আত্মজন: অরবিন্দ সরকার
আত্মজন
ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথকে আমাদের বাড়ির ঘরোয়া সদস্য মনে হয়েছে। মায়ের ছিল তীব্র বই পড়ার নেশা। সেখানে
তালিকায় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন। তাঁর রচিত রাজর্ষি আমার প্রথম পড়া ভালো লাগা বই। রেডিও তে খবর শোনার পর আকাশবাণী কলকাতা 'ক' প্রচার তরঙ্গে সকাল ৭:৪০ থেকে ৮ টা
রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনা ডেইলি রুটিন ছিল। মনটা গঠন করার ক্ষেত্রে মোক্ষম। মায়ের কড়া
নির্দেশ সূর্য ওঠার আগেই বিছানা ত্যাগ করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ তো খুব ভোরে উঠতেন। আমার
ভালো লাগতো। তবে শীত কালে লেপ থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন ছিল। তবে এই অভ্যেসটা পরে খুব
কাজে লেগেছে। কাজ করার ক্ষেত্রে বাড়তি সময় পেতাম।
রবীন্দ্রনাথ ছোট বেলা থেকে তাঁর বাবা দেবেন্দ্রনাথের সান্নিধ্য পেয়েছেন। তাঁর কাছ থেকে তার আবদার পূরণ হত। বড় জমিদার বাড়িতে মায়ের
সান্নিধ্য বলতে গেলে পেতেন না। গান লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ,গীতিকার কে অর্থ দিয়ে সম্মানিত
করেছেন স্বয়ং পিতা। এখন তো বিদেশি শাসন এদেশে তাই আমিই করলাম তোমাকে। এই ভাবে বাবা
তাকে লেখার কাজে উৎসাহিত করেছেন। হিমালয়ে প্রথম বেড়ানো তার বাবার সঙ্গেই। কবির ছোটবেলা
চাকর বাকরদের সঙ্গেই কেটেছে। তাঁদের দাপট কম ছিলনা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁদের খুবই
সম্মান করতেন। তাঁদের কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেন। এইটা রবীন্দ্রনাথের কাছে আমাদের
শিক্ষা । ছোট বড় সবাই কে সম্মান করা। তাঁর মধ্যে বেদ উপনিষদের শিক্ষা সহজ ভাবে ফুটে
উঠেছে। কিন্তু তাঁর মধ্যে কোন গোঁড়ামি ছিল না। মানবিক ধর্মে বিশ্বাস ছিল অটুট। ঐশী
শক্তি তে অন্তর্গত আস্থা ছিল। তাঁর রচিত মানুষের ধর্ম বইটি পড়লে তা বোঝা যায়। তাঁর
গানে পেয়েছি আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলির পরে। এবার ফিরাও মোরে কবিতা টি
পড়লে বোঝা যায় তাঁর আস্তিক্যবাদী বোধের প্রকাশ ঘটেছে। তিনি ছিলেন কর্মবীর। প্রতিটি
মুহূর্ত কে তিনি মান্যতা দিতেন। বোলপুর শান্তি নিকেতনে গেলেই তাঁর কর্মযজ্ঞের আঁচ পাওয়া
যায়। সর্বস্তরের শিক্ষিত অশিক্ষিত সকলের সঙ্গে তাঁর ছিল আত্মিক সংযোগ। মহানগর কলকাতা
থেকে বহুদূরে রাঙামাটির ধুলো মেখে প্রিয় বাবার স্বপ্ন কে তিনি রূপ দানে সম্পূর্ণ সচেষ্ট
ছিলেন। চঞ্চলা কবিতায় তিনি বলেছিলেন-
'তীরের সঞ্চয় তোর পড়ে থাক তীরে
তাকাস নে ফিরে
সম্মুখের বাণী নিক তোরে টানি
অতল আঁধার হতে
অকূল আলোতে'।
দাদার সঙ্গে
তিনি জাহাজ করে ইংল্যান্ডে পাড়ি দিয়েছিলেন। কাছ থেকে ইউরোপীয় সভ্যতা দেখেছেন। পরবর্তী
সময়ে কাব্য সাহিত্যে এশিয়া মহাদেশের মধ্যে প্রথম নোবেল জয়ের পরে তিনি পৃথিবীর বহু
দেশে আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন ভারতীয় সভ্যতার ভাবনাকে তুলে ধরার জন্য।
দৃপ্ত কণ্ঠে বিনম্র চিত্তে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরবেন। বিভিন্ন লেখায় লিপিবদ্ধ
করেছেন। আধুনিক মুদ্রণে বই ছাপিয়েছেন, বিক্রির ব্যবস্থা করেছেন। তিনি রাশিয়া ঘুরেছেন,
উত্তর দক্ষিণ আমেরিকায় পদার্পণ করেছেন। শিক্ষার মিলন নিবন্ধে তিনি প্রাচ্য পাশ্চাত্যের
উভয় সভ্যতার মিলনের বার্তা তুলে ধরেছেন। আবার যেখানে প্রতিবাদ করার কথা সেখান থেকে
তিনি একচুল সরে আসেন নি। শান্তি নিকেতনে তিনি বহু গুণী মানুষকে টেনে এনে ছিলেন। বিশ্ব
নাগরিক হিসেবে ভারতের মূল ভাবনা শান্তির মহৎ বার্তা পৌঁছে দিতে আজীবন তিনি অগ্রণী ভূমিকা
গ্রহণ করেছেন। একটি চিঠিতে স্বয়ং রমারলাঁ কালিদাস নাগকে লিখলেন , রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে
ইউরোপে যে উজ্জ্বল জ্যোতির্বলয় তা কিন্তু তাঁর কবিতার সৌন্দর্যের জন্য নয় যতটা তাঁর
বক্তৃতার, বিশেষ করে যুদ্ধকালীন বক্তৃতার, প্রফেটীয় দিকটির জন্য। যখন তিনি নির্ভীক
ভাবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলেন পাশ্চাত্য সভ্যতার ভুল ভ্রান্তি এবং অপরাধের বিরুদ্ধে।
ইউরোপের এলিট তাঁকে ধ্রুবতারা হিসেবে স্বাগত জানিয়েছিলেন --- তাঁকে মনে হয়েছিল সুবিচার
এবং স্বাধীনতার প্রতীক।
কোন মন্তব্য নেই
ok