গল্পকার প্রেমেন্দ্র মিত্র : ড. নীলোৎপল জানা
গল্পকার প্রেমেন্দ্র
মিত্র
বাংলা ছোটোগল্পের জগতে প্রেমেন্দ্র মিত্র সংবেদনশীল
লেখক (১৯০৩-১৯৮৮)। দুই মহাযুদ্ধের কারণে সৃষ্ট হওয়া বিশ্বব্যাপী অর্থসংকট, সোভিয়েত
দেশের সাম্যবাদ, আমাদের দেশের দারিদ্র্য ও জীবনমুক্তির লড়াই, ফ্রয়েডীয় মনোবিকলনবাদ
অনুযায়ী মানবমনের গহনতার আবিষ্কার বিংশ শতাব্দীর গল্পকারদের গল্প বিষয় হয়ে উঠেছিল।
প্রেমেন্দ্র মিত্র ব্যতিক্রমী নন। তিনি কল্লোলীয় বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে রবীন্দ্র প্রভাব
মুক্ত স্বতন্ত্র সাহিত্যধারা সৃজনে ব্রতী হয়েছিলেন। 'সংহতি' ও 'কল্লোল' দুই আদর্শ তাঁকে
প্রাণিত করে। প্রেমেন্দ্র মিত্র কীটদষ্ট সময়ের বিধ্বস্ত সমাজের ও অবক্ষয়ী মূল্যবোধের
চিত্রকে বাংলা ছোটোগল্পের বিষয়ীভূত করেছিলেন। তাঁর গল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল সময়-সমাজের
নিরিখে মানবমনের চেতন-অবচেতনের দ্বন্দকে মূর্ত করা। তিনি জীবনভর গোটা মানুষের মানে
খুঁজতে চেয়েছিলেন। মানব চরিত্র তাঁর ছোটোগল্পের প্রধান বিষয়। তিনি মানুষের রূপকার-
তিনি হিউম্যানিস্ট- রিয়েলিস্ট বা ন্যাচারালিস্ট নন। মানুষকে মানুষ বলেই চিহ্নিত করেন
তিনি।
প্রেমেন্দ্র মিত্র মধ্যবিত্ত জীবনের রূপকার হয়েও
তাঁর গল্পে তিনি সর্বহারার হতাশার কথা, দারিদ্র্যের কথা, নিম্নবিত্তের বেদনার কথা বর্ণনা
করেছেন। তিনি মধ্যবিত্তের নানান স্তরক্রমকে উল্লেখ করে তাদের দ্বন্দ সংশয় ও মূল্যবোধ
বিসর্জনের কথা উল্লেখ করেছেন।
প্রেমেন্দ্র মিত্র জীবনসত্যকে ফুটিয়ে তোলার জন্য একদিকে ব্যবহার করেছেন প্রতীকধর্মিতা অন্যদিকে কবিত্ব। এই শিল্পরীতির প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি বঞ্চিত জীবনের প্রতি যেমন সহানুভূতিশীল হয়েছেন তেমনই অন্যায়েরবি রুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন।
কল্লোলীয় অস্থিরতাময় জীবন সন্ধানের মাঝেই ১৯২৩
খ্রিস্টাব্দে 'প্রবাসী' পত্রিকায় 'শুধু কেরানী'ও 'গোপনচারিণী' গল্প প্রকাশের মাধ্যমেই
ছোটোগল্পকার হিসাবে প্রেমেন্দ্র মিত্রের আত্মপ্রকাশ। তিনি 'গল্পলেখার গল্প'তে বলেছিলেন
'কিছু যাদের নেই- যারা কেউ নয়, তাদের সেই শূন্য একরঙা ফ্যাকাশে জীবনের কোনো গল্প কি
হতে পারে না? হোক বা না হোক তাদের কথা লিখব বলে কাগজ কলম নিয়ে বসলাম।' সেইসঙ্গে সুসভ্য
মানুষের অন্তরে আদিম পাশব বৃত্তি, ক্ষুধা, হিংসা, বিষ, অসূয়ার নানা বীভৎস রূপ প্রত্যক্ষ
করা যায়। সময়ের অসহনীয় অবস্থার বিরূপতা ও বিরুদ্ধতা বর্ণনে তিনি ছোটোগল্পকার হিসাবে
প্রথম থেকেই সমাদৃত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
তিনি 'হয়তো', 'দেয়াল', 'মন্দির', 'কুয়াশা', 'শুধু কেরানী', 'পুন্নাম', 'ভবিষ্যতের ভার', 'সাগরসংগমে', 'মহানগর', 'তেলেনাপোতা আবিষ্কার', 'লেবেল ক্রসিং', 'চোখ' প্রভৃতি গল্প লিখেছিলেন।
তাঁর গল্পসংকলন গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ১৬টি। পঞ্চশর ১৯২৯, বেনামী বন্দর ১৯৩০, পুতুল ও প্রতিমা ১৯৩২, মৃত্তিকা ১৯৩৫, অফুরন্ত ১৯৩৬, মহানগর ১৯৩৭, নিশীথ নগরী ১৯৩৮, ধূলি ধূসর ১৯৩৮, কুড়িয়ে ছড়িয়ে ১৯৪৬, সামনে চড়াই ১৯৪৭, সপ্তপদী ১৯৫৫, জলপায়রা ১৯৫৮ প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখ্য।
