গল্পকার জগদীশ গুপ্ত : ড. নীলোৎপল জানা
বঙ্কিমচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রীয় বিষয়-রূপ-রীতি
ও বিশ্বাসকে অস্বীকার করে বাংলা কথাসাহিত্যের নান্দনিক প্রকরণে যে পালাবদল শুরু হয়েছিল
জগদীশ গুপ্ত(১৮৮৬-১৯৫৭) ছিলেন তার প্রধান ঋত্বিক। শিশিরকুমার দাশ তাঁর 'বাংলা ছোটোগল্প' গ্রন্থে লেখেন-
"বাংলা
সাহিত্যে ইনি অবচেতন মনের গতির প্রথম শক্তিমান শিল্পী ও সেই হিসেবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের
অগ্রসূরী। তাঁর লেখার প্রধান গুণ নির্মম নিরাসক্তি। কাহিনির নায়কেরা সাধারণ। .... সমস্ত
কাহিনির মধ্যে একটি প্রধান সুর, তা হল এক দুর্বার, অনিবার্য নিয়তিবাদ। মানুষ যেন অন্ধশক্তির
খেলার পুতুল।” অর্থাৎ কীটদষ্ট সময়ের কালগর্ভে নিমজ্জিত মানুষের মনের গহন প্রদেশে
প্রবেশ করে জগদীশ গুপ্ত তুলে আনেন চরিত্রের 'আঁতের কথা'। সেইসঙ্গে জীবনের অন্ধকার চোরাগলি পথে
সমাজ-বাস্তবতার যে ভূমি নগ্ন তাকেও নিরাসক্ত, নির্লিপ্ত ভাবে প্রকাশ করেন বিচিত্র ব্যঞ্জনার
আভাসে। তাঁর কথাবিশ্ব মানুষের জীবনের অনালোকিত অধ্যায়ে আলো নিক্ষেপ করে শিল্পসমন্বিত
আখ্যানকে পৃথক ভাবে চিনিয়ে দেয়। দুই বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে নারী-পুরুষের জীবন নিতান্ত
জৈবিক তাড়নায় যে অসুস্থ চেতনাকে লালন করে তাকে যৌক্তিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন গল্পকার
জগদীশ গুপ্ত। সত্য-শিব-সুন্দরের পথে না গিয়ে অপচিত জীবনের সংকটময় মুহূর্তকে তিনি দেখেছেন
গভীর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি ও তীব্র পর্যবেক্ষণ শক্তির মাধ্যমে। তিনি গল্পের প্রচলিত ছক
ভেঙে বক্তব্যকে নিজের মতো সাজিয়ে নিয়েছেন, প্লটকে গুরুত্ব দেন নি। সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির
সম্পর্ক নির্ণয়, চরিত্রের সরল পাটিগণিতের রূপান্তর, সময়ের ভিতরকার অস্থিরতা তাঁর গল্পের
নিজস্ব ধরনে ব্যক্ত হয়েছে।
জগদীশ গুপ্তের অনেক রচনা প্রকাশিত হয় কল্লোল,
কালিকলম, প্রবাসী প্রভৃতি পত্রিকায়। তাঁর লেখা ছোটোগল্পের সংখ্যা প্রায় একশো পঁচিশ।
তাঁর প্রকাশিত গল্পসঙ্কলনগ্রন্থগুলি হল-- 'বিনোদিনী'
(১৯২৭), 'রূপের বাহিরে' (১৯২৯), 'শ্রীমতী' (১৯৩১), 'উদয়লেখা' (১৯৩৩), 'তৃষিতা সৃক্কণী'
(১৯৩৩), 'উপায়ন' (১৯৩৫), 'পাইক শ্রীমিহির প্রামাণিক', 'শশাঙ্ক কবিরাজের স্ত্রী' (১৯৩৬),
'মেঘাবৃত' (১৯৪৮)। দিবসের শেষে, চন্দ্রসূর্য যতদিন, আদি কথার একটি, শঙ্কিত অভয়া,
রসাভাস, অরূপের রাস, পয়োমুখম, হাড়, লোকনাথের তামসিকতা প্রভৃতি গল্পের বয়ানে এমন কিছু
সংকেত তিনি দিয়েছেন যেখান থেকে পাঠকবর্গ সময়-সমাজ-পরিসর ও মানুষের গভীর চোরাস্রোতকে
সহজেই শনাক্ত করতে পারেন। জগদীশ গুপ্ত উপলব্ধি করেছিলেন, প্রত্যেকেই ব্যবহারিক জীবনে
আত্মপ্রতারক মুখোশে আবৃত। তিনি এই মেকি মুখোশকে ছিঁড়ে ফেলার পক্ষপাতী ছিলেন। সমাজ-বাস্তবতা
যতই বদলে যাক, সম্পর্কের বৃত্তে যতই ভাঙনের আভাস তৈরি হোক অন্ধশক্তির চিরাচরিত তাড়নাই
তাঁর গল্পবিশ্বের প্রধান উপজীব্য। আদিম রিপুর কিংবা বিকৃত ক্ষুধার দাপট কীভাবে মননের
গহীনে, সম্পর্কের বিন্যাসে প্রগাঢ় ছায়া ফেলেছিল তা তাঁর গল্পপাঠে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
'বিনোদিনী' প্রকাশিত হওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি চিঠিতে জগদীশ গুপ্তকে লিখেছিলেন, 'ছোটোগল্পের বিশেষ রূপ ও রস তোমার লেখায় পরিস্ফুট দেখিয়া সুখী হইলাম।' গল্পের প্রচলিত প্লট ভেঙে তাঁর গল্প-বয়ানের সুক্ষ্ম স্বরন্যাসে উচ্চারিত হয় সমকালের মানুষের অন্দরের বিভিন্ন কূটাভাস। আবার আখ্যানের সূক্ষ্ম ছদ্মবেশে গল্পকার নিজস্ব ঢঙে নিভৃত প্রতিবাদের যাত্রাপথকেও নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। সংকেত- গূঢ় বাচনে জীবনের বিকৃতি ও অসঙ্গতিকে প্রতিস্পর্ধা জানিয়েছিলেন গল্পকার। আর এইভাবেই সময়ের-সম্পর্কের মিথ্যা ও বিভ্রমের সর্বাত্মক আয়োজনকে একপ্রকার নস্যাৎ করে শরৎচন্দ্রের 'মানসপুত্র' জগদীশ গুপ্ত অন্যতর শিল্পবাস্তবের ভিন্ন জগত নির্মাণ করেছিলেন।
==============
Dr.Nilotpal Jana
MGC
কোন মন্তব্য নেই
ok