'বাংলা ছোটগল্পের প্রথম সার্থক পথিকৃত ও স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ': ড. নীলোৎপল জানা
'বাংলা ছোটগল্পের প্রথম সার্থক পথিকৃত ও স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ'
ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতম প্রশাখা এবং তা পথ খোঁজার পালা শেষে করে আত্মপ্রতিষ্ঠার স্থায়ী শিল্প ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের হাতে। রবীন্দ্র সৃষ্টি সাহিত্যের ঐশ্বর্য পথে এক অতি উৎকৃষ্ট ফসল হল বাংলা ছোটগল্প। তিনিই বাংলা ছোট গল্পের প্রথম শিল্পসার্থক স্রষ্টা।
কবি তখন বাস করছিলেন পদ্মাপ্রবাহ চুম্বিত শিলাইদহ
অঞ্চলে। মাটি ও মানুষের তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনাও ধরা পড়েছে কবির চোখে। এমত অবস্থায় রবীন্দ্র
লেখনি জন্ম দিয়েছে বাংলা ছোটগল্প। তাই তিনিই বাংলা ছোট গল্পের সংজ্ঞা হিসেবে বলতে পারেন-
"ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা ছোট ছোট
দুঃখ কথা
নিতান্তই সহজ সরল……
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে
হবে
শেষে হয়ে হইল না শেষ।"
(শতাধিক
ছোট গল্পের লেখক রবীন্দ্রনাথ। প্রথম শিল্প সার্থক স্রষ্টা হলেও তাঁর সমস্ত গল্পই সমান
জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। তাই বিশেষ বিশেষ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রতিনিধি স্থানীয় গল্পগুলি
নিরপেক্ষ বিচারে ছোট গল্পকার রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ণ করা যেতে পারে।)
কাল বিভাজনের রীতি অনুযায়ী তাঁর রচিত ছোট গল্পগুলিকে
মোটামুটি ভাবে তিনটি পর্বে
ভাগ করা
যেতে পারে। ১৮৯০-১৯০১ সাল পর্যন্ত প্রথম পর্ব- তাঁর সেরা গল্পগুলির অধিকাংশই
এই পর্বে
রচিত। যেমন- কাবুলিওয়ালা, দেনাপাওনা, ছুটি, পোষ্টমাস্টার, নষ্টনীড়, নিশীথে, ক্ষুধিতপাষাণ
ইত্যাদি। ১৯১৪ সালে 'সবুজপত্র' মাসিক পত্রিকাকে অবলম্বন করে আরম্ভ হয় তাঁর ছোটগল্পের
দ্বিতীয় পর্ব। এই পর্বের প্রধান কতকগুলি গল্প হলো হালদার গোষ্ঠী, ল্যাবরেটারী, হৈমন্তী,
স্ত্রীরপত্র ইত্যাদি। ১৯৪০ সালে প্রকাশিত 'তিনসঙ্গী'র মাধ্যমে তৃতীয় পর্ব চিহ্নিত।
রবীন্দ্র ছোটগল্পের প্রথম পর্বের একটা উল্লেখযোগ্য গল্প হল 'কাবুলিওয়ালা'। এটি 'সাধনা' পত্রিকাটিতে প্রকাশিত হয়। এই গল্পটির সঙ্গে 'যেতে নাহি দিব' কবিতাটির মর্মগত মিল লক্ষণীয়। রহমত তার পিতৃহৃদয় নিয়ে বাংলার এক অখ্যাত গৃহস্থ কন্যা মিনিকে প্রাণের গভীরে টেনে নিয়েছিল। এই অসম্ভব গোপন ইতিহাস মিনির বাবার কাছে রহমত নিজেই ব্যক্ত করেছে-
"বাবু তোমার যেমন একটি লড়কী আছে,
তেমনি দেশে আমারও একটি লড়কী আছে। আমি তাহারই মুখখানি স্মরণ করিয়া তোমার খোঁকীর জন্য
কিছু কিছু মোয়া হাতে লইয়া আসি। আমি তো সওদা করিতে আসি না।"
কাবুলিওয়ালার
এই বক্তব্য থেকে বিশ্বপিতার এক সত্ত্বার সাথে আমাদের পরিচয় ঘটে। (কবির মনে কাবুলিওয়ালা
