Translate

গল্পকার পরশুরাম : ড. নীলোৎপল জানা

 


গল্পকার পরশুরাম

    বাংলা সাহিত্যের রঙ্গ- ব্যঙ্গ ধারায় পরশুরামের (১৮৮০-১৯৬০) আবির্ভাব। তিনি হাসির গল্পের স্রষ্টা। পরশুরামের অন্তরালে আছে মনীষী রাজশেখর বসু। জগৎ ও জীবনের অসঙ্গতি সম্পর্কে অতি সচেতন এই মানুষটি তাঁর বক্তব্য প্রকাশে উপায় হিসাবে রঙ্গ-ব্যঙ্গ গল্পের জনপ্রিয় মাধ্যমকে বেছে নিয়েছিলেন। প্রমথ চৌধুরী, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় রঙ্গ-ব্যঙ্গ গল্পে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিলেন। তারই মধ্যে অতি অল্প সময়ে পরশুরাম নিজের স্থান তৈরি করে নিলেন নিজস্ব পদ্ধতিতে। তিনি ত্রৈলোক্যনাথের যথার্থ উত্তরসূরি। প্রাচীন সাহিত্য, বিজ্ঞান, আইন ও মনোবিজ্ঞানে অপরিসীম জ্ঞান, মানব চরিত্র সম্পর্কে বিশ্লেষণের অভিজ্ঞতা তাঁকে রঙ্গ-ব্যঙ্গের ধারায় জনপ্রিয়তা এনে দেয়। তাঁর বিভিন্ন গল্প বিশ্লেষণ করলে আমরা তাঁর গল্পবিষয়ের স্বরূপটিকে নিম্নলিখিতভাবে চিহ্নিত করতে পারি-

 

    ১. পরশুরামের গল্প স্বভাবের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য ছিল হাস্যরস পরিবেশন। গল্পের ক্ষেত্রে তিনি মুখ্যত ব্যঙ্গশিল্পী যদিও তাঁর এই ব্যঙ্গ মানুষকে আঘাত করে না বরং হাস্যরসের অবগাহনে পাঠক তৃপ্ত হন।

    ২. পরশুরামের গল্পে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির সম্যক পরিচয় পাওয়া যায়। সামাজিক বা চারিত্রিক অসঙ্গতির গভীরতম কারণটিকে ব্যঙ্গ করাই তাঁর অন্যতম লক্ষ্য ছিল।

    ৩. পরশুরামের গল্পাঙ্গন মানবজীবনলীলায় মুখর। সমাজের বহু মানুষের চরিত্র উদ্ঘাটনে তাঁর লেখনী তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। বহিরঙ্গ হাসির আবরণের মধ্যে যে জীবনবোধ লুকিয়ে আছে তাকেই তিনি গল্প-প্রতিবেদনে খুঁজে এনেছেন।

    ৪. পরশুরাম বস্তুতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সমাজজীবনের সমস্যাকে চিহ্নিত করেছেন।

    ৫. রঙ্গব্যঙ্গের বিষয়কে পরিস্ফুট করার জন্য বাহুল্যবর্জিত ভাষাকে ব্যবহার করেছেন। বিষয় উপস্থাপন, চরিত্র চিত্রণ, পরিবেশ- পরিস্থিতির বিন্যাস ও নানা ভাবের প্রকাশে তাঁর সুপ্রযুক্ত শব্দচয়ন বাংলা ভাষাভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে।

 

গল্পের বিষয়ের নানা বৈচিত্র্য অনুযায়ী আমরা তাঁর গল্পকে নিম্নলিখিত ধারায় বিভক্ত করতে পারি।

 

    (ক) পৌরাণিক গল্প 'জাবালি', 'তৃতীয় দ্যুতসভা', 'রামরাজ্য', 'হরণের ঝুমঝুমি', 'গন্ধমাদন', 'যযাতির কথা', 'ভীমগীতা' ইত্যাদি। ধর্মের নামে ভণ্ডামির দৃষ্টান্ত তাঁর 'সত্যবতী ভৈরবী', 'বিরিঞ্চিবাবা', 'যশোমতী', 'পরশপাথর' ইত্যাদি গল্পগুলি।

