গল্পকার আশাপূর্ণা দেবী : ড.নীলোৎপল জানা
গল্পকার আশাপূর্ণা দেবী
বাংলা ভাষার ও সাহিত্যের মরমী শিল্পী আশাপূর্ণাদেবী
(১৯০৯-১৯৯৫)। তিনি অসামান্য প্রবলতায় এবং সৃষ্টির মহৎ গুণে ভাষার সীমানা পেরিয়ে বহুদূর
পর্যন্ত তাঁর সাহিত্যসাম্রাজ্য বিস্তার করতে পেরেছেন। তিনি এক অসামান্য চিত্রকর। দৈনন্দিনতার
জলচ্ছবি এঁকেছেন কথা দিয়ে। তথাকথিত কোনো ডিগ্রিধারী তিনি ছিলেন না, বিদ্যালয় মহাবিদ্যালয়
বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাও তিনি পাননি। কিন্তু গভীর অধ্যবসায় ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টার
মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে নির্মাণ করেছেন। সজাগ, সপ্রতিভ ও কৌতূহলী মন নিয়ে যা কিছু দেখেছেন
তাকেই সাহিত্য মাধ্যমে প্রতিফলিত করেছেন।
তিনি তাঁর দীর্ঘজীবনে রচনা করে গেছেন অজস্র সাহিত্য
কর্ম। একশো ছিয়াত্তরটি উপন্যাস, ১৫০০ ছোটোগল্প, ছোটোদের জন্য সাতচল্লিশটি বই এবং অন্যান্য
সংকলন গ্রন্থের সংখ্যা সাতচল্লিশটি- অসংখ্য সাহিত্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালি
জীবনের প্রতিচ্ছবিকে ফুটিয়ে তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন 'আশাপূর্ণা তুমি সম্পূর্ণা'। আমাদের দেশে অধিকাংশ নারী যখন
রক্ষণশীল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নাগপাশে বন্দি, সামাজিক রীতি-নীতি-প্রথার অচলায়তনে
অবরুদ্ধ সেই যুগে আশাপূর্ণা দেবী অন্তঃপুরের জীবনকথায় মুখরিত করে তোলেন তাঁর সাহিত্যবিশ্বকে।
তাঁর সাহিত্যে কোনো কৃত্রিমতা নেই। নেই কোনো গুরুগম্ভীর তত্ত্বকথা, আছে শুধু সহজ অকপট
ভাষায় জীবনের স্বচ্ছন্দ প্রকাশ। তাঁর গল্পকারসত্তার স্বভাব স্বরূপ নিদর্শন করলে আমরা
যে যে বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই তাকে সূত্রাকারে এইভাবে চিহ্নিত করতে পারি। যথা--
১. আশাপূর্ণা দেবী বাঙালি
নারী জীবনের নিপুণ কথাকার। তিনি নারীর মনস্তত্ত্বকে নৈপুণ্যতার সঙ্গে উদ্ঘাটিত করেছেন।
স্ত্রীরূপে, মারূপে, শাশুড়িরূপে, বৌমারূপে, বিধবা রূপে নারীকে নিজস্ব স্বরূপ ব্যক্তিত্বে
পরিপূর্ণ নারী করে তুলেছেন। নারীর একাধিক রূপের নির্মাণে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
২. আশাপূর্ণা দেবী বাঙালি
জীবনের হাসিকান্না, দুঃখ-আনন্দ নিয়ে গড়ে ওঠা জগৎকে সহজ-সরল ভাষায় সাহিত্যে স্থান দিয়েছেন।
৩. তাঁর সাহিত্যের প্রধান
গুণ মমত্ব ও নিস্পৃহতা। মমত্ব ও মমত্বহীনতার দ্বিরালাপে জারিত হয়েছে তাঁর সাহিত্য।
সমাজতত্ত্ব ও জীবনতত্ত্বকে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি মাঝে মাঝে তির্যকতার আশ্রয় নিয়েছেন।
৪. তিনি চরিত্রগুলিকে বাস্তব
অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করে এঁকে তাদের চোখ দিয়ে দিন বদলের ছবি দেখিয়েছেন।
১৯৪০ সালে তার প্রথম ছোটোগল্প সংকলন 'জল আর আগুন' প্রকাশিত হয়। তিনি অসংখ্য গল্প
লিখেছেন। তার মধ্যে 'ভয়', 'ছিন্নমস্তা',
