গল্পকার নরেন্দ্রনাথ মিত্র :ড. নীলোৎপল জানা
গল্পকার নরেন্দ্রনাথ
মিত্র
বাংলা ছোটোগল্পের জগতে নরেন্দ্রনাথ মিত্র (১৯১৬-১৯৭৫)
মধ্যবিত্তের জীবনশিল্পী। তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমকালীন পৃথিবীতে আবির্ভূত হন এবং দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে বাংলা সাহিত্য জগতে তাঁর আবির্ভাব ঘটে। তাঁর প্রথম রচিত গল্প
'মৃত্যু ও জীবন' প্রকাশিত হয় দেশ পত্রিকায়, ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে। এই বছর 'মুক' নামে নরেন্দ্রনাথের
প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ 'অসমতল' প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের
শেষ বছরে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে। একই সঙ্গে প্রকাশিত হয় 'হলদে বাড়ি' গল্পগ্রন্থ। ফলত এই
গল্পগুলিতে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার ছবি প্রকাশিত হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমান্তরালে পঞ্চাশের মন্বন্তর ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রভাবও
তাঁর সাহিত্য জগৎকে প্রভাবিত করে। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি তার নিজের লেখা সম্পর্কে বলেছেন
'সমাজে শঠতা আছে, ক্রুরতা আছে, তা আমি জানি। হিংসা, বিদ্বেষেরও অভাব নেই। কিন্তু সমাজ
জীবনের এই অন্ধকার দিকের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় কম।... শান্ত মধুর ভাবই আমার রচনায়
বেশি।' তাঁর রচনায় আবেগসমৃদ্ধ মূল্যবোধসম্পন্ন শুভ বিশ্বাসের কথা ফুটে উঠেছে। শুধু
দুঃখ, যন্ত্রণা, হতাশা, কাঠিন্যের কথা তিনি লেখেননি। তিনি লিখেছেন ভালোবাসার কথা, প্রেম-প্রীতির
কথা। তাঁর গল্প বিশ্বের মধ্যে প্রবেশ করলে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য আমাদের চোখে ধরা পড়ে,
১. নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্পবিশ্ব মূলত জীবনের
বহু বর্ণ চিত্রমালা। একদিকে দুঃখ দারিদ্র্যময় জীবন অপরদিকে দুঃখ- দারিদ্র্য অতিক্রান্ত
জীবনকথা স্পষ্ট নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্প-শরীরে।
২. নরেন্দ্রনাথের গল্পের প্রধান আকর্ষণ হল মানব
সম্পর্কের বহু বিচিত্র রূপচিত্রণ। মানুষের বিভিন্ন গুণাবলী, ভালো-মন্দ, শুভ-অশুভ নানাদিকের
টুকরো টুকরো সাদামাটা ছবি নরেন্দ্রনাথ মন্থন করে তুলে এনেছেন তাঁর গল্পে।
৩. মধ্যবিত্ত মানসিকতা ও অবক্ষয়ী মননের রূপায়ণ
তাঁর গল্পে লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তিনি গল্পকে শেষ করেন মমত্ববোধে, মানবিকতার প্রতি
শুভেচ্ছায় এবং উত্তরণের মাধ্যমে।
৪. নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্পের ভাষা কঠিন ও কোমল।
যুগ বৈশিষ্ট্যের নিরিখে সময়োচিত ভাষা প্রয়োগে তিনি শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিয়েছেন।
নরেন্দ্রনাথ যেন পর্যবেক্ষক। তিনি সম্পর্কের টানাপোড়েন, ভাঙন ক্রমাগত দেখে গেছেন, দেখে গেছেন মূল্যবোধের বিনষ্টি, শুদ্ধ জীবনবোধের অবসান। এই দেখার চোখ নিয়েই এক একটি গল্প রচনা করেছেন। তাঁর 'অবতরণিকা', 'অভিনেত্রী', 'সেতার', 'মহাশ্বেতা', 'রস', 'চড়াই-উতরাই' প্রভৃতি গল্প বিশেষ উল্লেখযোগ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা প্রভৃতি বিষয়ের সঙ্গে মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের সনাতন মূল্যবোধের পরিবর্তনের, ভাঙনের কথা প্রকাশিত হয়েছে 'অবতরণিকা'তে। 'অভিনেত্রী' গল্পেও নরেন্দ্রনাথ মিত্র সামাজিক মূল্যবোধ নিয়ে বেঁচে থাকা, পুনরুজ্জীবিত হতে চাওয়ার চিত্র মমতার সঙ্গে এঁকেছেন। 'সেতার' গল্পেও দেখা যায় অর্থ চিন্তায় নীলিমাকে বাইরে জীবিকার জন্য বেরোতে হয়েছে। কিন্তু স্বামী সুবিমল ও শ্বশুর শাশুড়ির অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নীলিমা জীবনের সেতারে সুর তুলেছে। এ গল্পের নীলিমা চরিত্রের মধ্য দিয়ে গল্পকার দেখিয়েছেন মূল্যবোধ বিনষ্টির ছবি। 'মহাশ্বেতা' গল্পে পরিবর্তনশীল সমাজের সুন্দর রূপচিত্র আছে। 'রস' গল্পে মানুষের চিরন্তন বৃত্তির কথা ধ্বনিত হয়েছে। এই গল্পে তিনি প্রেম মনস্তত্ত্বকে দুভাবে নির্মাণ করেছেন- নিছক রূপাসক্তিজনিত প্রেম ও জীবন জড়ানো প্রেম। যদিও গল্পটি তাঁর অসামান্য লেখনীর গুণে বিশ্বজনীন মানবমনের বিশুদ্ধ প্রেমের গভীর ব্যঞ্জনা নিয়ে অন্যতম সম্পদ হয়ে উঠেছে। 'চড়াই-উতরাই' গল্পটি মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের অবক্ষয়ের জীবন্ত দলিল। 'চোর' গল্পটিতেও জীর্ণ মধ্যবিত্ত বাঙালি মানসের মূল্যবোধের সঙ্কটকে তুলে ধরেন।
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্প মধ্যবিত্ত মননের অবক্ষয়
ও তার মূল্যবোধের পরিবর্তন নিয়েই উপস্থিত। পরিবর্তমান সমাজ ও সময়কে পটভূমি করে গল্পবিশ্বকে
নির্মাণ করেছেন এবং তাকে শিল্পসৌরভমণ্ডিত রূপ দিয়েছেন। 'বিশ শতকের চল্লিশের দশক ধরে
নরেন্দ্রনাথ মিত্র যতগুলি গল্প লিখেছেন, দেশকালের দাবিকে তিনি অস্বীকার করতে পারেন
নি। তাঁর গল্পকার-ব্যক্তিত্ব এমন সময়ের কালো ছায়া নিয়েই ছোটোগল্পগুলিতে ধরা পড়ে। মানবতার
রসে জারিত তাঁর গল্পের আখ্যানে সমাজ-বাস্তবতার সার্থক রূপায়ণ ঘটেছে। তাই একথা নিসন্দেহে
বলা যায় গল্পকার হিসাবে নরেন্দ্রনাথের মুন্সিয়ানা ও দূরদর্শিতা বাংলা গল্প সাহিত্যে
দুর্লভ।
কোন মন্তব্য নেই
ok