    (খ) প্রেমের গল্প- 'আনন্দীবাঈ', 'চিঠিবাজি', 'নীলতারা' ইত্যাদি।

    (গ) হৃদয়বেদনার গল্প 'ভূষণপাল', 'দাঁড়কাক', 'কৃষ্ণকলি' ইত্যাদি।

    (ঘ) তত্ত্বপ্রধান গল্প 'ভীমগীতা', 'কাশীনাথের জন্মান্তর', 'সত্যসন্ধ বিনায়ক' ইত্যাদি।

    (ঙ) বিশুদ্ধ কৌতুকহাসির গল্প 'জটাধর বকশীর তিনটি গল্প', 'গুপী সাহেব', 'উপেক্ষিতা' ইত্যাদি।

 

    পরশুরাম বেশি বয়সে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই সাহিত্যিক প্রায় আটত্রিশ বছর বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। তার গল্পের সংখ্যা নিরানব্বই এবং একটি অসমাপ্ত গল্প আছে। তাঁর গল্প গ্রন্থের সংখ্যা মোট নটি। যথা- ১. গড্ডলিকা (১৩৩১ বঙ্গাব্দ) ২. কজ্জলী (১৩৩৫ বঙ্গাব্দ) ৩. হনুমানের স্বপ্ন ইত্যাদি গল্প (প্রথম সংস্করণ ১৩৪৪, দ্বিতীয় সংস্করণ ১৩৫০) ৪. গল্পকল্প (১৩৫৭ বঙ্গাব্দ) ৫. ধুস্তরী মায়া ইত্যাদি গল্প (১৩৫৯ বঙ্গাব্দ) ৬. কৃষ্ণকলি ইত্যাদি গল্প (১৩৬০ বঙ্গাব্দ) ৭. নীলতারা ইত্যাদি গল্প (১৩৬৩ জ্যৈষ্ঠ) ৮. আনন্দীবাঈ ইত্যাদি গল্প (১৩৬৪ পৌষ) ৯. চমতুমারী ইত্যাদি গল্প (১৩৬৬ বঙ্গাব্দ)।

    পরশুরাম লক্ষ করেছিলেন ভারতজুড়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। ব্রিটিশের অত্যাচার, কংগ্রেসের আন্দোলন, বঙ্গভঙ্গ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দেশজুড়ে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব তাঁর চোখের সামনে ঘটেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পটভূমিতেই তাঁর গল্প লেখা শুরু হয়। তাঁর গল্প সম্পর্কে অজিত কুমার ঘোষ লিখেছেন 'পরশুরামের ব্যাপক জনপ্রিয়তার আর একটি কারণ হইল তাঁহার অদলীয় তঅপক্ষপাতী দৃষ্টিভঙ্গী..... কোথাও শ্লেষের দুএকটি কাঁটা এবং কোথাও বা ব্যঙ্গের ঈষৎ জ্বালাই রহিয়াছে মাত্র, কিন্তু সেগুলির লক্ষ্য বহুবিচিত্র ও পরস্পর বিরোধী সমাজ চরিত্র।' আসলে পরোক্ষভাবে হাসির লক্ষ্য ছিল সমাজমানসের ও সমাজের অসঙ্গতি। তিনি ভণ্ডামীর বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই করেছেন।

    ১৯২২ সালে 'ভারতবর্ষ' পত্রিকায় প্রকাশিত 'শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড' গল্পে তিনি অসাধু ব্যবসায়ীদের তিরস্কার করেছেন। শ্যামানন্দ ও তার দলের মানুষগুলির অসাধু ব্যবসাচক্রকে তিনি আঘাত করতে চেয়েছেন। এই গল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য উপযুক্ত ভাষা প্রয়োগ, পরিবেশ ও চরিত্র অনুযায়ী সংলাপ সংযোজন ও শিল্পকৌশলের অসামান্য সাফল্য।