'স্বর্গের টিকিট', 'ছুটিনাকচ', 'একটি মৃত্যু ও আর একটি', 'পরাজিত হৃদয়', 'কার্বন কপি',
'হাতিয়ার', 'বঞ্চক', 'যোগময়ীর মৃত্যুভয়' প্রভৃতি গল্প উল্লেখযোগ্য।
'ভয়' গল্পে প্রকৃতির কাছে মানুষের পরাজয়ের কাহিনি
চিত্রিত হয়েছে। 'ছিন্নমস্তা' গল্পে একটি পুরুষকে ঘিরে দুই নারীর অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতার
কথা ব্যক্ত হয়েছে। গল্পটি পুত্রশোকে নয়, নিষ্ঠুর এক ভয়াবহতায় শেষ হয়। তাঁর গল্পে নারীরা
যে সংস্কারের কাছে হার মানে সেই সংস্কারের অনর্থক অত্যাচারী দিকটি প্রতিফলিত হয় 'পরাজিত
হৃদয়', 'কার্বন কপি', 'একটি মৃত্যু ও আরেকটি গল্পে'। নগর জীবনের নাগরিক জীবনযাত্রা
প্রকাশিত হয় 'স্বর্গের টিকিট', 'বেআব্রু', 'আয়োজন', 'ঘূর্ণমান পৃথিবী' প্রভৃতি গল্পে।
'ছুটি নাকচ' গল্পটিতে আশাপূর্ণা দেবী প্রকাশ করেন বিধিবদ্ধ সামাজিকতায় জীবন ফুরিয়ে
যায় না বরং এক গভীরতর মানবকিতার আশ্রয়ে নতুন পথে জীবনের নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করে। আশাপূর্ণা
দেবীর গল্পে নারী চরিত্রগুলিও অত্যন্ত স্মরণীয়। তাঁর গল্পগুলির (ছিন্নমস্তা, ছায়াসূর্য,
বৈরাগ্যের রং, প্রলাপ, মৃত্যুবাণ, গুণ্ঠনবর্তী ইত্যাদি) মধ্য দিয়ে নারীরা তাদের স্বতন্ত্র
পরিসরকে খুঁজে পায়। তাঁর মতো অন্তঃপুরের অন্তঃপুরিকাদের অন্তর গহনে কেউ প্রবেশ করতে
পারেনি। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন- 'জীবন পর্যালোচনার বিশিষ্টতায় আশাপূর্ণা দেবীই অগ্রবর্তিনি। .... লেখিকার
জীবন নিরীক্ষার সত্যসার এই গৃহজীবনের মধ্যে লুকিয়ে আছে।' আজও যে স্বপ্রতিষ্ঠার
লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন নারীরা সে কথা ধ্বনিত হয় আশাপূর্ণাদেবীর গল্পবিশ্বে। তাঁর গল্প
থেকেই আমরা চোখ মেলে দেখতে পাই নারীসত্তার উন্মোচনের অরুণোদয়কে।
আশাপূর্ণা দেবীর ছোটোগল্পগুলি সংলাপধর্মী। প্রয়োজন
মতো তিনি বাহুল্যহীনভাবে বক্তব্যকে উপস্থাপন করেছেন। আবার কোথাও তাঁর বক্তব্য হয়েছে
তির্যক আশ্রয়ী। স্বচ্ছ ভাবনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশে তাঁর গল্প বিষয়ানুগ হয়ে ওঠে। সাহিত্যবিশ্ব
যখন আঙ্গিক নিয়ে চিন্তিত তখন তিনি সহজতায় ও অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনায় গল্পের প্লট নির্মাণ
করেছেন। লিঙ্গ অনুযায়ী শব্দের যথোপযুক্ত প্রয়োগে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তিনি যেমন পাণ্ডিত্যোচিত
মনোভাব প্রকাশ না করে সহজ কথায় সহজ ভাবে পাঠককে আপন করে নিয়েছিলেন তেমনি পাঠকও ভাবনার
সহমর্মিতায় তাঁকে প্রাণের মানুষ, আপনার জন রূপে হৃদয়ে স্থান দিয়েছে। বিশ্লেষণের নানান
শৈল্পিক দিক উন্মোচনের মধ্য দিয়ে আশাপূর্ণা দেবী আজও পারিবারিক জীবন ও সম্পর্কের রূপকার
হিসাবে বাংলা সাহিত্যে চিরবন্দিত, চিরস্মরণীয়।
===============================================
Dr.Nilotpal Jana
MGC
কোন মন্তব্য নেই
ok