বাংলা ভাষা উদ্ভবের ইতিহাস : ড. নীলোৎপল জানা
পৃথিবীতে প্রায় চার হাজার ভাষা প্রচলিত আছে। এই
ভাষাগুলিকে তাদের মূলীভূত সাদৃশ্যের ভিত্তিতে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের পদ্ধতির
সাহায্যে কয়েকটি ভাষাবংশে বর্গীকৃত করা হয়। এর মধ্যে একটি ভাষাবংশ হল ইন্দো-ইউরোপীয়
ভাষাবংশ। এই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের লোকেদের আদি বাসস্থান ছিল রাশিয়ার উরাল
পর্বতের পাদদেশে। সেখান থেকে আনুমানিক ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে
তারা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এই বিস্তারের ফলে তাদের ভাষায় ক্রমশ আঞ্চলিক
পার্থক্য বৃদ্ধি পায়। ফলে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ থেকে প্রথমে পাঁচটি প্রাচীন
ভাষার জন্ম হয়। এর মধ্যে একটি হল ইন্দো-ইরানীয় ভাষা বংশ।
ইন্দো-ইরানীয় ভাষাভাষীর জনগোষ্ঠীর লোকেরা
নিজেরা ‘আর্য’ নামে অভিহিত করত বলে সংকীর্ণ অর্থে এই শাখাটিকে আর্যশাখা বলা হয়।
এই আর্যভাষা থেকেই বাংলা ভাষার উদ্ভব। তবে আর্য থেকে বিবর্তণের পরবর্তী ধাপেই
বাংলা ভাষার উদ্ভব ঘটেনি বেশ কয়েকটি স্তর অতিক্রম করে বাংলা ভাষার উদ্ভব ঘটেছে।
আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ভারতীয় আর্যভাষাকে
তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়—
১) প্রাচীন
ভারতীয় আর্যভাষা— কালসীমা ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
২) মধ্য ভারতীয়
আর্যভাষা— কালসীমা ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৯০০ খ্রিস্টাব্দ। এবং
৩) নব্য ভারতীয়
আর্যভাষা— কালসীমা ৯০০ খ্রিস্টাবদ থেকে বর্তমান সময়।
প্রাচীন ভারতীয় আর্যের দু’টি রূপ ছিল সাহিত্যিক ও কথ্য। কথ্যরূপটির চারটি আঞ্চলিক উপভাষা ছিল
প্রাচ্য, উদীচ্য, মধ্যদেশীয় ও দাক্ষিনাত্য। এই কথ্য উপভাষাগুলি লােকমুখে
স্বাভাবিক পরিবর্তণ লাভ করে যখন প্রাকৃত ভাষার রূপ নেয় তখন মধ্য ভারতীয়
আর্যভাষার যুগ সূচিত হয়। প্রাকৃতের প্রথম স্তরে তার চারটি আঞ্চলিক কথ্য উপভাষা
ছিল। প্রাচীন ভারতীয় ভারতীয় আর্যের কথ্যরূপগুলি থেকে চারটি প্রাকৃত উপভাষার জন্ম
হয়। যেমন প্রাচ্য থেকে প্রাচ্যা প্রাকৃত এবং প্রাচ্য-মধ্যা প্রাকৃত, উদীচ্য থেকে
উত্তর-পশ্চিমা প্রাকৃত এবং মধ্যদেশীয় ও দাক্ষিণাত্য থেকে পশ্চিমা বা
দক্ষিণ-পশ্চিমা প্রাকৃত। এরপর প্রাকৃত ভাষা যখন বিবর্তণের দ্বিতীয় স্তরে পড়ে তখন
মূলত এই চার রকমের মৌখিক প্রাকৃত থেকে পাঁচ রকমের সাহিত্যিক প্রাকৃতের জন্ম হয়।
যেমন- উত্তর-পশ্চিমা থেকে পৈশাচী, পশ্চিমা বা দক্ষিণ-পশ্চিমা থেকে শৌরসেনী ও
মহারাষ্ট্রী, প্রাচ্য মধ্যা থেকে অর্ধ মাগধী এবং প্রাচ্যা থেকে মাগধী।
পৈশাচী, মহারাষ্ট্রী, শৌরসেনী,
অর্ধমাগধী এবং মাগধী ছিল শুধু সাহিত্যে ব্যবহৃত প্রাকৃত। প্রাকৃতের বিবর্তণের
তৃতীয় স্তরে এইসব সাহিত্যিক প্রাকৃতের ভিত্তি স্থানীয় কথ্যরূপগুলি থেকে
অপভ্রংশের জন্ম হয় এবং অপভ্রংশের শেষ স্তরে আসে অবহটঠ। প্রত্যেক শ্রেণীর প্রাকৃত
থেকে সেই শ্রেণীর অপভ্রংশ-আবহটঠের জন্ম হয়েছিল। যেমন পৈশাচী প্রাকৃত থেকে পৈশাচী
অপভ্রংশ-অবহট্ঠ, মহারাষ্ট্রী প্রাকৃত থেকে মহারাষ্ট্রী অপভ্রংশ-অবহট্ঠ, শৌরসেনী
প্রাকৃত থেকে শৌরসেনী অপভ্রংশ-অবহট্ঠ, অর্ধমাগধী প্রাকৃত থেকে অর্ধমাগধী
অপভ্রংশ-অবহট্ঠ এবং মাগধী প্রাকৃত থেকে মাগধী অপভ্রংশ-অবহট্ঠ।
এরপর ভারতীয় আর্যভাষা তৃতীয়যুগে পদার্পন করে। এই সময় এক একটি অপভ্রংশ-অবহট্ঠ থেকে একাধিক নব্য ভারতীয় আর্যভাষা জন্মলাভ করে। যেমন- পৈশাচী অপভ্রংশ-অবহঠট থেকে পাঞ্জাবি, মহারাষ্ট্রী অপভ্রংশ-অবহট্ঠ থেকে মারাঠি, শৌরসেনী অপভ্রংশ-অবহট্ঠ থেকে হিন্দি, অর্ধমাগধী অপভ্রংশ-অবহট্ঠ থেকে অবধি, আর মাগধী অপভ্রংশ-অবহট্ঠ পশ্চিমা ও পূর্বী নামে দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এরমধ্যে পূর্বী ভাষাটি থেকে বঙ্গ-অসমীয়া এবং ওড়িয়া এই দু’টি ভাষার জন্ম হয়। পরবর্তীকালে বঙ্গ-অসমীয়া ভাষাটি বিভক্ত হয়ে বাংলা ভাষার উদ্ভব ঘটে।
----------------------------
যারা পেজটি দেখছেন নাম লিখে কমেন্ট করতে ভুলবেন না
কোন মন্তব্য নেই
ok