গল্পের
মধ্যে পাই-লেখকের ব্যক্তিত্বকে Project himself'। বর্ণনারীতি বিষয় অনুসারী, কথোপকথনের
সংলাপে রয়েছে নাট্যধর্মিতা, নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যাওয়ার জন্য উপাদানে সমৃদ্ধ তাঁর
গল্প। সেজন্য নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প পাঠকের কাছে এত আকর্ষণীয় ও রসাস্বাদী।
কোন মন্তব্য নেই
ok