কোন বিশেষ দেশকালের অস্তিত্ব নেই। তাই এই গল্প সব যুগের, সব
কালের। এই
গল্প প্রসঙ্গে সমালোচক ড. হরপ্রসাদ মিত্র বলেছেন-
'কাবুলিওয়ালা
হিন্দু হলেও ক্ষতি ছিল না এবং ভুটানী হলেও গল্প ঠিক থাকতো।)
'দেনাপাওনা' গল্পে পাই হিন্দু ঘরের মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে
ঘৃণ্য দেনাপাওনার হিসেব নিকেশের এক নির্মম চিত্র। দরিদ্র রামসুন্দর মেয়ের বিয়ের পণ
পুরোপুরি দিতে না পারায় তার কপালে জোটে অপমানের আঘাত। আর অন্যদিকে মেয়ে নিরুপমার ভাগ্যে
জোটে শ্বশুরবাড়ির লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ও অত্যাচার। পরিণামে নিরুপমার মৃত্যু ঘটে। এই গল্প
রবীন্দ্রগল্প সারিতে প্রথম শিল্পের দাবীতে প্রতিষ্ঠিত।
'পোষ্টমাষ্টার' গল্পটি শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার।
শহরের মানুষ পোষ্টমাস্টার। কর্মসূত্রে আসেন গ্রামে। পরিবেশ তার কাছে প্রতিকূল হয়ে দাঁড়ায়।
সেই প্রতিকূল পরিবেশে মনের সাক্ষী হয় বালিকা রতন। রোগজর্জর পোষ্টমাষ্টার সুস্থ হন রতনের
একনিষ্ঠ সেবায়। তবুও রতনের শহরের যাওয়ার ইচ্ছাপূরণ করেননি পোষ্টমাষ্টার। ব্যথাময় এক
শৈল্পীক পরিবেশে আলোচ্য গল্পটি শেষ হয়েছে।
'ছুটি' গল্পটি পোষ্টমাষ্টার গল্পের উল্টোপিঠ।
গল্পের নায়ক ফটিক। পল্লীগ্রামের ছেলে। শহরে পরিবেশে গিয়ে সে বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। সেই রুগ্ন
শহুরে পরিবেশে ফটিকের অস্তিম পরিণতিটিও বেদনাদায়ক। শিক্ষাব্রতী শিল্পী রবীন্দ্রনাথ
দেখানোর চেষ্টা করলেন একটা শিশুমনকে তার মনের বিপরীত পরিবেশে রেখে কোনভাবেই শিক্ষিত
করে তোলা যায় না।
'নষ্টনীড়' ফুলের গল্প নয়, ফুল ফুটে ওঠার গল্প।
সমালোচকদের চোখে এ গল্প পেয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি। 'নষ্টনীড়' যেন 'চোখের বালি'র
খসড়া। এ গল্পের যে দাম্পত্য জীবন, তা গড়ে উঠেছিল ভূপতি ও চারুলতার মধ্য দিয়ে সেই শান্ত
নীড়ে একদিন ঝড়ের পথ বেয়ে প্রবেশ করল অজানা ক্রমিক পর্যায়ে নীড় হল নষ্ট। কালোত্তীর্ণ
এই রবীন্দ্র গল্প বাংলা চলচ্চিত্রের সুপরিচালক সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় একটি শ্রেষ্ঠ
চিত্ররূপ পেয়েছে, যার নাম 'চারুলতা'।
'ক্ষুধিত পাষাণ' গল্পটি 'স্বর্গ হতে বিদায়' কবিতার
সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে মনে হয়। স্বর্গ হতে বিদায়ের কালে বিদায়ী মানুষটি বুঝতে পেরেছে
পৃথিবীর তুলনায় স্বর্গ কত হৃদয়হীন ও অবাস্তব। ঠিক একই রকম অবস্থা ও অবাস্তবতা ক্ষুধিতপাষাণের
ঐ প্রাসাদটির।
'নিশীথে' গল্পটি সম্পূর্ণভাবে মনোবিকার ভিত্তিক।
দাম্পত্য আদর্শচ্যুতির জন্য অপরাধবোধ এবং মনোবিকারের উদ্দীপক। বলাকার পক্ষধ্বনির মতো
এখানেও নিশীথ রাত্রির শব্দতরঙ্গ বিশ্বরহস্যের মর্ম বিদারুণে নিয়োজিতা। প্রকৃতপক্ষে
গল্পটি অতিপ্রাকৃতিক নয়, আত্মদমনে অক্ষম বিকারেরই অভিব্যক্তি।
দ্বিতীয় পর্বের উল্লেখযোগ্য গল্প হল 'হালদারগোষ্ঠী'।