গল্পের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়, সমাজ, বাস্তব- অতিবাস্তব জগৎ, মনস্তত্ত্ব, রাজনীতি, সামাজিক পট পরিবর্তন, মানবিক চেতনা ও মূল্যবোধ প্রভৃতির বিচিত্র প্রকাশ তাঁর গল্প-বিশ্বের অন্বিষ্ট। 'শুধু কেরানী', 'সাগরসংগমে', 'পুন্নাম', 'মোট বারো' প্রভৃতি অসংখ্য গল্পে 'সমকাল', 'মূল্যবোধ', 'নৈতিক চেতনা', সাম্যবাদী মনোভাবের প্রসঙ্গ উঠে আসতে দেখা যায়। আবার 'মেয়েটি', 'বিপরীত', 'দর্পণ', 'সখীর দলের মেয়ে' প্রভৃতি গল্প হতাশা, নৈতিক অধঃপতন, অবক্ষয়, দ্বন্দের বৃত্তান্ত। হয়তো, 'কুয়াশা' গল্পে নৈতিক দ্বন্দু কিংবা 'ভিড়', 'লাল তারিখ', 'অরণ্য স্বপ্ন', 'যাত্রাপথ' গল্পে মিলন ও মিলনানুভূতির বৈপরীত্য রিক্ত সময়কে প্রতীকায়িত করে।
'হয়তো' গল্পে গল্পকার দেখান পূর্ব পুরুষের ভোগের অন্ধকার নিশ্ছিদ্র। যা ক্রমশ সঞ্চারিত হয় বর্তমান পুরুষের মনে। পাপের সংস্কার বিপর্যস্ত করে জীবনকে। গল্পে কোথাও আড়ষ্টতা নেই, নেই কৃত্রিমতা। সুনিপুণতায় সময়ের প্রেক্ষাপটে মানবিক পরিস্থিতির বিবরণ সার্থক হয়ে ওঠে।'
সাগরসংগমে' গল্পে দাক্ষায়নীর চরিত্রের মধ্য দিয়ে বল্লাহীন মনের জটিল ও রহস্যময়তার চিত্র অঙ্কন করেছেন। তিনি দাক্ষায়নীর নিজ্ঞান মনের স্বরূপ উদ্ঘাটিত করে তার বিবর্তনকে প্রকটিত করেছেন।
'স্টোভ' গল্পে স্টোভকে প্রতীক রূপে ব্যবহার করে মানব মনের দ্বন্দকে নিরূপণ করেছেন। বাসন্তী স্টোভকে নেভাতে চায়, পারে না। একটা অস্বস্তি বাসন্তির সত্তা জুড়ে থেকে যায়। প্রতীকী ব্যঞ্জনায় গল্পটি অসামান্য শিল্পিত রূপ।
আবার 'সংসার সীমান্তে' গল্পে দুই বঞ্চিত মানুষ সংসারের সীমারেখায় দাঁড়িয়ে জীবন-সংসারের ভূমিতে ফিরতে চায়।
'বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদে' কিংবা 'আয়না' গল্পে বর্ণিত বঞ্চিত জীবন লেখকের সহানুভূতির রসে জারিত হয়েছে। 'হয়তো', 'তেলেনাপোতা আবিষ্কার', 'পুন্নাম' গল্পে কবিত্ব ও মনস্তত্ত্বেরযুগলবন্দিতে লাগে ব্যঞ্জনার দোলা। পৃথিবীর সরলতম মাছকে বঁড়শিতে গাঁথা যায় না- মনোবিকলনের কূটাভাস 'তেলেনাপোতা আবিষ্কার' গল্পে নিঃসময়ের নিজস্ব আদল গড়ে দেয়।
প্রেমেন্দ্র মিত্র গল্প রচনার ক্ষেত্রে আর্টের
সততা রক্ষায় বদ্ধপরিকর ছিলেন। আর্ট ও ফর্ম নিয়ে তিনি অসংখ্য পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন।
কখনো আত্মকথন রীতিতে, কখনো চিত্রনাট্যের আদলে আবার কখনো সাংবাদিকতার ধরনে তিনি গল্প
লিখেছেন। অনেক সময় প্রাদেশিক উপভাষা তাঁর গল্পের সংলাপে লক্ষিত হয়। আবার কখনো মিশ্র
বিদেশি ভাষাতেও তাঁর গল্পের চরিত্ররা কথা বলে।
যুগসত্তা উন্মোচনের সূত্রে মানবিক পরিসর ও সামাজিক
অবস্থানের এমন সার্থক সেতু রচনার আয়োজন বাংলা সাহিত্যে সত্যি দুর্লভ। এভাবেই প্রেমেন্দ্র
মিত্র তাঁর সমকালের অন্যান্যদের তুলনায় নিজস্ব ভাবনার স্বাতন্ত্র্যে অনন্য হয়ে ওঠেন।
============================
বেনামী বন্দর (১৯৩০), পুতুল ও প্রতিমা (১৯৩২), মৃত্তিকা (১৯৩৫), অফুরন্ত (১৯৩৬), মহানগর (১৯৩৭) , নিশীথ নগরী (১৯৩৮) , ধূলিধূসর (১৯৩৮), কুড়িয়ে ছড়িয়ে (১৯৫৪০), সামনে চড়াই (১৯৪৭), সপ্তপদী (১৯৫৫) ইত্যাদি।
কোন মন্তব্য নেই
ok