    তাঁর 'লম্বকর্ণ' গল্পটি মনে রাখার মতো। রায়বংশলোচন ব্যানার্জী বাহাদুর, তার পত্নী মানিনী দেবী, কন্যা টেপী ইত্যাদি চরিত্র গল্পে প্রাণ সঞ্চার করেছেন। 'ভূশণ্ডীর মাঠে' গল্পে ভূতের রাজ্যে ভূতেরাও যে প্রেমে হাবুডুবু খায় তার নিখুঁত হাস্যরসাত্মক বিবরণ আমাদের মনকে ছুঁয়ে যায়। 'জাবালী' গল্পটি পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে রচিত গল্পগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এই গল্পে তিনি মানবজীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে চিহ্নিত করেছেন। তত্ত্বধর্মী গল্পের মধ্যে 'তিলোত্তমা' গল্পটি বর্ণনা গুণে ও পরিবেশন নৈপুণ্যে অসামান্য। রচনার সূক্ষ্মতায়, ভাষার সুপ্রযুক্ত প্রয়োগে, বুদ্ধির প্রাখর্যে এই গল্প অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প।

    পরশুরামের হাস্যরস তীক্ষ্ণ। কারণ তাঁর হাস্যরসের অন্তরালে লুকিয়ে থাকে গভীর জীবন জিজ্ঞাসা ও সমাজ জিজ্ঞাসা। অতি জনপ্রিয় দুটি গল্প 'গড্ডলিকা' ও 'কজ্জলী'তে হাস্যরসের নিখুঁত প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। 'চিকিৎসা সংকট' গল্পে চিকিৎসকদের প্রতি লেখকের বিদ্রূপ মনে রাখার মতো। আবার 'বিরিঞ্চিবাবা' গল্পে তিনি গুরুবাদদের তীক্ষ্ণভাবে নিন্দা করেছেন। ধর্ম নিয়ে ভণ্ডামী, ধর্মব্যবসা ও অর্থলোলুপতাকে তিনি তীক্ষ্ণবাক্য বাণে বিদ্ধ করেছেন। ধর্মীয় ভণ্ডামীর বিরুদ্ধে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ প্রকাশিত 'লক্ষ্মীর বাহন' গল্পটিতে। এই গল্পের নায়ক অসৎ ব্যবসায়ী মুচকুন্দের ধর্মীয় অসততা ও বুজরুকিকে পরশুরাম ঘৃণা করেন, শাস্তি দেন। 'দক্ষিণ রায়' গল্পটিও শুরু হয়েছে সংসারক্লিষ্ট মানুষের ধর্মীয় প্রার্থনার কৌতুককর রূপ বর্ণনার মধ্য দিয়ে। সমাজ ও জীবনের যা গভীরতর অসুখ তা পরশুরামের গল্পে সুতীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের আধারে পরিবেশিত হয়েছে। জীবনের লঘু অসঙ্গতি যা রঙ্গব্যঙ্গের প্রতিষেধকে সারতে পারে তেমন বিষয়ে পরশুরাম অনেক স্বচ্ছন্দ। 'দীনেশের ভাগ্য', 'জয়রাম জয়ন্তী', 'যশোমতী', 'পরশপাথর', 'রামধনের বৈরাগ্য', 'ভরতের ঝুমঝুমি', 'রামরাজ্য' প্রভৃতি গল্পে তিনি ধর্ম সম্পর্কে একটি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করেছেন। সমাজে দেখেছেন ধর্মের নামে মনুষ্যত্বের অবমাননা, অন্ধবিশ্বাস আর ভণ্ডামীর রাজত্ব। তাই তাঁর গল্পে একদিকে যেমন হাস্যরসের আবরণে ধর্মীয় ভণ্ডামীকে আঘাত করেছেন অন্যদিকে ধর্মবোধের সত্য রূপটি অঙ্কন করেছেন।