এই গল্পে বনোয়ারীলাল তার পরিবার প্রথার নিপীড়ন থেকে মুক্তিকামী। নীতি হিসেবে পারিবারিক
কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে তার কোন অভিযোগ নেই। গল্পের উপসংহারে এই নায়কচরিত্র পিতার শ্রাদ্ধ
অসম্পূর্ণ রেখে হালদার গোষ্ঠীর সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছে।
ল্যাবরেটরী'
গল্পটি সম্পর্কে রবীন্দ্রসমালোচক প্রমথনাথ বিশী মন্তব্য করেছেন- '
""ল্যাবরেটরী' গল্পটি রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ বয়সে লিখিত হওয়া সত্ত্বেও তাহার অন্যতম
শ্রেষ্ঠ রচনা বলিয়া আমার ধারণা।"
ভাষার সাবলীলতায়, ঘটনার সুনিপুণ বিন্যাসে আলোচ্য
গল্পটি রবীন্দ্র প্রতিভার এক অনবদ্য শিল্প উপহার। কেন্দ্রিয় চরিত্র সোহিনীর অস্পষ্ট
পূর্ব রূপ পাই চিত্রাঙ্গদা ও দেবযানী চরিত্রে।
তৃতীয় পর্বে গল্পের বাচনভঙ্গির তির্যকতায় ও
ভাবচেতনার আধুনিকতা তথা তত্ত্বপ্রাধান্য লক্ষ করার বিষয়। তিন সঙ্গীর তিনটি গল্পের মধ্যেই
তার পরিচয় নিহিত রয়েছে। প্রথম গল্প 'রবিবার' একটি মনোরম প্রেমকাহিনি। দ্বিতীয় গল্প,
'শেষ কথা' যেন আরণ্যক জৈবতার কত অন্ধ আকর্ষণ থেকে অচিরার পুনরুদ্ধার এবং নবীন পাঠকের
অনিচ্ছালব্ধ মুক্তি।
প্রকৃতি চেতনা রবীন্দ্র ছোট গল্পের একটি বিশেষ
উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। তাঁর বেশির ভাগ গল্পে প্রকৃতি ব্যবহৃত হয়েছে মানবমনের ভাবনাকে
সুব্যক্ত করে তুলতে কেবল নিছক প্রকৃতি চিত্রণের নেশাহত নয়, তাঁর কাব্যিক শিল্পীমনে
রঙ্গপ্রকৃতি বরণীয় রূপ দিয়েছে বঙ্গনরনারীর মনের কথাকে শিল্প রূপ দিতে।
ভাষা প্রয়োগে রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প বিশেষ
শিল্প কৃতিত্বের দাবীদার। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্র ছোটগল্পে ভাষারীতির
মধ্যেও পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ছোটগল্প রচনায় প্রথম পর্বের সাধু গদ্যকে
ত্যাগ করে চলিত গদ্য রীতিতে প্রত্যাবর্তন করেছেন। সমালোচক দেখেছেন-
'সবুজ পত্র লেখার সময়, অন্তত 'ঘরে বাইরে'
(১৯১৩) তে চলিত গদ্যভাষা গ্রহণের পর রবীন্দ্রনাথ সেই যে সাধুভাষাকে ত্যাগ করেছিলেন,
তারপর তাতে আর প্রত্যাবর্তন করেননি।' (বুদ্ধদেব বসু)
শিল্পী রবীন্দ্রনাথের শিল্পভাষণ অমরশিল্পে বাস্তবায়িত হয়েছে। চিরকালীন পিতৃহৃদয়, বালকসত্ত্বা, নারীত্ববোধ, সামাজিক সমস্যা ও সম্পর্ক, আধুনিক মনোগহনের জটিল রহস্য উন্মোচন প্রভৃতি সমস্ত সমস্যাই রবীন্দ্র ছোটগল্পে অক্ষয়কীর্তি লাভ করেছে। পাশাপাশি স্মরণ করতে হয় তিনি বাংলা ছোটগল্পে শিল্প সার্থক সংজ্ঞা দান করেছেন। সব মিলিয়ে তাঁর ছোটগল্প যা ছোট প্রাণ আর ছোট ব্যথা নিয়ে রচিত সেগুলি আমাদের অন্তরে অতৃপ্তির দীর্ঘশ্বাসই রেখে যায়- " শেষ হয়েও হইল না শেষ।"
====================
যারা পেজটি দেখছেন বা ফলো করছেন অবশ্যই নাম লিখে কমেন্ট দিন।
কোন মন্তব্য নেই
ok