    পরশুরাম কখনও বিষয় পরিস্ফুটনের ক্ষেত্রে আপোষ করেননি। তাঁর কলমে প্রেম ও দাম্পত্য জীবনের অমলিন কৌতুকস্নিগ্ধ রূপ যেমন আছে তেমনই আছে সমস্যাসঙ্কুল দাম্পত্য সম্পর্ক। প্রেমও তাঁর গল্পে রঙ্গ-ব্যঙ্গের বিষয়ের আশ্রয়ে পরিবেশিত হয়েছে। তিনি আধুনিক নরনারীর অগভীর প্রেমের ভণ্ডামীকে বিদ্রূপের দৃষ্টিতেই দেখেছেন। 'প্রেমচক্র', 'চিকিৎসাসংকট', 'বিরিঞ্চিবাবা', 'কৃষ্ণকলি', 'স্বয়ম্বরা', 'পঞ্চপ্রিয়া পাঞ্চালী', 'যযাতির জরা', 'হনুমানের স্বপ্ন', 'আনন্দমিস্ত্রি' প্রভৃতি গল্পে কৌতুকজনক সুস্থ দাম্পত্যের সমান্তরালে অসুস্থ দাম্পত্যকেও চিত্রিত করেছেন। আসলে তাঁর গল্পে ব্যঙ্গের বিষয় প্রেম নয়, প্রেমে ভণ্ডামী, নানা বিকৃতি, লোভ, স্বার্থপরতা। অনেক সময় তাঁর গল্পে স্বাভাবিকভাবেই আদিরসের প্রসঙ্গ এসেছে কিন্তু পরশুরামের শ্রেষ্ঠত্ব এইখানেই যে তিনি তাঁর গল্পে আদিরসের পরিমিত, সুচিন্তিত ও শিল্পীত প্রয়োগ করেছেন।

প্রথম মহাযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমকালীন সময়ের সমাজ, তার বাস্তবতা, তার অসঙ্গতি দিয়েই গড়ে উঠেছে বেশ কিছু গল্পের বিষয়। 'দক্ষিণ রায়', 'কচি সংসদ', 'লম্বকর্ণ' প্রভৃতি গল্পে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির হীনমন্যতা ও পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণপ্রিয়তাকে তিনি রূপকের আকারে বিদ্রূপ করেছেন। আবার অন্যদিকে 'ধুস্তুরী মায়া', 'উপেক্ষিতা', 'প্রেমচক্র', 'নীলকণ্ঠ', 'গগনচটি', 'দুই সিংহ', 'উৎকোচতত্ত্ব' প্রভৃতি গল্পে মানবতার অন্তরায় সমাজকে ব্যঙ্গ করেছেন। এই সমস্ত গল্পে সামাজিক ব্যাধি, সামাজিক প্রসঙ্গের চিত্র এঁকেছেন। কোথাও তা সুন্দর সমাজচিত্র আকারে কোথাও বা বর্ণময় আবার কোথাও সমাজ বাস্তবতার নৈতিক মানদণ্ড প্রকাশ করেছেন।

    পরশুরামের গল্পের ভাষা সম্পর্কে কাননবিহারী মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, 'তাঁর ভাষাও যেমন সংযত তেমনই সরল। তার মধ্যে পারিপাট্য আছে, কিন্তু অনাড়ম্বর চাকচিক্য বা অলঙ্কারের গুরুভার নেই। ... শব্দসম্পদের মায়াজাল সৃষ্টি করা কোথাও তাঁর প্রধান লক্ষ্য হয়নি। তাঁর শব্দ ব্যবহারের মধ্যে আছে সহজ অকৃত্রিম সংযম এবং অপরিমেয় সংকেতময়তা।' পরশুরাম বাক্যের-শব্দের বিচিত্র ব্যবহারে, অলঙ্কার ও উপমা প্রয়োগের নতুনত্বে, রঙ্গব্যঙ্গাত্মক নতুন শব্দ সৃষ্টিতে, সংলাপের ভাষায় চরিত্র পরিস্ফুটনে শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিয়েছেন। ভাষাগত প্রয়োগ কৌশল পরশুরামের গল্পকে বাংলা সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদে পরিণত করেছে। চরিত্রের অসঙ্গতি নির্মাণের সঙ্গে নারী চরিত্রের মিশ্রণে তিনি আধুনিকমনস্কতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন মনুষ্যেতর প্রাণিও কত সহজেই রঙ্গব্যঙ্গের উপাদান হতে পারে।

    মানবতাবাদী কথাকার পরশুরামের গভীর মানবদরদীসত্তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে তাঁর জীবনে ও গল্পে। দেশ ও কালের বিচিত্র ব্যাপক পটভূমিকে ব্যবহার করে তিনি মানবতাবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। গল্পের সৃষ্টিকৌশল, চরিত্র চিত্রণ এবং ভাষার অনন্যতায় পরশুরাম বাংলা সাহিত্যে রঙ্গব্যঙ্গ ধারায় যে অদ্বিতীয় শিল্পী তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

==========================

Dr.Nilotpal Jana

MGC

কোন মন্তব্য নেই

ok

4x6 থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.